সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উভয় সংকট বলে অভিহিত করেছিল।

এই গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক থমাস কিয়ান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মধুচন্দ্রিমা এখন পুরোপুরি শেষ। রাজনৈতিক দলগুলো ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ সংস্কার নিয়ে দর-কষাকষি করায় এবং নির্বাচনী সুবিধার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় এ বছর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ বাড়তে পারে।’

দর-কষাকষি শুরু হয়েছিল ৫ আগস্টের পর থেকেই। গণ–অভ্যুত্থানের একটি পক্ষ চেয়েছিল সংবিধান বাতিল করে বিপ্লবী সরকার হোক। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হোক। অন্য পক্ষ এর বিরোধিতা করে বলল, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই সরকার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় পক্ষের যুক্তি মেনে নেওয়া হলো এবং যারা বিপ্লবী সরকার গঠনের পক্ষে ছিলেন, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিনজন উপদেষ্টা হিসেবে শপথও নিলেন।

আজ ৮ ফেব্রুয়ারি। অন্তবর্তী সরকারের ৬ মাস পূর্ণ হলো। ৮ আগস্ট যখন ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন দেশে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা চলছিল। তিন দিন কোনো সরকার ছিল না। পুলিশ বাহিনী পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। জনপ্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা।

আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে সরকার যার ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল ছিল, সেই পুলিশ বাহিনী এখনো পুরোপুরি সক্রিয় হয়েছে বলা যাবে না। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরও মোতায়েন করা হয়। তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়।  

সরকারের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ। সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। খাদ্যমূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের ওপরে। ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, ‘জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণেও অন্তর্বর্তী সরকার চাপে রয়েছে, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যবস্থাপনার উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছে তারা।’

কিন্তু সাধারণ মানুষ তো অর্থনীতির সূত্র বা দুরাবস্থার কার্যকারণ বুঝতে চাইবে না। তারা দেখতে চাইবে, সারা দিন পরিশ্রম করে যে টাকা উপার্জন করেন, তা দিয়ে সংসার চালানো যাচ্ছে কিনা। সন্তানের লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ মোটানো যায় কিনা। নিত্যপণ্যের দাম না কমলে জনঅসন্তোষ বাড়বেই।  

সরকারের অন্যান্য অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল বিগত সরকারের আমলের দুর্নীতি ও লুটপাটের তথ্য উদঘাটন, জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচার। তথ্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে সরকার বেশ কিছু কমিটি গঠন করেছে এবং তারা প্রতিবেদনও দাখিল করেছে। অভ্যুত্থানের সময়ে গণহত্যার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধবিরোধী ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে।

এ ছাড়া ফৌজদারি আইনেও সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মীর নামে মামলা হলেও সেই তুলনায় গ্রেপ্তার হয়েছে কম। ঢালাও মামলার কারণে বিচারপ্রক্রিয়া আরও প্রলম্বিত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি শতাধিক বা তারও বেশি মামলা হয় (বেশির ভাগই হত্যা মামলা), তার তথ্যপ্রমাণ ও সাক্ষ্য জোগাড় করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।

নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছিল। কেউ চান সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচন। আবার অন্যদের দাবি, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সংস্কার করে সরকার দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করুক। এখানে নির্বাচনকে সংস্কারের কিংবা সংস্কারকে নির্বাচনের প্রতিপক্ষ হিসেবে যে দাঁড় করানো হয়েছে, সেটা কোনোভাবে সমীচীন নয়।

সরকার যে বিশৃঙ্খল অবস্থায় অর্থনীতি পেয়েছিল, সেটা কিছুটা শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে পেরেছে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংসের কিনার থেকে মোটামুটি উদ্ধার করা গেছে। কমে আসা বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারেও স্থিতি রক্ষা করা গেছে। তবে সমস্য হলো নতুন বিনিয়োগ নেই। বেকারত্ত বাড়ছে। সামাজিক অপরাধ ও সংঘাতের এটাও কারণ।

তবে শিল্প খাতে অস্থিরতা চলছে। দুর্নীতির দায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হওয়ায় তাঁদের মালিকানাধীন অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে।

অন্তর্বর্তী সরকার সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে। শুরুতে শিক্ষাঙ্গনে যে নৈরাজ্য ও পদবাণিজ্য চলছিল, তা পুরোপুরি রহিত হয়নি। দাবি দাওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রায়ই জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ছে। সরকার সিদ্ধান্ত নেয় রাস্তা বন্ধ করার পর, আগে নয়।

আওয়ামী লীগ আমলে স্বাস্থ্য খাত যে শোচনীয় অবস্থায় ছিল,তার উত্তরণ ঘটেনি। একটি উদাহরণ দিই। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা সেবার দায়িত্ব নিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ৬ মাস পরও  চিকিৎসার দাবিতে তাদের বার বার রাস্তায় নামতে হচ্ছে।

রাজনৈতিক পরিসরেও কোনো সুসংসদ দেখছি না। ৫ আগস্টের পর অভ্যুত্থানকারী শক্তিগুলোর মধ্যে যেই ঐকসূত্র ছিল, তা অনেকটাই ছিন্ন হয়ে গেছে। মাঠে এক পক্ষ অন্য পক্ষের কঠোর সমালোচনা করছে, যা কখনো কখনো মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ আমলের শেষ তিনটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। শেখ হাসিনা স্বৈরাতান্ত্রিক কায়দায় দেশ চালিয়েছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকার ছিল, তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার করবে। এই লক্ষ্যে সরকার যে ১১টি কমিশন গঠন করে, বেশির ভাগ কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে কমিশনপ্রধানসহ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে সরকারের আলোচনার কথা রয়েছে।

নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছিল। কেউ চান সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচন। আবার অন্যদের দাবি, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সংস্কার করে সরকার দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করুক। এখানে নির্বাচনকে সংস্কারের কিংবা সংস্কারকে নির্বাচনের প্রতিপক্ষ হিসেবে যে দাঁড় করানো হয়েছে, সেটা কোনোভাবে সমীচীন নয়।

অন্তর্বর্তী সরকার কোনো পক্ষ নয়। তাদের কাজ সব পক্ষকে এক টেবিলে বসানো। এই আলোচনা তখনই সফল হবে, যখন রাজনৈতিক দল, ছাত্রনেতৃত্ব ও অন্যান্য অংশীজন খোলামনে আলোচনা করে নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়ে এটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে। কোনো এক পক্ষ যদি গো ধরে বসে, তাহলে  আলোচনা ওখানেই শেষ।

গত ৫৩ বছরে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো সুদৃঢ় হলো না, তার পেছনে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় আছে। সমস্যাটি কেবল গত ১৫ বছরের নয়। এর আগেও যাঁরা শাসন করেছেন, তাঁরা দেশকে গণতন্ত্র ও সুশাসন উপহার দিতে পারেননি। ফলে তরুণ প্রজন্মের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের যে দাবি উঠেছে, তা নাকচ করার সুযোগ নেই।

আবার সংস্কারের বিষয়ে যেই সিদ্ধান্তই হোক না কেন, সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে জনরায়কেও মেনে নিতে হবে। কোনোভাবে নির্বাচনী বৈতরনী পার হয়ে সবকিছু ভুলে যাওয়া এবং স্বেচ্ছাচারী কায়দায় দেশ চালানোর পরিণতি কী হয় নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়।

লেখাটি যখন শেষ করছি, তখনই খবর পেলাম, জাপানি সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনা আছে। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘কবে নাগাদ নির্বাচন হতে পারে।’ তিনি বলেছেন, ‘চলতি বছরের শেষ ভাগে’।

এই সাক্ষাৎকারের পর নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যাদের মনে সংশয় ছিল, তা কেটে যাবে আশা করি।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক সরক র র শ ষ কর ক র কর র জন য ব যবস আওয় ম বছর র চলছ ল আগস ট অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

পিডিবির ভুলে ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হলো বাংলাদেশকে

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) খামখেয়ালিজনিত এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশকে দুই কোটি মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে।

খামখেয়ালিটি হলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২০০০ সালে হওয়া ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে (বিরোধ নিষ্পত্তির আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা) একটি মামলায় পক্ষভুক্ত না হওয়া। পক্ষভুক্ত হতে গেলে বাংলাদেশকে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হতো। তা করেনি পিডিবি। ফলে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে একতরফা রায় হয়েছে। দুই যুগ পর এখন বাংলাদেশকে জরিমানা দিতে হয়েছে ৩৩৩ গুণ বেশি অর্থ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গত ১৯ মে পিডিবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, এ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ হিসেবে পিডিবিকে দেওয়া হবে, যা তারা দেবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডকে। হরিপুরে ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্পনসর (পৃষ্ঠপোষক) ছিল এই স্মিথ কো-জেনারেশন।

আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান

অবশ্য পিডিবি অর্থ বিভাগের ঋণ নেয়নি। সংস্থাটি নিজের তহবিল থেকে গত ২৩ মে ২৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কোম্পানিটি।

এই পাওনা টাকাকে কেন্দ্র করেই ২০২৪ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। জটিলতা এড়াতে তাঁরা দুজন পরে হোটেল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় (বাংলাদেশ হাউস) গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।’

ঘটনা শুরু যেভাবে

মূল ঘটনা ১৯৯৭ সালের অক্টোবরের। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার হরিপুরে বেসরকারি খাতে ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কো-জেনারেশন ইন্টারন্যাশনালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে দুটি চুক্তি করে বাংলাদেশ। কোম্পানিটির সঙ্গে পিডিবির একটি চুক্তি হয় ১৯৯৭ সালের ১৪ অক্টোবর। দুই দিন পর ১৬ অক্টোবর সরকারের সঙ্গে আরেকটি চুক্তি হয় বিদ্যুৎ কেনার (পিপিএ)।

চুক্তি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ১৯৯৮ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু কোম্পানিটি তা পারেনি। শর্ত ছিল নির্ধারিত দিন থেকে উৎপাদন করতে না পারলে দুই মাস মেয়াদ বাড়াবে সরকার, তবে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার মার্কিন ডলার করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কোম্পানিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তো দূরের কথা, কোনো নির্মাণকাজ করতে পারেনি; বরং আরও ৬ মাস ২০ দিন সময় চায়। সরকার তা না মেনে ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পিপিএ ও জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করে দেয়। শুধু তা–ই নয়, ব্যাংক নিশ্চয়তার (পিজি) ১৫ লাখ ডলারও নিয়ে নেয় পিডিবি।

সচিবালয়ে গত ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক থেকে মার্কিন কোম্পানিটিকে ২ কোটি ডলার দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। বিদ্যুৎসচিব ফারজানা মমতাজ এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এতে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কথা আসেনি। যদিও সম্প্রতি আলাদা এক চিঠিতে অর্থ বিভাগ এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।

বিদ্যুৎসচিবের সঙ্গে গত ১৫ মে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করে জানতে চাওয়া হয় যে যাঁদের কারণে বাংলাদেশকে এখন ২৪৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে, তাঁদের তিনি বাঁচিয়ে দিলেন কেন। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।

ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদবিষয়টি যেভাবে আদালতে গড়াল

অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে পাঠানো বিদ্যুৎসচিবের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটি ২০০০ সালে ঢাকার সাব জজ পঞ্চম আদালতে আরবিট্রেশন মিসকেইস (বিবিধ মামলা) এবং নারায়ণগঞ্জের সাব জজ প্রথম আদালতে আরেকটি আরবিট্রেশন বিবিধ মামলা করে। উভয় মামলাই আদালত খারিজ করে দেন। আদালতে মামলার পাশাপাশি কোম্পানিটি পরে পিপিএ বাতিল ও পিজি নগদায়নের বিরুদ্ধে আইসিসি আরবিট্রেশনে যেতে পিডিবিকে নোটিশ দেয়। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটিকে চিঠি দিয়ে জানায়, আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি হতে পারেন আরবিট্রেটর।

কিন্তু আইসিসি বিদেশে আরবিট্রেশন মামলায় অংশগ্রহণের জন্য ট্রাইব্যুনাল খরচ বাবদ নির্ধারণ করে ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা উভয় পক্ষকে সমানভাবে বহন করতে হবে। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার দিতে হবে অগ্রিম। অর্ধেক হিসেবে তখন পিডিবির খরচ করতে হতো অগ্রিমের ৬০ হাজার ডলার।

তখনকার পিডিবির পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ট্রাইব্যুনাল খরচের কোনো অর্থ দেবে না। পিডিবির তৎকালীন আইনজীবী প্যানেল একই পরামর্শ দেয়। আইনজীবীরা আরও মত দেন, দেশে আরবিট্রেশন আইন হয়েছে ২০০১ সালে। এর আগে আইসিসির আরবিট্রেশনের রায় বাংলাদেশের বাইরে কার্যকর হবে না। তাঁরা মামলায় পক্ষভুক্ত না হতে পিডিবিকে পরামর্শ দেন।

পরে একপক্ষীয় শুনানি শেষে আইসিসি আরবিট্রেশন আদালত ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর রায় দেন। রায়ে বলা হয়, পিডিবি বছরে ৪ শতাংশ সুদসহ মোট ১ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে।

রায় বাস্তবায়নের ছয় মামলা

আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়নে স্মিথ কো-জেনারেশন পরে ছয়টি মামলা করে। এগুলো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব অব কলাম্বিয়া, ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্ক, সুপ্রিম কোর্ট অব নিউইয়র্ক, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের কোর্ট অব সেশন, সুইজারল্যান্ডের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব বাডেন এবং ঢাকার আদালতে।

আইসিসির রায় বাস্তবায়নে ২০০৭ সালের ২০ জুলাই রায় দেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব কলাম্বিয়া। স্মিথ কো-জেনারেশন এ আদালতে বিষয়টি আবার উত্থাপন করে। এরপর ২০২৪ সালের ১৯ মে পিডিবির বিরুদ্ধে সংশোধিত চূড়ান্ত রায় দেন আদালত। এবারের রায়ে বলা হয়, পিডিবি ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার পরিশোধ করবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে। কোম্পানিটি তখন তার আইনি প্রতিষ্ঠান ডোয়ান মরিস এলএলপিকে বিষয়টি জানায়। কিন্তু রায় আর বাস্তবায়ন হচ্ছিল না।

বিষয়টি নিয়ে জানতে গত ২৮ মে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনিও কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর যে বিপদে পড়েছিলেন

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন যায় উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন একটি দল, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও ছিলেন। ২১-২৬ অক্টোবর (২০২৪) ছিল এ বার্ষিক সভা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপদেষ্টা ও গভর্নরের ওয়াশিংটন যাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে স্মিথ কো-জেনারেশন আরেকটি মামলা করে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায়। আদালত তখন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের জবানবন্দি নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু যেহেতু অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা আছে এবং তাঁরা পিডিবির সঙ্গে সম্পর্কিত নন, তাই তাঁরা জবানবন্দি দেননি।

স্মিথ কো-জেনারেশন তখন আবার আদালতে (যুক্তরাষ্ট্র) যায়। আদালত ২৫ অক্টোবর (২০২৪) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আহসান এইচ মনসুরকে আটক করে আদালতে নিয়ে আসতে ইউএস মার্শাল সার্ভিসকে নির্দেশ দেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা দুজন তখন আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সরকারি বাসভবনে। তাঁরা ছিলেন ওয়াশিংটন ডিসির ১০ নম্বর সড়কে অবস্থিত অ্যাম্বাসি স্টু হোটেলে। দূতাবাসের গাড়িতে করে তাঁরা ম্যারিল্যান্ডে রাষ্ট্রদূতের বাসায় চলে যান।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগ এলএলপিকে নিয়োগ দেয়। তারা আপিল করলে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা স্থগিত করেন এবং শুনানির দিন ধার্য করেন ২৮ অক্টোবর (২০২৪)। ফলি হোয়াগ এলএলপি বিষয়টি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতার আবেদন জানায় বিচারকের কাছে এবং বিচারক তা গ্রহণ করেন। এভাবেই অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর ওই যাত্রায় রক্ষা পান।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ৩০ জুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়।’

বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।নিষ্পত্তির পথ খুলল যেভাবে

মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায়কে ভিত্তি ধরে দেশে তখন গুরুত্বের সঙ্গে কাজ শুরু করেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর এ বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

এরপর স্মিথ কো-জেনারেশনের মধ্যস্থতাকারী, বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির কর্মকর্তা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান অনলাইনে ৫টি বৈঠক করেন। শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, জব্দ করা ব্যাংক নিশ্চয়তার ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হোক। বিপরীতে স্মিথ কো-জেনারেশন দাবি করে ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। আরও দাবি করে, মামলার খরচ বাবদ আরও ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার তাদের দিতে হবে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রস্তাবে কোম্পানিটিকে বলা হয়, ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান আইনের আওতায় বিদ্যুৎ খাতে তাদের বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। এতেও রাজি হয়নি স্মিথ কো–জেনারেশন। বাংলাদেশ পরে ১ কোটি ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়। স্মিথ কো-জেনারেশন তখন নতুন প্রস্তাব দেয়। সেটি হলো, এককালীন ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। অথবা ২ কোটি ৪০ লাখ ডলার ও দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে তারা মেনে নেবে।

বিষয়টি নিয়ে মধ্যস্ততায় থাকা বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে গত ২৬ মে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অবশ্য অর্থ বিভাগ ও পিডিবি সূত্র জানায়, পরে স্মিথ কো-জেনারেশন ২ কোটি ডলারে রাজি হয়। বাংলাদেশ সরকারও সিদ্ধান্ত নেয়, এই পরিমাণ অর্থ ওই কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে আগেই সম্মতি দিয়ে রেখেছিলেন (গত ১৮ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা। গত ২৮ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।

ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ‘দেশের বদনাম হলো’

১৯৯৬-৯৯ সময়ে পিডিবির চেয়ারম্যান ছিলেন নুরউদ্দিন মাহমুদ কামাল, তিনি ২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বর মারা যান। ১৯৯৯-০০ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক সচিব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক, যিনি মারা যান ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ২০০০-০২ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ মালেক, যিনি মারা যান ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।’

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ জীবিত থাকলে শাস্তি দিতে হবে। এমনকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবিরও শাস্তি পাওয়া উচিত। অর্থ বিভাগের পরামর্শ মেনে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত করা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ