১.

কয় দিন আগেই লিখেছিলাম, এই সরকারকে ৫ তারিখের পর চূড়ান্ত একটা ক্ষমতা দিয়েছিল মানুষ, সেই ক্ষমতা দিয়ে চাইলেই তারা দেশের জন্য এমন অনেক কাজ করতে পারত, যা আমাদের জন্য জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ ও অনেক দিনের আশা। তারা সেই কাজ করেনি, বরং বিপরীতে গিয়ে এমন কিছু কাজ করেছে, যা পপুলিস্ট এবং মানুষের উপরি চেতনাকে তুষ্ট করে।

অনেক দিন পর পালিয়ে যাওয়া হাসিনার ভাষণের কথা শুনে মানুষ এক হয়ে গেল দেখলাম। কিন্তু সেই এক হওয়াটাও কি জলে যাবে? মানুষ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি ভেঙে ফেলেছে। সারা রাত ধরে, এমনকি পরদিন দুপুর পর্যন্ত সেই বাড়ি ভাঙা হলো। এরপর কাজ কী এখন? কোনো কাজ নেই, সবাই যার যার মতে বাড়ি ফিরে, নিজের পুরোনো রাজনীতিতে ফিরবে। পুরোনো ও ক্লান্তিকর লড়াইয়ে আরও একবার নিজেদের শেষ করে দেবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।

যাঁরা এই ৩২ নম্বরের বাড়ির ভাঙার পক্ষে মত দিচ্ছেন, দেখলাম বলছেন, এই ৩২ শেখ হাসিনার আর তাঁর বাবার নিদর্শন, চিহ্ন; এই চিহ্নের বিনাশ না হলে আওয়ামী লীগের সত্যিকার বিনাশ হবে না।

২.

একই দিন খবরে প্রকাশ, সাংবাদিকসহ আয়নাঘর পরিদর্শনে যেতে পারছেন না প্রধান উপদেষ্টা। যদিও পরবর্তী সময় সিদ্ধান্ত হয় সংবাদমাধ্যমসহ শিগগিরই আয়নাঘর পরিদর্শনে যাবেন প্রধান উপদেষ্টা। এই আয়নাঘরে ১৫ বছর ধরে অনেক মানুষকে নির্যাতন–নিপীড়ন করা হয়েছে। অনেক মানুষ আয়নাঘর থেকে ফিরে আসেননি। এখনো আয়নাঘরে বন্দী থাকা ব্যক্তিদের আত্মীয়রা নানা জায়গায় সভা–সমাবেশ করেন, যাতে তাঁদের আত্মীয়কে ফিরে পান।

আয়নাঘর থেকে যাঁরা ফিরেছেন, ফিরতে পেরেছেন, তাঁরা বলেছেন, কী নির্মম নির্যাতন হয় সেখানে। কী অমানবিকভাবে মানুষকে রাখা হয় বছরের পর বছর ধরে। একজন র‍্যাবের সৈনিক বর্ণনা দিয়েছেন, কত বীভৎসভাবে সেখানে মানুষকে খুন করা হতো কেবলই মতাদর্শের বৈরিতার জন্য। হাসিনার পুরো সময়, বিশেষ করে শেষ দিকটায় মানুষ কথা বলতে, লিখতে ভয় পেত কেবল আয়নাঘরের জন্য। কেউ জানত না, কখন, কাকে, কীভাবে তুলে নেওয়া হবে, কেন তুলে নেওয়া হবে। হাসিনার ক্ষমতা সংহত করেছে এই নির্যাতন সেল। অথচ আমরা এই আয়নাঘরের বিস্তারিত এখনো জানতে পারিনি, হাসিনার বিদায়ের ছয় মাস পর এসেও।

৩.

পুরো সময়জুড়েই হাসিনাকে রক্ষা করে গেছে আমলাতন্ত্র আর পুলিশ বাহিনী। গদিতে টেকার জন্য হাসিনা একপাল আজ্ঞাবহ দাসানুদাস তৈরি করে গেছেন। যারা সরকার বোঝে না, বোঝে আওয়ামী লীগ। সেই দাসানুদাস পুলিশ বাহিনী জুলাইয়ে হত্যা করেছে হাজারো মানুষকে, আহত করেছে ১০–১২ হাজারেরও বেশি মানুষকে; তাঁদের মধ্যে হাজারো এমন মানুষ আছেন, যাঁরা চোখ হারিয়েছেন জীবনের জন্য, হারিয়েছেন হাত-পা।

দেশের আমলাতন্ত্রের জটিলতা তো সর্বজনজ্ঞাত একটা ব্যাপার, সেখানে কাজ হয় না। দীর্ঘসূত্রতা আছে। এসব আমলা মানুষকে মানুষ ভাবেন না, ভাবেন তাঁদের আজ্ঞাবহ। দুর্নীতিতে প্রায় ডুবে আছেন আমাদের অনেক আমলাই। সেখানে লালফিতার দৌরাত্ম্য যেমন আছে, আছে চূড়ান্ত অসহযোগিতা। গত সপ্তাহে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি জুলাইয়ে আহত দীপংকর বালার কথা আমরা অনেকেই জানি। তাঁর প্রতি কী আচরণ হয়েছে, তা ওঠে এসেছে পত্রপত্রিকায়। দীপংকরের পায়ে লোহা লাগানো, জুলাইয়ে গুলি খেয়ে পা এখন পচে যাওয়ার অবস্থা। তিন মাস আগে বিদেশ যাওয়ার কথা, সেটা পিছিয়ে গত সপ্তাহে হয়েছিল। বিমানবন্দরে গিয়ে দেখেন, তাঁর জন্য সাধারণ সিট। অথচ আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে, তিনি সাধারণ সিটে যেতে পারবেন না। তাঁর জন্য বিশেষব্যবস্থা লাগবে। সেই যাত্রায় তাঁর বিদেশযাত্রা হয়নি। দুই সপ্তাহ পর এখনো হয়তো হয়নি। অথচ পা পচে যাওয়ার দশা। জুলাইয়ের আহত ব্যক্তিদের সঙ্গেই এই আচরণ আমলাদের। সাধারণ মানুষের সঙ্গে না জানি কেমন এখনো!

অথচ আমরা পারতাম, ৫ আগস্টের পর গোটা আমলাতন্ত্রকে আগাপাছতলা সাজানো, গোছানো এবং নতুন করে ঠিক করতে। সেই আমলাতন্ত্র যেন আক্ষরিক অর্থে মানুষের জন্যই হয়। তাঁদের কাছে গিয়ে যেন হয়রানির শিকার না হতে হয়। যেন আমরা না দেখি, পুকুর কাটা শেখার জন্য ৩২ আমলার আফ্রিকা সফরের মতো অযথা রাষ্ট্রের খরচ।

৪.

হাসপাতালে এখনো অনেক ব্যক্তি ভর্তি, যাঁরা জুলাইয়ে আহত হয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসা হয়তো হচ্ছে, কিন্তু তাঁরা পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছেন না। একেকজন ঋণের দায়ে জর্জরিত। চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা খরচা জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অথচ রাষ্ট্র কোনো দায় নিচ্ছে না। আহত ব্যক্তিদের মানসিক পুনর্বাসন প্রয়োজন, সেই বিষয়েও নেই কোনো উদ্যোগ। শহীদের আত্মীয়রা পাচ্ছেন না যোগ্যতম সম্মান।

যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের এই অবধি একটা স্বচ্ছ তালিকা হয়নি, ছয় মাস চলে যাওয়ার পরেও। অথচ জুলাই নিয়ে বলতে গেলে সবাই প্রায় জুলাইয়ের মালিক সেজে বসেন। যেন সেই তাঁরাই একমাত্র জুলাইয়ের রক্ষক। অথচ জুলাইয়ের সবচেয়ে অপমান হচ্ছে তাঁদের দিয়েই।

এই যে আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে গিয়ে এত এত খুন, এত মানুষের অঙ্গহানি করল; তাদের বিচার পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু হয়েছে কি? অনেক মানুষকে জেলে ভরা হয়েছে, মামলাও দেওয়া হয়েছে অনেক; তাঁদের অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হবে, সেই অনুসন্ধান-তদন্ত-বিচারপ্রক্রিয়া কতটা এগোলো আসলে? আমাদের বিচার বিভাগের সংস্কার ছাড়া আদৌ কি তাঁদের বিচার করা সম্ভব?

৫.

গত ছয় মাসে এই অন্তর্বর্তী সরকার অনেক কিছুই করতে চেয়েছে। অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। অনেক নিয়োগ দিয়েছে, যেসব নিয়োগের কারণ, ধর্ম কিছুই আমরা জানি না। অনেক কিছুই হয়তো বদলাতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। না পারার কারণ হিসেবে দায় দিয়েছে সবার মধ্যে ঐক্য না থাকাকে। না হলে সবাই মিলে করে ফেলা যেত। আফসোস করছেন, নানা রাজনৈতিক দলকে দায় দিচ্ছেন উপদেষ্টা সমন্বয়কেরা।

অথচ হাসিনার ভাষণের ঘোষণা শুনেই পুরো দেশ এক হয়ে গেল, এই ঐক্যকে নিয়ে গেল একটা ভাঙচুরের দিকে। এই ভাঙচুর চলতে থাকলে কার কী লাভ হবে?

বিদ্যমান সংবিধান হাসিনাকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়েছিল। সেই সংবিধান সংস্কারের কী হবে, সংশোধন হবে নাকি, বাতিল হবে; হাসিনা সরকারের প্রেসিডেন্ট নিয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে, এমন অনেক কিছু নিয়ে এখনো প্রশ্ন থেকে গেছে।

এই মাফিয়া আমলাতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে, মানুষের জন্য যাঁদের দায় ও দরদ আছে, এমন আমলাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র গড়া যেত। শহীদের বিচার ও আহত ব্যক্তিদের যাতে পূর্ণ পুনর্বাসন হয়, সেই মর্মেও সরকারকে বাধ্য করা যেত। যেই আওয়ামী লীগের নিদর্শন ভাঙা হয়েছে, সেই আওয়ামী লীগই বিচার হলে শেষ হয়ে যেত। আলাদা করে নিদর্শন ভাঙতে হতো না।

কোন কাজ আমাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করা উচিত, সেটা বুঝতে পারাটাও আমাদের জন্য একটা বড় শিক্ষা। সেই শিক্ষা আমাদের হোক। এটাই মোনাজাত।

মীর হুযাইফা আল মামদূহ গবেষক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য আম দ র আওয় ম সরক র ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

সাজেকে নিহত খুবি শিক্ষার্থী রিংকীর মরদেহ নেওয়া হবে গাইবান্ধা

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের সেশনাল ট্যুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী মোছা. রুবিনা আফসানা রিংকীর মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে তার বাড়ি গাইবান্ধায় নেওয়া হবে।

এছাড়া শিক্ষার্থী নিহত ও আহতের ঘটনায় আজ বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক ঘোষণা করা হয়েছে। একই সাথে এদিন সকল ক্লাস-পরীক্ষাও বন্ধ রয়েছে। 

বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিষয়ক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. নাজমুস সাদাত এ তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থীদের সেশনাল ট্যুরের সময় রাঙামাটির সাজেক যাওয়ার পথে গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়। এতে পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মোছা. রুবিনা আফসানা রিংকী নিহত হন। দুর্ঘটনায় নিহত রুবিনা আফসানা রিংকির মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে তাদের বাড়ি গাইবান্ধায় নেওয়া হবে। এই দুর্ঘটনায় আরো কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আহত হয়েছেন। আহতদেরকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনজনকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হচ্ছে ।”

তিনি বলেন, “এই শোকাবহ ঘটনায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার গভীরভাবে মর্মাহত। আজ বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক ঘোষণা করা হয়েছে, সকল ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানের সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকবৃন্দ উপস্থিত আছেন। তিনি নিজে এবং সহকারী পরিচালকসহ কর্মকর্তারা খাগড়াছড়ি রওনা হয়েছেন।”

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদসহ সকল উপাসনালয়ে নিহত শিক্ষার্থীর আত্মার মাগফিরাত এবং আহতদের সুস্থতার জন্য বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনা করার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি। 

এদিকে, সাজেকে শিক্ষার্থী নিহত ও আহতের ঘটনায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সব ধরনের সেশনাল ট্যুর অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে কর্তৃপক্ষ। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার কাকলি রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষ ৪র্থ বর্ষ টার্ম-২ এর সেশনাল ট্যুরে অংশগ্রহণরত অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনায় একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে আরো কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। শিক্ষার্থীর এই অকাল মৃত্যুতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার গভীরভাবে শোকাহত এবং আহতদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সকল দূরপাল্লার সেশনাল ট্যুর স্থগিত করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করেছে কর্তৃপক্ষ।

উল্লেখ্য, রাঙামাটির বাঘাইছড়ির সাজেক পর্যটনকেন্দ্রে যাওয়ার পথে চান্দের গাড়ি পাহাড়ের খাদে পড়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহত হন। এসময় আহত হয়েছেন আরো ১১ জন। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে সাজেকের হাউসপাড়া এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। 

নিহত রুবিনা আফসানা রিংকী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। আহতরা সবাই একই বিভাগের শিক্ষার্থী।

ঢাকা/নুরুজ্জামান/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ