সম্প্রীতির মধুময় স্মৃতি মাঘী পূর্ণিমা
Published: 11th, February 2025 GMT
আজ শুভ মাঘী পূর্ণিমা। ফাল্গুনের লাল-নীলিমায় প্রকৃতি নব সাজে রূপান্তরের প্রাক্কালে আজকের মঙ্গলময় পুণ্য তিথিতে মহামানব বুদ্ধ নিজের আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করেছিলেন। বুদ্ধের প্রধান সেবক আনন্দকে বুদ্ধ বললেন, ‘আনন্দ- এ বৈশালী অত্যন্ত মনোরম স্থান।’ এখানকার উদ্যান চৈত্য, গৌতম চৈত্য, বহু পুত্রক চৈত্য বড়ই মনোরম ও মনোমুগ্ধকর স্থান। প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি যেমন চমৎকার, তেমনি প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদেও এসব এলাকা ভরপুর। বুদ্ধ আবার বললেন, ‘আনন্দ তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল স্বকীয় ঋদ্ধিবলে বর্তমান দেহ অবস্থান করতে পারেন।’ হে আনন্দ, তথাগতের চারি ঋদ্ধি পাদ ভাবিত, বহুলীকৃত রথগতি সদৃশ অনর্গল অভ্যস্ত, বাস্তুভূমি সদৃশ, সুপ্রতিষ্ঠিত, পরিচিত, সম্যকভাবে আপনার করায়ত্ত। আনন্দ, সে জন্য তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল কিংবা কল্পের অবশিষ্ট সময় অবস্থান করতে পারেন।
তথাগত বুদ্ধ কী বোঝাতে চাইলেন আনন্দ তা অনুধাবন করতে পারল না মারের দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়ায়। কিন্তু মার বিরামহীনভাবে বুদ্ধকে শুধু একটি কথাই বারবার বলেছেন, ‘হে সুগত, আপনি পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হোন, আপনার পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হওয়ার এখনই সঠিক সময়। ভগবান মারকে বললেন, হে পাপী মার যত দিন আমার ভিক্ষুসংঘ ত্রিপিটকের বাণীসমূহ সুন্দররূপে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, তত দিন পর্যন্ত তথাগত নির্বাণ লাভ করতে পারেন না। মার বলল, ‘ভন্তে ভগবান, আপনার ভিক্ষুসংঘ এখন ধর্ম প্রচারে সিদ্ধহস্ত ও নিপুণ। সুতরাং ভন্তে ভগবান আপনি নির্বিঘ্নে নির্বাণ লাভ করতে পারেন।’
পাপমতি মারকে ভগবান বললেন, হে পাপিষ্ঠা দুরাচার মার তাহলে শোন, অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তথাগত ভগবান বুদ্ধ তখনকার সময়ে যখন আশি বছর বয়সে পদার্পণ করেন, তখন রাজগৃহের বেলুরবনে পঁয়তাল্লিশ বর্ষা অর্থাৎ অন্তিম বর্ষা অধিষ্ঠান করেছিলেন। তিনি বর্ষা ব্রতকালীন কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। একমাত্র প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে সাধনা দ্বারা রোগমুক্ত হয়েছিলেন। যাকে ছন্দ, বীর্য, চিত্ত মীমাংসা বলা হয়।
ভগবান চাপাল চৈত্যে সেই সময় আজকের মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে স্মৃতিমান ও সচেতন অবস্থায় স্বীয় আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে এই বলে ঘোষণা দিলেন, এখন থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত আমার প্রাণবায়ু চলতে থাকুক, সজীব থাকুক, সচেতন থাকুক, অতঃপর নিরুদ্ধ হয়ে যাক। বুদ্ধ এ সংকল্প গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবলভাবে ভূকম্পন শুরু হয়। মুহুর্মুহু প্রলয়দেব গর্জন করতে থাকে।
এই ভূকম্পনে আনন্দ বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। এর হেতু কী জানতে আনন্দ দ্রুতগতিতে বুদ্ধের কাছে ছুটে যান এবং ভূকম্পনের কারণ জানতে চান। বুদ্ধ আনন্দকে বললেন, ‘শোন আনন্দ, বোধিসত্ত্ব যখন মাতৃজঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হন, তখন তার পুণ্যতেজে ভূকম্পন হয়, যখন বোধিসত্ত্ব সম্বোধি জ্ঞান লাভ করেন তার তেজে ভূকম্পন হয়, বুদ্ধেও প্রবর্তনকালে একবিংশ ভূমির প্রাণীগণের সাধুবাদ ধ্বনিতে ভূকম্পন হয়, আর যখন তথাগত আয়ু সংস্কার পরিত্যাগ করেন, তখন পৃথিবী কারুণ্যে কম্পিত হয়। তিনি যখন নির্বাণ লাভ করেন, তখন পৃথিবী রোধন ধ্বনিতে কম্পিত হয়ে থাকে।
হে আনন্দ, আমি সম্বোধি লাভের অষ্টম সপ্তাহে উরুবিল্ল গ্রামের অজপাল নিগ্রোধমূলে উপবিষ্ট ছিলাম। সে সময় পাপমতি মার এসে আমাকে বলল, ‘হে ভগবান, আপনি এখন পরিনির্বাণ লাভ করেন। আপনার এখন পরিনির্বাণ লাভের উপযুক্ত সময়।’ তখন আমি মারকে বলেছি, যত দিন আমার ভিক্ষু-ভিক্ষুনি, দায়ক-দায়িকা, উপাসক-উপাসিকারা যথার্থ ধর্মবেত্তা বিনীত বিশুদ্ধ জীবনযাপনের যোগ্যতা অর্জন না করে, যত দিন তারা সদ্ধার্মর ব্যাখ্যা ও বিস্তার করতে না পারেন, যত দিন আমার সদ্ধর্ম প্রভাবশালী ও বর্ধনশীল না হয়ে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ ও তাদের দ্বারা অভিনন্দিত ও পরিগৃহীত না হয়, তত দিন আমি নির্বাণ লাভ করতে পারি না। হে আনন্দ, অদ্য সেই পাপমতি মার চাপাল সেজে আমার কাছে এসে আমাকে পরিনির্বাণের আবেদন জানায়। মারের প্রশ্নের উত্তরে আমি যা তাকে বলেছি তাতে সে সন্তুষ্ট হতে পারল না।
মার আমাকে বলল, ভান্তে ভগবান, আপনার জীবনের ব্রত সমাপ্ত হয়েছে। আপনার দায়ক-দায়িকারা সবাই আপনার অতীত ধর্ম উপলব্ধি করেছে। আপনার প্রচারিত ধর্ম দেব-মনুষ্য সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং আপনি এখন পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হতে পারেন। হে আনন্দ, তখন আমি মারকে বলেছি, হে পাপমতি মার তুমি শোনে খুশি হও, তথাগত আজ থেকে তিন মাস পর পরিনির্বাণ লাভ করবেন। হে আনন্দ, আজ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বৈশালীর চাপাল চৈত্যে তথাগত কর্তৃক আপন আয়ু সংস্কার জেনে-শোনে পরিত্যক্ত হয়েছে।
আনন্দ বুদ্ধের মুখে এ কথা শোনে শোকে কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘ভন্তে ভগবান, কল্পকাল এ দেহে অবস্থান করুন। হে সুগত, বহুজনের সুখের জন্য, দেব-মনুষ্যগণের ঐহিক পারত্রিক হিত সুখ কামনায় কল্পকাল এ দেহে অবস্থান করুন।
তথাগত আনন্দকে বললেন, হে আনন্দ তুমি বৃথা ক্রন্দন করো না, আর কোনো আবেদনও জানিও না। কারণ এতে কোনো ফল লাভ হবে না। ভুল তুমি আগেই করেছ, এটি তোমার মারাত্মক অপরাধ। কারণ আমি তোমাকে আকার-ইঙ্গিতে এ কথা বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো, আমি যা তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম তুমি তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারনি।
এর আগে আমি তোমাকে যেখানে-যেখানে বারবার ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, সে জায়গাগুলো হলো রাজগৃহের গৃধ্রকূট পর্বত, রাজগৃহের গৌতম ন্যাগ্রোধমূলে, রাজগৃহের চৌরপ্রপাতে বেভার পর্বতে, সপ্তপর্ণী গুহায়, ঋষিগিলি পর্বতে, কালশীলায়, শীতবনে, সর্প সোন্ডিক গুহায়, তপোদারামে, বেণুবনে, কলন্দক নিবানে, জীবক আম্রবনে, মদ্রকুক্ষিতে ও মৃগদাবে। এসব স্থানের কোনোখানে একবারও তুমি আমার ইঙ্গিতের মর্ম বুঝতে পারনি এবং এ দেহে কল্পকাল অবস্থানের নিমিত্তে প্রার্থনাও করোনি।
ভগবান শোকগ্রস্ত আনন্দকে বললেন, ‘হে আনন্দ আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, আমাদের সব প্রিয় ও মনোহর বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখা যাবে না। হে আনন্দ, তথাগত যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তার অন্যথা কোনো অবস্থাতেই হবে না, এ জন্য দুঃখ করো না, এতে মনের যাতনা বাড়তে থাকবে। শান্ত হও, জীবের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করো।’
ভিক্ষুদের উদ্দেশে ভগবান বললেন, হে শিশুরা, আমি তোমাদের অভিজ্ঞাবলে যে ধর্মসমূহ উপদেশ দিয়েছি, সেগুলো তোমরা উত্তমরূপে আয়ত্ত করো এবং নিখুঁতভাবে আচরণ করো। সেসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করো এবং এসব বিষয় সর্বত্র প্রচার করো। এই নিষ্কলুষমূলক ধর্ম যাতে চিরকাল স্থায়ী হতে পারে এবং এ কারণে সব মহলে মঙ্গল হয়, সে মোতাবেক নিজেদের পরিচালিত করবে। এতে প্রাণিজগতের প্রতি অনুকম্পা ও দেব-মনুষ্যগণের হিতসুখ অনন্তকাল অটুট থাকবে।
হে ভিক্ষুরা, তোমরা জেনে রেখো সংস্কারসমূহ ক্ষয়শীল, অপ্রমদের সহিত নির্বাণ সাধনায়ব্রতী হও। অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণ লাভ করবেন। অর্থাৎ আজ থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমায় কুশীনগরের মল্লদের শালবনে তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন।
আজ দিনের কার্যসূচি শুরু হয়েছে ভোররাতে বিশ্বশান্তি কামনায় বিশেষ সূত্রপাঠের মাধ্যমে প্রতিটি বিহার থেকে। আজকের মাঘী পূর্ণিমা তিথিটা এমন সময়ে পালিত হচ্ছে, যখন বাংলাদেশসহ বিশ্ব এক মহাসংকটময় কাল অতিক্রম করছে। তবে বাংলাদেশের জনগণ সুখে দিনযাপনে অন্যান্য দেশের জনগণের চেয়ে অধিক গুণ এগিয়ে আছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায় আজ সারা দিন ধর্মীয় আবেশে পুলকিত থাকবেন। ধর্মীয় কার্যাদি এবং বুদ্ধপূজা উৎসর্গের পর বিকেলে প্রতিটি বিহারে ধর্মীয় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আজকের দিনের তাৎপর্য তুলে ধরে প্রাজ্ঞ ভিক্ষু সংঘসহ দায়ক-দায়িকারা অংশগ্রহণ করবেন। সন্ধ্যা তথা রাতে সম্মিলিত ধর্মীয় প্রার্থনার পর দিনের কার্যসূচির পরিসমাপ্তি ঘটবে।
আজকের শুভ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে সেই অতীতকালের কথাই স্মরণে আসছে। বুদ্ধ কালোগত হওয়ার আগে বুদ্ধের সঙ্গে মারের যেই কথা হয়েছিল, সেগুলো বুদ্ধ আনন্দের কাছে ইঙ্গিতে ব্যক্ত করা সত্ত্বেও আনন্দ বুঝতে পারেনি। এ ঘটনাবলিতে আমাদের জন্য শিখার অনেক কিছু আছে। বুদ্ধ সুনির্দিষ্ট পথ কিন্তু আমাদের জন্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নিজের কর্মগুণেই সৎ পথ পাওয়া যাবে। এতে কারো সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হবে না। নিজের জ্ঞানবলে এবং মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারলে দুঃখ নামক জীবনটা অপসারিত হয়ে সুখপাখি হাতের কবজায় চলে আসবে আপনা-আপনি।
এবারের মাঘী পূর্ণিমা এমন সময়ে উদ্যাপিত হচ্ছে যখন দেশের সাধারণ মানুষ নানা সমস্যা অতিক্রান্ত করছে। পরিবার পরিজন নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে থাকার অসম যুদ্ধে সকলে লিপ্ত । বুদ্ধ নির্দেশিত সব বাণী মানবের জন্য খুবই মঙ্গলদায়ক। তাই বলছিলাম, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে যার ধর্ম পালনে নিবিষ্ট হতে পারলে দেশ অচিরেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাব এবং পাশাপাশি দেশ সমৃদ্ধি লাভ করবে। আজকের শুভ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে সবাইকে জানাই লাল গোলাপ শুভেচ্ছা। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
শতদল বড়ুয়া সাংবাদিক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ন র ব ণ ল ভ ন র ব ণ ল ভ কর আম দ র ত হয় ছ র জন য দ ন আম পর ত য যত দ ন আনন দ বলল ন আজক র আপন র ন করত
এছাড়াও পড়ুন:
শুল্ক কমেছে, বাংলাদেশে স্বস্তি
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশের ওপর দেশটির আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসের এক ঘোষণায় এ কথা বলা হয়। বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কহার কমে প্রতিযোগীদের কাছাকাছি অবস্থানে আসার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক।
২৯ জুলাই থেকে তিন দিনের আলোচনা ও দর-কষাকষির শেষ দিন ৩১ জুলাই এ ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭০টি দেশের ওপর ১০ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসে।
পাল্টা শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ নামিয়ে আনতে বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকেও বেশ কিছু সুবিধা দিতে হয়েছে। একদিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পান গত ২১ জানুয়ারি। এর দুই মাস পর গত ২ এপ্রিল হঠাৎ বিশ্বের ৭০ দেশের জন্য বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। অনেকেই ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে একধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলে সমালোচনা করেছেন।
প্রথমে গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা হয় ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক। মাঝখানে তিন মাস স্থগিত রাখার পর ৮ জুলাই তা কমিয়ে ট্রাম্প ৩৫ শতাংশ করেন। বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ করায় মোট শুল্কহার দাঁড়াবে এখন ৩৫ শতাংশে।
দর-কষাকষির মাধ্যমে ঘোষিত শুল্কহার কমিয়ে আনাকে ঐতিহাসিক চুক্তি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের আলোচকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে আলোচনা করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন আলোচকদের মধ্যে আরও ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে বলেছে, অনেক বিষয় জড়িত থাকায় শুল্ক আলোচনার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয়টি শুধু শুল্ক কমানোর সঙ্গেই যুক্ত ছিল না; বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্যঘাটতি ও নিরাপত্তা–সংক্রান্ত মার্কিন উদ্বেগও ছিল এর সঙ্গে। সমাধানের বিষয়টি নির্ভর করছিল একটি দেশের সদিচ্ছার ওপরও।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা গতকাল প্রথম আলোকে জানান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকব এবং যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আমরা ২০ শতাংশের নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম।’
প্রতিযোগী দেশগুলোর শুল্কহারযুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
বাংলাদেশের সমান ২০ শতাংশ ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কা এবং ১৯ শতাংশ হার নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কম রয়েছে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের হারও ১৯ শতাংশ। তাইওয়ানের ওপর ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ; জাপান, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৪১ শতাংশ শুল্কহার সিরিয়ার ওপর। বেশি হার আরোপ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে লাওস ও মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ; সুইজারল্যান্ডের ওপর ৩৯ শতাংশ; ইরাক ও সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ এবং লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিচ্ছে বাংলাদেশসরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেশন পুরোপুরি মেনে চলারও অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে দেশটি থেকে দাম বেশি দিয়ে হলেও বছরে সাত লাখ টন করে গম কেনা হবে পাঁচ বছর ধরে। ইতিমধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি।
দেশটি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আগে থেকেই আমদানি করা হচ্ছে। তা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৯ থেকে ১১ জুলাই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সফল না হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে, সেসব পণ্যের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ১৭ থেকে ২৩ জুলাই সপ্তাহব্যাপী অনলাইনে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়েই তিনি বৈঠকগুলো করেন।
গত ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (প্রকাশ না করার চুক্তি) করার কারণে সরকারি প্রতিনিধিদলে অন্য কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ভেতরে-ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
সরকারের আহ্বানে সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে। এসব সভায় তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেন তাঁরা। বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ১৩ কোটি ডলারে ৩ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রায় ১০ কোটি ডলারের সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
এ ছাড়া ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ১৯ হাজার টন তুলা আমদানির সমঝোতার চুক্তি করেছে বস্ত্র খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কার্গিল ইনকরপোরেটের কাছ থেকে এশিয়া কম্পোজিট ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে ৬ হাজার টন আমদানির এমওইউ করেছে। একই দরে একই পরিমাণ তুলা আমদানির এমওইউ করেছে সালমা গ্রুপও। এ ছাড়া মোশাররফ গ্রুপ মার্কিন লুইস ড্রেফাস গ্রুপ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ৭ হাজার টন তুলা আমদানির এমওইউ করেছে।
কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ২০ শতাংশ শুল্কহার ঠিক করতে পেরেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, এটাই হচ্ছে প্রধান কারণ।’
ট্রেড ইউনিয়ন, মজুরি, শ্রমিক নিপীড়ন, মামলা—এসব বিষয় আলোচনায় উঠেছিল কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে। শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখতে জোর দিয়েছে তারা। আমরা আইএলও কনভেনশন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ জন্য শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চলছে।’
‘অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা’ওয়াশিংটনে দর-কষাকষিতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টা শুল্ক কমার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, তাতে বাংলাদেশ বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে রেহাই পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘সময়সীমার মধ্যেই জটিল আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। নইলে ৩৫ শতাংশের গুরুভার বহন করে যেতে হতো।’
খলিলুর রহমান আরও বলেন, প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান অথবা যত্সামান্য বেশি এবং ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য এখন প্রতিযোগিতামূলক থাকবে। তৈরি পোশাকশিল্প ও এর ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টার উদ্দেশে ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় তিনি (শেখ বশিরউদ্দীন) সমালোচকদের হতাশ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আল্লাহ তাঁকে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, যাতে তিনি দেশকে সেবা দিতে পারেন, হোক তা সরকারে বা বেসরকারি খাতে।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। তবে আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই, বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্যকৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির প্রথম আলোকে বলেন, একটি বিশ্বশক্তির চাপের মুখে এই সাফল্য অর্জনের জন্য সরকার ও আলোচক দলের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন। এটি সম্ভবত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে কঠিন লড়াইগুলোর একটি ছিল, যা পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন তাঁরা।