আদালতে দেওয়া তালিকায় বন্ধ, অথচ চালু এক-তৃতীয়াংশ ইটভাটা
Published: 12th, February 2025 GMT
আদালতের নির্দেশে বন্ধ করে দেওয়া ইটভাটার একটি তালিকা হাইকোর্টে জমা দিয়েছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন। কিন্তু তালিকার ১৬০ ইটভাটার মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চালু রয়েছে। ইট পুড়িয়ে পরিবেশদূষণ করেই চলেছে এসব ভাটা।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) রিটের পর চট্টগ্রামসহ সারা দেশের অবৈধ ইটভাটা বন্ধের জন্য ২০২২ সালে প্রথম আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। গত বছরের ২৮ নভেম্বরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধসংক্রান্ত সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট অপর একটি আদেশ দেন। এতে দেশের আট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে থাকা অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম যাতে শুরু না করতে পারে, সে বিষয়ে সাত দিনের মধ্যে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয় বিভাগীয় কমিশনারদের। পাশাপাশি কার্যক্রম ও পদক্ষেপ জানিয়ে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়।
গত জানুয়ারিতে বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন বন্ধ ইটভাটার একটা তালিকা জমা দেন হাইকোর্টে। ১৫ উপজেলার ১৬০টি অবৈধ ইটভাটা প্রশাসনের অভিযান ও হস্তক্ষেপে বন্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়ে তালিকা জমা দেওয়া হয়।
অনুসন্ধান ও সরেজমিন দেখা যায়, তালিকায় থাকা ইটভাটার এক-তৃতীয়াংশের বেশি বর্তমানে চালু রয়েছে। তালিকায় লোহাগাড়ার ২৮টি ইটভাটার উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি ইটভাটার নাম দুবার করে এসেছে। তালিকায় থাকা ইটভাটার মধ্যে ১৩টিতে এখনো ইট পোড়ানো হচ্ছে।
লোহাগাড়ার যেসব ইটভাটা তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, এর মধ্যে গত বছরের ১৪ নভেম্বর তিনটি ইটভাটা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল প্রশাসন। ইটভাটাগুলো হলো উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের সিবিএম, আমিরাবাদ ইউনিয়নের বিএবি এবং চরম্বা ইউনিয়নের এবিএম। শেষ দুটি ইটভাটা পুনরায় চিমনি বসিয়ে চালু করা হয়েছে। উপজেলায় চালু থাকা অন্যান্য ইটভাটাগুলো হলো পদুয়ার মজিদিয়া ব্রিকস, শাহ মজিদিয়া ব্রিকস, পদুয়া ব্রিকস, কলাউজানের পেঠানশাহ ব্রিকস, খাজা ব্রিকস, চরম্বার এস এমবি ব্রিকস, এসবিএন ব্রিকস, আমিরাবাদের শাহপীর ব্রিকস, মদিনা অটো ব্রিকস, বড় হাতিয়ার আখতারাবাদ ব্রিকস, বারআউলিয়া ও আরব ব্রিকস।
অন্যদিকে রাউজানের আটটি ইটভাটা হাইকোর্টে জমা দেওয়া তালিকায় রয়েছে। তার মধ্যে পৌরসভার দুটি ইটভাটা ছাড়া বাকি ছয়টিতে ইট পোড়ানো চলছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। হাটহাজারীতে ২২টির মধ্যে কয়েকটি ইটভাটা চালু রয়েছে। চন্দনাইশের ১৬টি এবং সাতকানিয়ার ৩৪টি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে তালিকায় উল্লেখ করা হয়। কিন্তু দুই উপজেলায় এসব ভাটার অর্ধেকেই এখন ইট পোড়ানো হচ্ছে। একইভাবে ফটিকছড়ি, আনোয়ারা, বাঁশখালী, পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালী উপজেলার অনেক ইটভাটা তালিকায় রয়েছে। কিন্তু তার অনেকটি চালু।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো.
লোহাগাড়ার ইউএনও মোহাম্মদ ইনামুল হাছান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চলমান। বন্ধ করে দেওয়া তালিকার দু–একটি হয়তো চালু করেছে। আমরা আবারও অভিযান করব।’
এইচআরপিবির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগে বন্ধ করা কিছু ইটভাটার নাম আবার নতুন তালিকায় এসেছে। আবার কিছু কিছু ইটভাটা পুনরায় চালু করার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি অব্যাহত রয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইটভ ট র ইট প ড় র একট প রথম উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।