হাসিনা সরকারের আমলে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ঘনিষ্ঠ আমলাদের নেতৃত্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল দুর্নীতির জাল। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে আইসিটি বিভাগ থেকে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে এই চক্রের বিরুদ্ধে। এখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তারা একই কায়দায় লুটপাটের ছক কষছে। আইসিটি বিভাগ, বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং তদন্তকারী সূত্রগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

অভিযোগ রয়েছে, আমলাদের কেউ কেউ আগে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন। কেউ কমিশন, নিয়োগ বাণিজ্য দেখভাল করতেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও চক্রের সদস্যরা আছেন বহাল তবিয়তে। ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো পদোন্নতি ও বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

ডিজিটাল প্রতারণায় পুরোনো সিন্ডিকেট 

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প ও দপ্তরের কার্যক্রম থেকে গত ১০ বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে তথাকথিত পলক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। পুলিশ রিমান্ডে পলক তাঁর নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট সদস্যদের নাম প্রকাশ করেন। তারা হাই-টেক পার্কের দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন।

সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে পলক জানিয়েছেন, হাই-টেক পার্কের দুর্নীতিতে তাঁর সঙ্গে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন সাবেক এমডি বিকর্ণ কুমার ঘোষ, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সাবেক পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) তবিবুর রহমান, হাই-টেক পার্কের ১২ আইটি প্রকল্পের পরিচালক এ কে এ এম ফজলুল হক।

এই সিন্ডিকেটে সহযোগিতাকারী হিসেবে পলকের স্কুলবন্ধু ও তাঁর সাবেক পিএস আবদুল বারি, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক (সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, চট্টগ্রাম) নরোত্তম পাল, জনসংযোগ কর্মকর্তা (হাই-টেক পার্ক, কালিয়াকৈর, গাজীপুর) গোলাম কিবরিয়া, উপপরিচালক (পরিকল্পনা) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পিএসের দায়িত্ব পালনকারী শফিক উদ্দিন ভূঁইয়া এবং হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকো-সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট নুরুল ইসলামের নামও এসেছে।

জানা গেছে, পলকের অর্থের মূল জোগানদাতা নুরুল ইসলাম রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও সক্রিয়। কারওয়ান বাজারে ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক-২ (স্মার্ট টাওয়ার) নির্মাণে ঠিকাদার স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্সকে কাজ দিতে পলকের নির্দেশে তাদের সুবিধামতো শর্তাবলি ও স্পেসিফিকেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।

হাই-টেক পার্ক ঘিরে দুর্নীতি

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য মিলেছে। তদন্ত কমিটি বিভিন্ন প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত অপচয়, অসংগতি, দুর্বলতা, আর্থিক ক্ষতি, অসম চুক্তি, সুবিধাভোগী নির্বাচনে অসচ্ছলতা, জনবল নিয়োগে অনিয়ম, অনৈতিকতা, একই কাজ বারবার করার মতো বিভিন্ন বিষয় চিহ্নিত করেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন এবং অন্যান্য নির্মাণ প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করায় অর্থের অপচয়, অধিক ভূমি উন্নয়ন ব্যয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করে মোটা অঙ্কের টাকা অপচয় করা হয়েছে।

জেলা পর্যায়ে আইটি বা হাই-টেক পার্ক স্থাপন প্রকল্পে (১২ জেলায়) দরপত্রের একমাত্র বিডার থাকার পরও কার্যাদেশ দিতে ছয় মাস দেরি করা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের শুরুতেই পরিচালক ফজলুল হক পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে কাজ করাতে শুরু করেন, যাদের দক্ষতা নিয়ে পরবর্তী সময়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। প্রকল্পটি নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার কেরানীগঞ্জের নলেজ পার্ক নির্মাণকাজে নিম্নমানের বালুর ব্যবহার, নির্মাণকাজের শাটারিংয়ের ক্ষেত্রে স্টিল ব্যবহার, বিলবোর্ড বা ব্যানার খাতে নানা অনিয়ম দেখা গেছে। 

প্রকল্পটিতে ১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোর বিষয়ে পরিচালক এ কে এ এম ফজলুল হক জানিয়েছেন, বাড়তি বাজেটের মধ্যে ১ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা ভ্যাটের জন্য। আগে প্রকল্পে ভ্যাটের টাকা ধরা ছিল না। শর্ত অনুযায়ী, ৬৫ শতাংশই ভারত থেকে আমদানি করতে হচ্ছে, তাই ভ্যাট দিতে হচ্ছে।

কারও কথা কর্ণপাত করতেন না বিকর্ণ 

বিকর্ণ কুমার ঘোষ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উচ্চ বাজেটের প্রকল্প হাই-টেক পার্কের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি পলকের অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত। ইনফো-সরকার প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি সামিট গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিয়ে কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর প্রকল্পের বিষয়ে সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাগাভাগির ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
অভিযোগ রয়েছে, নিউইয়র্কে সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কনসার্ট ও রোড শো আয়োজনের ক্ষেত্রে শর্ত লঙ্ঘন করে চুক্তির পুরো টাকা ঠিকাদারকে আগেই দেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর হাত ছিল। হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের আয়োজনে পরিচালিত এই শোতে শতকোটি টাকার চাঁদাবাজি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন সময় পলকের অর্থ পাচারের সঙ্গে বিকর্ণের আরও দুই সহকারীর নাম উঠে আসে। তারা হলেন গোলাম কিবরিয়া ও নরোত্তম পাল। তবে এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে কোনো বক্তব্য দেননি বিকর্ণ কুমার ঘোষ।

দুর্নীতির বরপুত্র তবিবুর

পলকের দুর্নীতির প্রধান হোতা তবিবুর রহমান। দীর্ঘকাল আইসিটি বিভাগের উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা এই কর্মকর্তা পলকের আজ্ঞাবহ হয়ে হাই-টেক পার্কের পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) হিসেবে ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর যোগ দেন। জয়-পলকের সহযোগী হিসেবে এনআইডির তথ্য পাচারের ২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি হলেও এখনও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সমকাল।

অন্ধকার জগতের সঙ্গী গোলাম কিবরিয়া 

হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের জনসংযোগ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া প্রশাসন বিভাগের সহকারী পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। পলকের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এই কর্মকর্তা নানা অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কনসার্টের নামে হাই-টেক পার্কের প্লট নেওয়া কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া হাই-টেক পার্ক ও অন্যান্য প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্য, হাই-টেক পার্কের সব প্রকল্পের বিজ্ঞাপন ও প্রকাশনার কমিশন বাণিজ্য, গাড়িচালকের সঙ্গে যোগসাজশে তেলের হিসাব নয়ছয় এবং প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। 

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ মার্চ গোলাম কিবরিয়াকে সিলেট হাই-টেক পার্কে বদলি করা হয়। তবে প্রভাব খাটিয়ে কিবরিয়া ছয় মাস পরই ২৯ সেপ্টেম্বর বদলির আদেশ পরিবর্তন করে গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্কে চলে আসেন। সেখানে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও তিনি নিয়মিত অফিস না করে খাতায় সই করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া প্রভাব খাটিয়ে কিবরিয়া সরকারি জিও নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ‘গোল্ডেন জুবিলী বাংলাদেশ কনসার্টে’ গিয়ে ডিড প্রকল্প থেকে ১৪ দিনের জন্য ৩ হাজার ৩৪৯ ডলার বা ৪ লাখ ৮ হাজার ৬৩৯ টাকা তুলে নেন। 

নরোত্তম পালের কমিশন নিয়ন্ত্রণ 

হাই-টেক পার্কের দুর্নীতির আরেক কারিগর নরোত্তম পাল স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মাশরুর আলম মিলনের সহযোগী ছিলেন। রাজশাহী কলেজে পলকের শিক্ষক নৃপেন্দ্র নাথ পালের ছেলে হওয়ায় নরোত্তম ২০১৪ সালে হাই-টেক পার্কে সহকারী প্রকৌশলী (ই/এম) পদে নিয়োগ পান। সেই সময় এমডি হোসনে আরাকে চাপ দিয়ে নরোত্তম পালকে নিয়োগ দিতে বাধ্য করেন পলক। 

জানা যায়, হাই-টেক পার্কের শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন প্রকল্পের (১১ আইটি) প্রায় ৮০০ কোটি টাকার কাজ ডিপিএম দরপত্র পদ্ধতির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রহমান ট্রেডার্স লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরাও সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে কাজ করছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন পলক। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নরোত্তম পাল সমকালের সঙ্গে কথা বলতে চাননি।

গবেষণা না করেও কর্মকর্তা 

ছাত্রলীগ কর্মী শফিক উদ্দিন ভূঁইয়া। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর হাই-টেক পার্কের গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। লিখিত পরীক্ষায় নবম হলেও ছাত্রলীগের পরিচয়ে কিশোরগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য ডা.

সৈয়দ লিপি ও হাই-টেক পার্কের সাবেক পরিচালক সৈয়দ এমদাদুল হকের মাধ্যমে তিনি এই পদ বাগিয়ে নেন। অভিযোগ রয়েছে, শফিক হাই-টেক পার্কের সদ্য বিদায়ী এমডি জিএসএম জাফরউল্লার সময়ে অনিয়ম, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি ও নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। 
হিসাব অফিস সূত্রে জানা যায়, তিনি গত অর্থবছর আপ্যায়নের নামে ৩৮ লাখ টাকার বিল তুলেছেন, যা হিসাব শাখার নথিপত্র পর্যালোচনায় ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এ ছাড়া বর্তমানে এমডি আমিরুল ইসলাম একজন অতিরিক্ত সচিব। আইন অনুযায়ী তাঁর পিএস পাওয়ার কথা নয়। তবু তিনি হাই-টেক পার্কের রিসার্চ অফিসার শফিক উদ্দিন ভূঁইয়াকে পিএস হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। প্রকৌশলী না হয়েও সম্প্রতি আমিরুল ইসলাম তাঁকে প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালকের (পরিকল্পনা) দায়িত্বও দিয়েছেন, যা নিয়মের বড় ধরনের ব্যত্যয়।

সম্প্রতি মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পার্ক কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত না করে অতিরিক্ত অনুদান নেওয়ার ফলে বড় অনিয়ম ঘটেছে। 

এ বিষয়ে জানতে এ কে এম আমিরুল ইসলামকে বারবার ফোন করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়েও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, হাই-টেক পার্কের কিছু প্রকিউরমেন্টে মনোপলির অভিযোগ রয়েছে। ইনফো-সরকারের তিনটি ফেজে অনিয়ম হয়েছে বলে তথ্য আছে। ইনফো-সরকার প্রকল্পে বিটিসিএল ছাড়াও ফাইবার অ্যাট হোম ও সামিট কমিউনিকেশন্স কাজ করেছে। আমরা রাষ্ট্রের অর্থ ও সম্পদ রক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় অংশ কেটে দিচ্ছি।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব ভ ন ন প রকল প গ ল ম ক বর য় র ল ইসল ম র প রকল প প রকল প র ব যবস থ মন ত র ব কর ণ পর চ ল র পর চ ক জ কর আইস ট সরক র তদন ত সহয গ রহম ন পলক র

এছাড়াও পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে

সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।

এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’

আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ