সরানো হলো বাদ্যযন্ত্র ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নিষিদ্ধের নোটিশ
Published: 19th, February 2025 GMT
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ফলসী ইউনিয়নের শড়াতলা গ্রামে বাদ্যযন্ত্র, হকার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নিষিদ্ধ করে দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো সব নোটিশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওই গ্রাম পরির্দশনে যান। এর পর সেখান থেকে নোটিশগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। পরে নোটিশে সই করা ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন ইউএনওর কার্যালয়ে গিয়ে ভুল স্বীকার করেন।
শড়াতলা গ্রামের কয়েক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় দুই মাস আগে গ্রামের কিছু যুবক উচ্চ স্বরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অনুষ্ঠান করছিল। পাশেই অসুস্থ এক বৃদ্ধ এতে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তাই গ্রামের কয়েকজন ওই যুবকদের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে নিষেধ করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। ঘটনার পর আলোচনা করে সমাজপতিরা সিদ্ধান্ত নেন, গ্রামে বাদ্যযন্ত্র, হকার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না।
শড়াতলা মসজিদ কমিটির সভাপতি এনামুল হকের নেতৃত্বে গ্রামের মসজিদে বসে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ২৫ দিন আগে গ্রামের অন্তত ১০টি দোকানে ও কয়েকটি বাড়ির দেয়ালে ১০০ টাকা মূল্যের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের ফটোকপি সাঁটানো হয়।
নোটিশের শেষ অংশে ‘গ্রামবাসীর পক্ষে’ ১৮ জন সই করেছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি, শিক্ষক ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। নোটিশে সইয়ের অংশের প্রথমে হাতে লিখে ইউএনওর সরকারি নম্বরও দেওয়া হয়।
সই করা ১৮ জনের মধ্যে রয়েছেন– শড়াতলা পশ্চিম পাড়া মসজিদ কমিটির সভাপতি ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এনামুল হক, শড়াতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাশিউর রহমান, স্থানীয় দোকানি সাজেদুল, শিক্ষক আবু সালেহ, হরিণাকুণ্ডু কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ কমিটির সাবেক সভাপতি লিয়াকত আলী, ফলসী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা (পদ নেই) তৌহিদুর রহমান টুটুল, ১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মোহাব্বত আলী, বলরামপুর দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুল মালেক, সালেহা বেগম মহিলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক ও স্থানীয় বিএনপি নেতা (পদ নেই) ইন্তাজুল হক, ফলসী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান, তাঁর ভাই ব্যবসায়ী নজরুল মোল্লা, ওয়ার্ড বিএনপির কর্মী ও দলিল লেখক আজিম উদ্দিন, শড়াতলা জামে মসজিদের সাবেক সভাপতি ও জামায়াত কর্মী সুলতান, আওয়ামী লীগ সমর্থক ও দোকানি মশিউর, আওয়ামী লীগের সমর্থক ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা, বলরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল ফাত্তাহ (রুমি)।
বাদ্যযন্ত্র, হকার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে গতকাল সমকালসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর তৎপর হয়ে ওঠে প্রশাসন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শড়াতলা গ্রামে যান ইউএনও বি এম তারিক-উজ-জামান। সেখানে তিনি নোটিশে সই করা ব্যক্তিদের খোঁজ করেন। তাদের কাউকে না পেয়ে কার্যালয়ে ফিরে হরিণাকুণ্ডু থানা পুলিশকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে বাদ্যযন্ত্র, হকার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ করে সাঁটানো নোটিশে সই করা ব্যক্তিদের ইউএনও কার্যালয়ে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পর সই করা ১৮ জনের মধ্যে চারজন বিকেল ৩টার দিকে সেখানে যান। তাদের সঙ্গে গ্রামের আরও চারজন ছিলেন।
জানা গেছে, নোটিশে সই করা চারজন ইউএনওর কাছে ভুল স্বীকার করেন। ইউএনও তাদের নির্দেশ দেন, বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে ১৮ জনকেই হাজির হতে হবে এবং এ ঘটনার লিখিত ব্যাখ্যা দিতে হবে। এর পর তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।
ইউএনও কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘আমি চাপে আছি’। সেখানে থাকা মসজিদ কমিটির সভাপতি এনামুল হক বলেন, ‘আমরা অনেকেই এই ঘটনার সময় বৈঠকে ছিলাম। তবে এটা করা আমাদের ভুল হয়েছে।’
শড়াতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাশিউর রহমান বলেন, ‘বিধিবহির্ভূত কাজের সঙ্গে থাকা আমার ঠিক হয়নি।’
জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনন্দ কিশোর সাহা বলেন, উপজেলা প্রশাসন তদন্ত করে সত্যতা পেলে জড়িত শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ফলসী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা এ ধরনের ঘটনা সমর্থন করি না। সমর্থক-কর্মীদেরও বলে দিয়েছি, এ ধরনের কাজ করা যাবে না। ইউএনও কার্যালয়ে যাওয়ার আগে কয়েকজন আমাদেরও তাদের সঙ্গে যেতে বলে। কিন্তু আমরা জানিয়ে দিয়েছি, এ ধরনের আইনবিরোধী কাজে সহযোগিতা করতে পারব না।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলা জামায়াতের আমির বাবুল হোসেনের দাবি, শড়াতলার ঘটনার সঙ্গে তাদের দলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
ইউএনও তারিক-উজ-জামান বলেন, শড়াতলা গ্রামের ঘটনাটি জানার পর থেকেই পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। আমরাও কাজ করছি। এরই মধ্যে সব নোটিশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নোটিশে আমার যে নম্বর দেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে থানায় জিডি করা হয়েছে। ঘটনা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব দ যযন ত র র রহম ন ব যবস থ হক র ও সরক র উপজ ল ব এনপ আওয় ম ঘটন র
এছাড়াও পড়ুন:
ফেস্টুন অপসারণ করায় ইউএনওকে শাসালেন বিএনপি নেতা
ফেস্টুন অপসারণ করায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়সাল আহমেদকে শাসিয়েছেন এক বিএনপি নেতা। তিনি ইউএনওকে আগের স্থানেই ফেস্টুন লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, “তা না হলে যেটা করা দরকার, সেটাই করব।”
এই বিএনপি নেতার নাম কে এম জুয়েল। তিনি রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুলে তার বাড়ি।
গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের সড়ক বিভাজকে থাকা বিভিন্ন দলের ফেস্টুন অপসারণ করেন ইউএনও ফয়সাল আহমেদ। বিষয়টি জানতে পেরে ইউএনওকে ফোন করে ধমকান জুয়েল।
কে এম জুয়েলের ফোনকল রেকর্ড পাওয়া গেছে। এতে শোনা গেছে, কে এম জুয়েল বলেছেন- “আজকে একটা ঘটনা ঘটেছে, আমি শুনেছি। আমি ইঞ্জিনিয়ার কে এম জুয়েল বলছি, সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট। আপনার গোদাগাড়ী থানার প্রোপারে যে পোস্টার সরিয়েছেন, এই বিষয়ে কিছুক্ষণ আগে আমাকে ইনফর্ম করা হয়েছে। সেখানে আমার পোস্টার ছিল। জামায়াত-বিএনপির পোস্টার ছিল। আপনি যে হটাইছেন, এর কারণ কী? কোনো পরিপত্র আছে, না ইচ্ছে করেই?”
ইউএনও তখন বলেন, “জনগণ অভিযোগ দিয়েছে।” জুয়েল বলেন, “জনগণ তো অনেক অভিযোগ দিয়েছে। সমগ্র গোদাগাড়ী থানাতে ভর্তি হয়ে আছে পোস্টার। তোলেন, সব তোলেন।”
এ সময় ইউএনও কিছু বলতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিয়ে জুয়েল বলেন, “শোনেন, আমি যেটা বলছি লিগ্যাল রাইট নিয়ে বলছি, সেটার সঠিক অ্যানসার করবেন। আপনি কেন ওই জায়গার পোস্টার তুলেছেন, আর অন্য জায়গার তুলছেন না কেন? আমি ঢাকাতে আছি, আমি আসতেছি।”
ইউএনও বলেন, “আচ্ছা ঠিক আছে।” জুয়েল বলেন, “না, আপনি যেখান থেকে পোস্টার তুলেছেন, সেখানে আপনি সাবমিট করবেন পোস্টার।” কথা না বাড়িয়ে ইউএনও বলেন, “ঠিক আছে।”
এ সময় আরো ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপি নেতা জুয়েল বলেন, “কালকে যেন আমরা ওখানে দেখতে পাই, পোস্টার যেখানে ছিল। ঠিক আছে মানে কী? অবশ্যই করবেন। না হলে যেটা করা দরকার সেটাই করব। আপনার এগেইনেস্টে যেরকম স্টেপ নেওয়া দরকার, সেটাই আমি করব। বিশেষ করে আমরা করব। আমার নেতার ছবি তুলেছেন আপনি ওখান থেকে। জাস্ট রিমেম্বার ইট।”
জুয়েল বলতে থাকেন, “নরসিংদী বাড়ি দেখান আপনি, না? কোন দল থেকে আসছেন আপনি? কোন দল থেকে এসেছেন? কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেছেন আপনি? কালকে পোস্টার ভদ্রলোকের মতো লাগাবেন। ফাইজলামি! এহ, বিশাল ব্যাপার। উনি টিএনও হয়ে গোদাগাড়ীতে আসছেন।”
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইউএনও ফয়সাল আহমেদ বলেন, “ডাইংপাড়া মোড়ে ব্যানার-ফেস্টুন এরকম পর্যায়ে ছিল যে, যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল। পাশাপাশি পৌরসভার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছিল বলে অভিযোগ ছিল। স্থানীয় জনগণ এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পৌরসভা থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে সরানোর জন্য। দুই-তিনবার মৌখিকভাবে ও লিখিত আকারে জানানো হয়েছিল। না সরানোর কারণে ব্যানার-ফেস্টুন সরিয়ে পৌরসভায় রাখা হয়েছে।”
তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সভাতেও আলোচনা হয়েছিল। সেখান থেকে সকল রাজনৈতিক দলের পোস্টারই পৌরসভার পক্ষ থেকে সরানো হয়েছে। তবে, বিএনপি নেতা কে এম জুয়েলের ফোনে শাসানোর বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা কে এম জুয়েল বলেন, “ইউএনওর কাছে জনগণ অভিযোগ করেছে, আর আমরা কি মানুষ না? আমরা জানোয়ার? আমার ছবি তুলে ফেলুক আপত্তি নাই। আমার নেতার ছবিতে হাত দিয়েছে কেন? তার কাছে কি নির্বাচন কমিশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পোস্টার তুলে ফেলতে? তিন মাসের মধ্যে কি নির্বাচন? উনি জাস্টিস করতেন, আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু গরু-ছাগলের মতো আচরণ করবেন, তা তো হয় না।”
বিষয়টি নিয়ে কোথাও আলোচনা হয়নি, ইউএনও কোনো চিঠিও দেননি, দাবি করে এই বিএনপি নেতা বলেন, “গতকাল আমার এক লোককে ডেকে ইউএনও বলেছেন, যেখানে পোস্টার ছিল, দয়া করে আপনারা লাগিয়ে নেন। কিন্তু, আমরা তো লাগাব না। ইউএনওকেই লাগাতে হবে।”
উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একজন সদস্য জানান, প্রায় দুই মাস আগে উপজেলা সদরের এসব ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উত্থাপন করেন এক ব্যক্তি। এক মাসেও সেগুলো অপসারণ না হওয়ায় পরবর্তী মাসের সভাতেও বিষয়টি আলোচনায় ওঠে। ওই সভায় ট্রাফিক পুলিশ আপত্তি করেছিল যে, ফেস্টুনের কারণে রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশ দেখা যায় না। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ দুটি সভার মধ্যে প্রথম সভায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল ছিলেন না। দুই সভার মাঝে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি পুনর্গঠন করা হলে তিনি পরবর্তী সভায় উপস্থিত ছিলেন।
তবে, কোনো আলোচনা হয়নি দাবি করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল বলেন, “আমি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য। পোস্টার নিয়ে কোনো আলোচনা সভায় হয়নি। ইউএনও আমাদের না জানিয়ে এভাবে ফেস্টুন অপসারণ করে ঠিক করেননি। সেখানে আমাদের নেতার ছবি ছিল।”
ঢাকা/কেয়া/রফিক