বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে আনোয়ার হোসেনের শরীর। মাথার সাদা চুল মাঙ্কি টুপিতে ঢাকা। আর গায়ে জড়ানো লম্বা পাঞ্জাবি। কাঁধে বইছেন ফাঁকা একটি ঝুড়ি। সেটি ধরে রেখে জানালেন, স্থানীয় বাজারে সবজি বিক্রি শেষে হেঁটে বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। এটিই তাঁর আয়ের একমাত্র মাধ্যম। এ আয়ে স্ত্রী সখিনা বেগম (৭০) ও তাঁর সংসার চলছে। তাঁরা জানান, চার সন্তান থাকলেও কেউ খোঁজখবর রাখেন না।

নিজেকে ১০০ বছর বয়সী বলে দাবি করেন আনোয়ার হোসেন। তাঁর বাড়ি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরঘেঁষা শেরপুরের মুন্সিরচর এলাকায়। প্রতিদিন ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে হেঁটে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে জামালপুর শহরের ফৌজদারি বাজারে সবজি বিক্রি করেন।

গত বুধবার সকাল আটটার দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এ বয়সেও কাজ করতে হচ্ছে জানিয়ে বেশ আক্ষেপ করছিলেন তিনি। জানান, দুই ছেলে ও দুই মেয়ের আলাদা সংসার। নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত তাঁরা। কেউ তেমন খোঁজখবর নেন না। তাই বাধ্য হয়ে এই বয়সেও নিজের জমিতে সবজি চাষ করেন। নিয়মিত এসব সবজি বাজারে নিয়ে বিক্রিও করেন। এই আয়েই চলছেন এই দম্পতি।

আনোয়ারের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, বৃদ্ধ বয়সে এই দম্পতির কষ্টে দিন কাটছে। দুই ছেলে ছয় মাসেও একবার জিজ্ঞেস করেন না, তাঁরা কেমন আছেন। সন্তানদের বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ার প্রথমে কয়েক মিনিট চুপ থাকলেন। অজানা বিষাদের স্পষ্ট ছায়া দেখা গেল তাঁর মুখজুড়ে। সন্তানদের প্রতি তাঁর যেন শুধুই আক্ষেপ, কোনো অভিযোগ নেই। তিনি মনে করেন, ছেলেদের স্ত্রীদের কারণে হয়তো সন্তানেরা মা–বাবার সঙ্গে ঠিকমতো যোগাযোগ করেন না। সন্তানদের সুখের জন্য তিনি কিছুই বলেন না। নীরবে চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের জীবনযুদ্ধ।

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বুঝেন না, বউ-ঝিয়েরা (পুত্রবধূ) অত কিছু করে না। নিজেই খাইটে খাই। কত কষ্ট করে পুলাপান মানুষ করছি। অহন বউ ছাড়া এডা (একটা) আও (কথা) করবার পাই না তাঁরা (সন্তান)। দেহুন বয়স ১০০ বছরে গেছি। বুড়া-বুড়ির চারডে খাউনের জন্য এত কষ্ট করি। পুলাপানরা কিছুই করে না আংগরে লাইগা। আল্লাহে যা দেয়, তাই খাই। এল্লা (অল্প) তইতরকারি (সবজি) করি, বাজারে বেচি—তাই খাই। এডা গরুবাছুর পালি। ওরা না দেখলেও আল্লাহ-রসুলের দয়ায় আমগরে ঠেহা পড়ে না। পুলাপানেরডা আমরা খাইও না। কোনো দিনও কই না, দিবি না কেন? তগেরডা তোরা কইরে খা গা। আমগরেডা আমরা কইরে খাই। পুলাপান যেহেতু, ওগরে জমিজমা দিয়ে দিছি।’

আনোয়ারের নিজের বলতে দেড় বিঘা ফসলি জমি আছে। ওই জমিতে সবজি চাষাবাদ করেন। তাঁর এক ছেলে রাজধানী ঢাকায় বাসচালকের কাজ করেন। আরেকজন শেরপুর শহরে বসবাস করেন। তাঁরা বিয়ের পর নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত।

খোঁজখবর রাখার সময়ই হয়তো পায় না। তবে বছরে দু-একবার তাঁরা (সন্তান) বাড়িতে আসে। সারাটা জীবন চাষাবাদ করে সংসার চালিয়েছেন। চারজন সন্তান বড় করেছেন। এই বয়সেও বেঁচে থাকতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তবু জীবনের কাছে হার মানতে নারাজ এই বৃদ্ধ।

আনোয়ার জানান, সারা দিন খেতে বিভিন্ন শাকসবজির যত্ন নিয়েই তাঁর সময় কেটে যায়। দিনের শুরুতে ভোরবেলায় এসব সবজি ভাঁড়ে করে বাজারে নিয়ে যান। এ থেকে ১০০-১৫০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। তাই দিয়ে কোনো রকমে দুজনের সংসার চলে। আলাপের এ পর্যায়ে আক্ষেপ করে আনোয়ার জানান, একসময় সুখের সংসার ছিল। আশায় ছিলেন, সন্তানেরা বৃদ্ধ বয়সে কাজ করতে দেবে না। বয়সের কারণে এখন আর আগের মতো শরীর চলে না। তবুও বেঁচে থাকতে হবে। তাই সারা দিন মাঠে সবজি চাষে সময় দেন।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

আজও আঁধার কাটেনি কোচদের

বন্যহাতি ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে কোচ সম্প্রদায়। তাদের কেউ কেউ দিনমজুরি, বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ, বাঁশ দিয়ে ডোল, ধারাই ও চাটাই তৈরি করে বিক্রি করে থাকেন। আবার কেউ নিজেদের লাগানো কাসাবা খেয়ে বেঁচে থাকেন। অভাব-অনটনে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করলেও তাদের দিকে বিশেষ নজর নেই কারও। অবহেলিত এ আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক পরিবারের বসবাস নালিতাবাড়ী উপজেলার খলচান্দা গ্রামে। সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩০০।
বারমারী বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে খলচান্দা গ্রামে যেতে হয়। প্রায় ১০০ গজ উত্তরে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। স্বাধীনতার আগে মাত্র চার ঘর কোচ এই গ্রামে বাস করত। এর পর বংশবৃদ্ধি এবং ১৯৭৬ সালে চৌকিদার টিলা গ্রামে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন ও পরে ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প করায় আন্ধারুপাড়া গ্রাম থেকে বেশ কিছু পরিবার এখানে এসে বসতি গড়ে। এই গ্রামের বর্তমান পরিবার সংখ্যা প্রায় ৫২ ঘর। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ এ গ্রামে যেতে চান না।  টিলায় ঘেরা গ্রামে দিনদিন জনসংখ্যা বাড়লেও তাদের ভাগ্যের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বাসিন্দারা জানান, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা চেল্লাখালী নদী দিয়ে এক সময় ভারত থেকে ভেসে আসত অসংখ্য বড় মূল্যবান গাছ। সে গাছ নদী থেকে তুলে এনে বিক্রি করে এবং পাহাড়ের সমতল জমিতে ধান চাষ করে ভালোই চলত খলচন্দা গ্রামের কোচদের সংসার। এসব দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি। তাদের মূল পেশা কৃষিকাজ হলেও পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ায় জমি সংকট এবং কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই সেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিনমজুর, কেউবা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নানা পেশায় যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঘরে বসে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকেই।
গ্রামটিতে কোনো পাকা সড়ক নেই। যাতায়াতের সড়কটি বেহাল। শুষ্ক মৌসুমে সড়ক ধুলোময় হয়ে থাকে। বর্ষায় চলাচল সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে যায়। এ ছাড়া গ্রামে একটি মাত্র প্রাকপ্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এই গ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষার হার নাজুক। স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও একই। কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পায় না কোচ পরিবারগুলো। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তিন কিলোমিটার দূরে বারোমারি খ্রিষ্টান পল্লীর দাতব্য হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়। মুমূর্ষু রোগীকে ডাক্তার দেখাতে বা চিকিৎসা নিতে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলা সদরে অথবা ৪০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদর হাসপাতালে যেতে হয়। স্বাধীনতার এত বছর পরও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছায়নি খলচান্দা গ্রামে। আজও আঁধার কাটেনি কোচদের– এমনটিই বলছেন স্থানীয়রা। 
খলচান্দা গ্রামের মায়াদেবী কোচ বলেন, ‘আমগর সড়কটা দিয়ে শান্তি মতো যাওন যায় না। আধা মাইল দূর থাইকা দুই বেলা পানি আইনা চলি। এতে আমগর বিরাট কষ্ট অয়। মেঘ (বৃষ্টি) অইলে সড়কা দিয়া হাঁটন যায় না। সরকার যদি আমগরে গ্রামে বেশ কয়ডা টিউবওয়েলের ব্যবস্থা কইরা দিত, বিরাট উপকার অইত।’
বৃদ্ধ রুক্কিনী কোচ জানান, তাঁর বাবার বাড়ি পাশের সমেশ্চুরা গ্রামে। দেশ স্বাধীনের আগে এই গ্রামে বিয়ে হয় তাঁর। এক সময় পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা ছিল। পাহাড় থেকে মরা কাঠ সংগ্রহ আর গাছ থেকে বিভিন্ন ফল পেড়ে খেতেন তারা। অনেক পশুপাখিও ছিল, কিন্তু এখন এই পাহাড়ে আর আগের মতো গাছও নেই, তাদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
গ্রামের রমেশ কোচ ও পরমেশ্বর কোচের ভাষ্য, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের গ্রামের মাত্র তিনজন কোচ সরকারি চাকরি পেয়েছেন। এর মধ্যে বিজিবিতে কর্মরত একজন অনেক আগে মারা গেছেন। অভাব-অনটন আর যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় এই গ্রামের কোচ উপজাতিরা শিক্ষায় এগোতে পারছেন না।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, মাঝে মধ্যেই বন্যহাতি হানা দেয় এই গ্রামে। গাছের কাঁঠাল ও ক্ষেতের ধান পাকার মৌসুমে বন্যহাতির পাল খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। এ সময় হাতির পাল কাঁঠাল, ক্ষেতের ধান খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে দেয়। বাড়িঘরও ভেঙে তছনছ করে ফেলে। তখন এই অসহায় কোচদের টিন পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে, ডাকচিৎকার ও হৈহুল্লোড় করে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। তাদের ভালো-মন্দের খবর কেউ রাখে না। জনপ্রতিনিধিরা শুধু নির্বাচনের সময় ভোট চাইতে আসেন। তাদের পদচারণায় কোচপল্লী তখন মুখর হলেও নির্বাচনের পর তাদের খবর রাখে না কেউ।
স্থানীয় চেয়ারম্যান হাজী জামাল উদ্দিন বলেন, খলচান্দার কোচপাড়া যাওয়ার রাস্তাটার জন্যই অনেক পিছিয়ে আছে কোচ সম্প্রদায়ের লোকগুলো। বিশেষ করে অনিরাপদ রাস্তার জন্য শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তারা। রাস্তা ও স্কুলের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। 
এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আজও আঁধার কাটেনি কোচদের