জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জেলা পরিষদ নির্বাচন করার সুপারিশ
Published: 21st, February 2025 GMT
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন জেলা পরিষদ বাতিলের সুপারিশ করলেও তার উল্টো সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করা এবং জনগণের সরাসরি বা প্রত্যক্ষ ভোটে জেলা পরিষদ নির্বাচন করার সুপারিশ করেছে তারা। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জেলা পরিষদ হবে ‘পরিকল্পনা ইউনিট’। আর উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ হবে ‘বাস্তবায়ন ইউনিট’।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশের একটি সারসংক্ষেপ গত বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারকে জমা দিয়েছে। সেখানে ১৪টি ক্ষেত্রে মোট ২১০টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। তবে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো প্রকাশ করা হয়নি। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি হওয়ার পর তা প্রকাশ করা হবে।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জেলা পরিষদে সরাসরি ভোট হবে সদস্য পদে। একটি জেলার অধীনে একটি উপজেলাকে ৩ থেকে ৫টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হবে। বড় উপজেলা হলে সেখানে ৫টি ওয়ার্ড গণ্য করা হবে। বাকিগুলোকে ৩টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হবে।বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির লক্ষ্যে দুই ধাপে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশন তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা পাঁচটি কমিশনের স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশের সারসংক্ষেপ সরকারের কাছে জমা দিয়েছে।
স্থানীয় সরকারের পাঁচটি স্তরের মধ্যে অন্যতম জেলা পরিষদ। তবে বিদ্যমান ব্যবস্থায় জেলা পরিষদ কতটা কার্যকর প্রতিষ্ঠান, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দীর্ঘদিন জেলা পরিষদগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন মূলত আওয়ামী লীগের বঞ্চিত ও বয়স্ক নেতারা। যে কারণে এই পরিষদ বয়স্ক ও বঞ্চিত নেতাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র হিসেবেও পরিচিতি পায়।
২০০০ সালে জেলা পরিষদ আইন পাস করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ছাড়া বাকি ৬১টি জেলা পরিষদে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথমবার প্রশাসক নিয়োগ দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তখন মূলত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের বয়স্ক ও বঞ্চিত নেতারা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৬ সালে তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া ৬১ জেলায় প্রথমবার জেলা পরিষদ নির্বাচন হয়। এরপর নির্বাচন হয় ২০২২ সালে।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন সুপারিশে করেছে, একই এলাকায় সব ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন এক দিনে করার। এতে নির্বাচনী ব্যয় কমবে। তারা বলছে, এই নির্বাচন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধাপে ধাপে হতে পারে। তবে একই এলাকায় একসঙ্গে সব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন হবে।বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, জেলা পরিষদ নির্বাচনে সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে পারেন না। সংশ্লিষ্ট জেলার অধীন উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ভোটার হন। যদি কোনো জেলায় সিটি করপোরেশন থাকে, তাহলে সেই সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও পরিষদের নির্বাচনে ভোটার হিসেবে গণ্য হন।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, তাদের প্রতিবেদনে জনগণের সরাসরি ভোটে জেলা পরিষদের নির্বাচন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে এবং উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র পদে সরাসরি ভোট হবে না। সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পরিষদের সদস্যরা (মেম্বার, কাউন্সিলর) ভোট দিয়ে তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান/মেয়র পদে নির্বাচিত করবেন।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জেলা পরিষদে সরাসরি ভোট হবে সদস্য পদে। একটি জেলার অধীনে একটি উপজেলাকে ৩ থেকে ৫টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হবে। বড় উপজেলা হলে সেখানে ৫টি ওয়ার্ড গণ্য করা হবে। বাকিগুলোকে ৩টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হবে। কোনো জেলায় যদি ১০টি উপজেলা থাকে, তাহলে জেলা পরিষদে মোট সদস্য হবেন ন্যূনতম ৩০ জন। তাঁরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে ভোট দেবেন ওই ৩০ জন। এই পদে প্রার্থীও হতে পারবেন শুধু নির্বাচিত সদস্যরা।
দেশের পুরোনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা—এই চারটি প্রদেশ করার পক্ষে কমিশন।জেলা পরিষদকে শক্তিশালী করতে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব হলো জেলা পরিষদকে একটি পরিকল্পনা কাঠামো হিসেবে দাঁড় করানো হবে। জাতীয় পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে তারা পরিকল্পনা করবে। বিভিন্ন খাতে জেলা পর্যায়ে যেসব বরাদ্দ যায়, সেগুলো যাবে জেলা পরিষদের তহবিলে। সেখান থেকে তা বণ্টন করা হবে। জেলা পরিষদে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং গ্রামীণ উন্নয়নসহ ছয়টি বিশেষায়িত ‘গ্রুপ’ থাকবে। তারা পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ করবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ।
একসঙ্গে নির্বাচনের সুপারিশ
ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি), পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং সিটি করপোরেশন—এই পাঁচ ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশে। এখন এসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন হয় আলাদা আলাদা। অর্থাৎ ইউপি নির্বাচন এক সময়ে, পৌরসভা অন্য সময়ে, উপজেলা আলাদাভাবে।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন সুপারিশে করেছে, একই এলাকায় সব ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন এক দিনে করার। এতে নির্বাচনী ব্যয় কমবে। তারা বলছে, এই নির্বাচন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধাপে ধাপে হতে পারে। তবে একই এলাকায় একসঙ্গে সব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন হবে। তাতে একজন ভোটার একসঙ্গে দুটি বা তিনটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সদস্য নির্বাচনে ভোট দেবেন। যেমন কোনো একটি জেলায় নির্বাচন হলে সেখানে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভায় সদস্য নির্বাচনে ভোট দেবেন ভোটাররা। আর সিটি করপোরেশন এলাকা হলে সেখানে ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচনে ভোট দেবেন।
অন্যদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন জেলা পরিষদ বাতিলের সুপারিশ করে তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ‘জেলা পরিষদের সহায়-সম্পদ প্রস্তাবিত সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক সরকারকে হস্তান্তর করা যেতে পারে।’
দেশের পুরোনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা—এই চারটি প্রদেশ করার পক্ষে কমিশন।
তবে দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করার বিষয়টি সমর্থন করেন না স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রদেশ নয় বরং জেলা পরিষদকে আরও শক্তিশালী করে পরিকল্পনা কাঠামো হিসেবে গঠনের সুপারিশ করেছেন তাঁরা।
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ শুরু করেছে। তাই মেজর (মূল) সুপারিশগুলো সরকারকে তাঁরা দিয়েছেন। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পরে জমা দেবেন তাঁরা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র স থ ন য় সরক র র স প র শ কর ছ কর র স প র শ একসঙ গ জনগণ র ভ গ কর উপজ ল প রসভ সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
স্বচ্ছতার জন্য ডিএনসিসির প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে:
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) ডিএনসিসির ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত পশ্চিম শেওড়াপাড়া, পশ্চিম কাজীপাড়া ও সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় ৪ কিলোমিটার রাস্তা, ৫ কিলোমিটার নর্দমা ও দেড় কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণকাজের উদ্বোধন ও গণশুনানি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা জানান।
ডিএনসিসির প্রশাসক বলেন, ডিএনসিসির সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। প্রকল্পটি কবে শুরু হবে, কবে শেষ হবে, কতা টাকা বরাদ্দ আছে—এসব তথ্য ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। এছাড়া, রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ হলে নির্মাণ সামগ্রী কী, সেটা জনগণের জানা দরকার। যখন জনগণ জানবে, তখন তারা জবাবদিহি করতে পারবে।
তিনি বলেন, “আমি গত সপ্তাহে কাউকে না জানিয়ে ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে চলমান কাজ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, রাস্তাকে ধরে রাখার জন্য যে ওয়াল (বিশেষ দেয়াল) দেওয়া হয়েছে, সেটার পিলার বানানোর কথা ছিল স্টোন দিয়ে; কিন্তু বানিয়ে রেখেছে ব্রিক দিয়ে। এটা বড় দুর্নীতি। স্থানীয় মানুষ যদি না জানে, কী নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হবে, তাহলে দুর্নীতি করাটা সহজ। তথ্যের যত বেশি আদান-প্রদান হবে, তথ্য যত বেশি পাবলিক করা হবে, জনগণ তত বেশি জবাবদিহি করতে পারবে। আমি ঠিকাদারকে জানিয়ে দিয়েছি, সঠিক নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার না করলে বিল দেব না। তারা বলেছে, এটা ঠিক করে দেবে।”
মোহাম্মদ এজাজ বলেন, যার যার এলাকার কাজ তারা বুঝে নেবেন। বুঝে নেওয়ার জন্য যত তথ্য ও সহযোগিতা লাগবে, সেটা আমরা দেব। ডিএনসিসির ওয়েবসাইটে প্রকল্পের সব তথ্য ও ঠিকাদারের ফোন নম্বরসহ দেওয়া থাকবে। স্থানীয় জনগণ স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ বুঝে নেবেন। আমরা চাই, সকলের অংশগ্রহণে উন্নয়নকাজ সম্পন্ন হবে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় সোসাইটি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহযোগিতা পাচ্ছি। সবার অংশগ্রহণ বাড়াতে আমি বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের নিয়ে গণশুনানি করছি। প্রতি মাসে ফেসবুক লাইভে দেশে-বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সাথে যুক্ত হচ্ছি। ডিএনসিসির সবার ঢাকা অ্যাপ আছে, সেটির পাসওয়ার্ড পর্যন্ত আমাদের দিচ্ছে না। আগে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা ৪ কোটি টাকা খরচ করে এই অ্যাপ বানিয়েছে। পাসওয়ার্ড না দিলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।”
ডিএনসিসির প্রশাসক বলেন, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় হকারদের জন্য হাটা যায় না। মানুষের অবাধ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। ঢাকা শহরে মানুষের চলাচলের অধিকার সবার আগে, সেই অধিকার আমরা বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। মিরপুর-১০ এর প্রধান সড়কের যত হকার ও অটোরিকশা আছে, সেগুলো আমরা বন্ধ করে দেব। যারা এ ধরনের ইনফরমাল পেশায় যুক্ত আছেন, তাদের পুনর্বাসনের জন্যও আমরা প্ল্যাটফর্ম করব। তাদের জন্যও বিকল্প ব্যবস্থা আমরা তৈরি করব। এই শহরটা সবার, সবাই একসাথে বসবাস করব; কিন্তু অন্যদের কষ্ট না দিয়ে, অন্যের অধিকার নষ্ট না করে।
বক্তৃতা শেষে ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন এবং মোনাজাতে অংশ নেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, অঞ্চল-৪ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খন্দকার মাহাবুব আলম, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হকসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
ঢাকা/এএএম/রফিক