একুশের গল্প। তবে গল্প নয়, সত্যি, একদম সত্যি ঘটনা এবং তা ঘটেছিল সেই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। অনেক দিন আগের কথা, কিন্তু তা হলে কী হবে, একুশে এখনো অত্যুজ্জ্বল। মহান একুশের কথা আমরা এখনো ভুলতে পারি না। প্রশ্ন হতে পারে, আমি ঘটনাটা কেমন করে জানলাম। তার জবাবে বলছি, আমি সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে, আমতলায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি বিভাগে ঢোকার পথে বড় একটা ফটকের ওপর পুরোনো একটা ফলকে লেখা আছে সেদিনের পরিচয়। আমি সেই তীর্থক্ষেত্রে ছিলাম। আমি একা নই, হাজার হাজার শিক্ষার্থী সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। কেন?

এই ‘কেন’র জবাব অনেক দীর্ঘ। একুশের কথা বলতে হলে তার আগের কথা বলতে হয়—৪ ফেব্রুয়ারি, ১১ ফেব্রুয়ারি এবং তার আগের দিন ও বছরগুলোর কথা। শুধু তা-ই নয়। আরও পিছিয়ে আমার জন্ম, আমার শৈশব, আমার বর্ণমালা শেখা, পড়তে শেখা, বাংলা ভাষার সুধাময় ছন্দে, গানে, কবিতায়, গল্পে, কথায়, সারা মনকে সিক্ত করা—এ সবকিছু বলতে হয়। এবং আরও কিছু।

জন্মেই পেয়েছি মাকে। মায়ের ভাষা বাংলা। মায়ের পেট থেকেই তো আমার ভাষা বাংলা। সে ভাষার ওপর আঘাত আমি কি সইব? না! না! না! পেয়েছি বাবাকে। পেয়েছি ভাই-বোন, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, খালা ও ফুফু—তাঁদের সবার ভাষা বাংলা। জন্ম-জন্মান্তরের এই ভাষা সাধনায় পাওয়া, ঈশ্বরের দান, পৃথিবীর দান, আমার অস্তিত্বের অস্তিত্ব। বিনা যুদ্ধে সে ভাষার দাবি আমরা কেউ কোনো দিনও ছাড়ব? ছাড়ব না।

আগে যে লেখাপড়ার কথা বলছিলাম, সেই লেখাপড়ার কথায় ফিরে যাই। পড়া শিখেই রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি, পেয়েছি অতুল প্রসাদকে, নজরুলকে, শরৎচন্দ্রকে আর পেয়েছি বাংলাদেশকে। সারা উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশের করালগ্রাসে, ইংরেজদের অধিকারে, তাদের চরম নিষ্ঠুরতার শৃঙ্খলে বাঁধা। আমরা পরাধীন। তাই সেই শৈশবেই মনের মধ্যে ইংরেজ তাড়ানোর জন্য কারখানা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। দেশের মাটি ও মানুষকে বেদনামুক্ত করার জন্য ফাইভ-সিক্সে পড়ার সময় থেকেই ইংরেজবিরোধী শোভাযাত্রা, সভা ও সমাবেশে যাওয়া শুরু করি। আরও কিছু পরে নেতাজি সুভাষ বসুর প্রেরণা মনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করল। তখন যেন মনে মনে তাঁর সেনাদলের সঙ্গে কদম কদম এগিয়ে যেতে লাগলাম দূর দুর্গম বিপ্লবী পথের দিকে। অনেক যন্ত্রণার সাগর পার হয়ে উদয়ের পথে হারিয়ে যাওয়া অনেক স্বাধীনতাসংগ্রামীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ স্বাধীন হলো। ইংরেজ ভারত ছাড়তে বাধ্য হলো। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো সে স্বাধীনতা যেন শূন্যে মিলিয়ে যেতে বসল। দুই পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলল সেই প্রথম থেকেই। পশ্চিম পাকিস্তানের ওপরওয়ালারা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের উপনিবেশ বানিয়ে শাসন ও শোষণ করতে লাগল।

তারপর তারা আমাদের ভাষার ওপর মোক্ষম আঘাত হানল। বোকামি করে পশ্চিমা ওপরওয়ালারা প্রচার করতে লাগল, বাংলা ভাষার উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে, তাই এটা অপবিত্র, এ ভাষার মানুষ সব ছোট জাত। এ ভাষা রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

এরই মধ্যে কলেজে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে সাম্যবাদের শিক্ষা লাভ করেছি। চোখের ওপর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পাকিস্তান হয়েছে, কিন্তু স্বাধিকার পাইনি। শান্তির বদলে এসেছে অত্যাচার, কারাগার। ভাতের বদলে বুলেট? তাই গণনাট্য সংঘের উচ্চারণে বলেছি, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়।’ মনের মাটি এভাবেই শক্ত হয়েছিল, তাই ১৯৫২ সালে যখন প্রিয় মাতৃভাষার ওপর অন্ধকার নেমে এল, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা তাকে দেওয়া হবে না। চক্রান্ত হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাদের জীবন ও জীবিকার ওপর ভিক্ষার ঝুলি চাপিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অত সহজে এই ষড়যন্ত্র মেনে নিল না। শুরু হলো আলোচনা, সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই—এই হলো সবার মূলমন্ত্র। আমিও তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে সব ছাত্রের সঙ্গে গর্জে উঠলাম এবং আমাদের অস্তিত্ববিরোধী সরকারের আরোপিত ১৪৪ ধারা ভাঙতে সবার আগে বের হয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা চারজন চারজন করে দল বেঁধেছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল স্কুল থেকে আইন অমান্য করে বের হয়ে আসা ছোট কয়েকটি মেয়ে। তারা হলো সেতারা, জুলেখা, আখতারী, নূরি প্রমুখ। তারা মিছিলে এসেছিল দেশকে ভালোবেসে, মাতৃভাষাকে ভালোবেসে। পুলিশের বন্দুক নরম পায়ে ঠেলে এসেছিল তারা। আইন অমান্য করার, ভাষা বাঁচানোর, পুলিশের বাধা ভাঙার মন্ত্র আমরা তাদের শিখিয়েছিলাম। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্রী। বাড়ি আমার অনেক দূর, প্রায় সুন্দরবনের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য তাই হোস্টেলে ছিলাম। কমিউনিস্ট পার্টির এক আপা হোস্টেলে এসে আমাদের উৎসাহ দিতেন, ভাষা বাঁচানোর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্র শোনাতেন এবং আন্দোলনের কর্মপন্থা বলে দিতেন। নাম তার যুঁইফুল রায়।

সাধারণ ছাত্রদের চাপে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্তের পর স্লোগান উঠল—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ‘চল, চল, অ্যাসেম্বলি চল।’ ঠিক হলো ছাত্ররা ১০ জন করে দল বেঁধে পুলিশের বাধা পার হয়ে বের হবে। মেয়েরা চারজন। সবার প্রথমে আমি তিনজন মেয়েকে নিয়ে এবং আরেকজন তিনজন মেয়েকে নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে পুলিশের বন্দুকের নল ঠেলে বের হলাম। রাস্তায় বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে লাগল। আমাদের পরে সাফিয়া খাতুনের নেতৃত্বে আরও আটজন বের হলে পুলিশ তাদের অ্যারেস্ট করে ভ্যানে তুলে নেয়। ছাত্ররা তখন বন্যার জলের মতো স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে আসে। তখন প্রচণ্ড লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস চলতে থাকে। আমরা সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভলান্টিয়াররা তখন বালতি ভরে পানি এনে আমাদের কাছে ধরল। বালতির পানিতে রুমাল ভিজিয়ে, আঁচল ভিজিয়ে চোখে পানি দিয়ে স্লোগান দিতে দিতে আমরা আবার সামনের দিকে এগিয়ে চললাম ‘চলো চলো অ্যাসেম্বলি’ বলে। কিন্তু কাঁদানে গ্যাসের প্রচণ্ড ঝাঁজে আর এগোতে পারছিলাম না। তখন আমরা মেডিকেল ইমার্জেন্সিতে গিয়ে ফার্স্টএইড নিয়ে আবার রাস্তায় চলে এলাম। রাস্তায় তখন শুরু হয়ে গেছে প্রচণ্ড যুদ্ধ। মেডিকেলের মাঠ থেকে আক্রমণরত পুলিশ সদস্যদের তাক করে ছাত্ররা ইট ছুড়তে লাগল। পুলিশ লাঠি চালাতে লাগল ও অ্যারেস্ট করতে লাগল, কাঁদানে গ্যাসও ছুড়তে লাগল। তারপর প্রায় বেলা তিনটার দিকে পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে দিল। আমরা আর এগিয়ে যেতে পারিনি।

ঠিক হলো, ছাত্ররা ১০ জন করে দল বেঁধে পুলিশের বাধা পার হয়ে বের হবে। মেয়েরা চারজন। সবার প্রথমে আমি তিনজন মেয়েকে নিয়ে এবং আরেকজন তিনজন মেয়েকে নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে পুলিশের বন্দুকের নল ঠেলে বের হলাম।

সামনে দেখছি আহত-নিহতদের স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসছে। তাদের রক্তে মাটি ভিজে যাচ্ছে, সবুজ ঘাস লাল হয়ে যাচ্ছে। স্ট্রেচারের সঙ্গে সঙ্গে ইমার্জেন্সিতে ঢুকছি, আহতদের দেখছি। রক্ত, রক্ত, চারদিকে রক্ত। আহতদের আমরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। একজন ছাড়া আর কাউকে চিনতে পারিনি। তখন আমাদের ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ ছিল। তাই বেশি মুখ আমাদের চেনা ছিল না। তখন বেলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এখন যেখানে শহীদ মিনার, সেখানে বেশ কাঁদলাম। দেখি, অনেকখানি জায়গাজুড়ে রক্ত। বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অত রক্ত একসঙ্গে কখনো দেখিনি। বাংলাদেশের পতাকার লাল সূর্যটা সেই রক্তসাগরকে মনে করিয়ে দেয়। মনে হয়, সেই রক্তসাগরেই সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ উপ্ত হয়েছিল। ওখানে আমরা দেখলাম, শহীদদের রক্তে ভেজা জামাকাপড় গাছের ডালে ঝোলানো। দেখলাম মাথার খুলি উড়ে যাওয়া রফিকের মগজ বকুল ফুলের মতো থোকায় থোকায় ছড়িয়ে আছে অনেকখানি জায়গাজুড়ে। এমন আর কখনো দেখিনি। সেই বকুল ফুল, সেই মগজ, সেই রক্তের সাগর আমাদের শপথ। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের ভবিষ্যৎ।

হালিমা খাতুন: ভাষাসৈনিক; প্রয়াত শিশুসাহিত্যিক। 

সূত্র: প্রথম আলো,  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত নজন ম য় ক আম দ র চ রজন র ওপর তখন ব প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে

একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।

ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।

প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।

দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।

ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।

আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।

ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।

গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।

খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।

সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।

নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।

ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।

আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার

গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।

ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।

গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ