১০০ টাকার ফলে শুল্ক–কর দিতে হয় ১৩৬ টাকা
Published: 23rd, February 2025 GMT
আপেল, আঙুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টাসহ বিভিন্ন ধরনের ফলের ওপর শুল্ক-করের ‘অত্যাচার’ যেন বেড়েই চলেছে। বিদেশি ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বসানো হয়েছে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কও। আবার বাড়ানো হয়েছে অগ্রিম কর। বসানো হয়েছে অগ্রিম ভ্যাটও। বিদেশি ফলে শুল্ক–করারোপের সর্বশেষ সংযোজন ফল আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন ১০০ টাকার ফল আমদানি করলে ১৩৬ টাকা শুল্ক-কর দিতে হয়। সম্প্রতি ট্যারিফ কমিশনের এই প্রতিবেদন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়। সেখানে বিদেশি ফল আমদানিতে শুল্ক-কর কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
ট্যারিফ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, আপেল, আঙুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল বন্দর এলাকা পার হলেই ১০০ টাকার ফলের দাম হয়ে যায় ২৩৬ টাকা। বাজার পর্যন্ত আসতে এই দামের সঙ্গে পরিবহন ভাড়াসহ অন্যান্য খরচও যোগ হয়, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ঘাড়েই চাপে।
রমজানের সময় আপেল, নাশপাতি, আঙুর, কমলা, মাল্টা ইত্যাদির চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু বাড়তি শুল্ক–করের কারণে এবার বিদেশি ফল আমদানি কমে গেছে।
শুল্ক কর কত
বর্তমানে ফল আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১০ শতাংশ অগ্রিম কর, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর আছে। মোটামুটি যত ধরনের শুল্ক-কর আছে, সবই আরোপ করা হয়েছে বিদেশি ফল আমদানির ক্ষেত্রে। সব মিলিয়ে শুল্ক-কর ভার ১৩৬ শতাংশ।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, প্রচলিত আমদানি পণ্যের মধ্যে গাড়ি ও মদ-সিগারেটের পর তাজা ফল আমদানিতেই সবচেয়ে বেশি শুল্ক-কর দিতে হয়।
শুল্ক-করের চাপ বেড়ে চলেছে
গত মাসে আপেল, আঙুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টা, বাদামসহ বিভিন্ন ধরনের আমদানি করা ফলের ওপর ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়। এর আগে ২০২২ সালের মে মাসে ফল আমদানির ওপর ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানো হয়েছিল। ওই সময় দেশে ডলার–সংকট দেখা দেয়। এ কারণে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসায় সরকার। ফল আমদানিকারকদের দাবি, সাধারণত জরুরি অবস্থা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলে পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানো হয়। এখন দেশে ওই ধরনের পরিস্থিতি নেই। তারপর ফল আমদানির ক্ষেত্রে আরোপিত নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বহাল রয়েছে।
ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি ২০২৩–এ বলা হয়েছে, শুধু জরুরি প্রয়োজনেই নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানো যেতে পারে। কিন্তু ফল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করে ট্যারিফ কমিশন।
৪০% মুনাফা কতটা বাস্তবসম্মত
গত বছর ফল আমদানির ওপর অগ্রিম কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এই ১০ শতাংশ অগ্রিম কর সমন্বয় করতে হলে অন্তত ৪০ শতাংশ মুনাফা করতে হবে। কিন্তু এই ধরনের পচনশীল পণ্যে ১৫-২০ শতাংশের বেশি মুনাফা হয় না। ফলে যাঁরা নিয়মকানুন মেনে ফল আমদানি করেন, তাঁরা এত মুনাফা করতে পারেন না। কয়েক বছর ধরে কয়েকটি বড় শিল্পগোষ্ঠী ফল আমদানিতে নেমেছে। অভিযোগ আছে, ১০ শতাংশ অগ্রিম করের সুযোগ নিয়ে অনেকে কালোটাকা সাদা করছেন।
মূল্য সংযোজন নেই, কিন্তু ভ্যাট আছে
বিদেশি ফল আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ আগাম কর দিতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিদেশি আপেল, আঙুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি ফল যে কার্টনে আসে, তা শুল্কায়নের পর সেভাবেই বাজারে আসে। ফলে খুব বেশি মূল্য সংযোজনের সুযোগ নেই। অথচ ভ্যাট দিতে হয়।
এ বিষয়ে তাজা ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আপেল, কমলা, নাশপাতি, মাল্টা এসব আর বিলাস পণ্য নয়। রোগীর পথ্য হিসেবে যেমন ব্যবহার হয়, তেমনি পুষ্টিমান নিশ্চিত করতেও ফল বেশ চলে। পবিত্র রমজান মাসেও ফলের বেশ চাহিদা থাকে। তাই এসব ফলের ওপর আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর কমানো উচিত।
সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, দেশে আপেল, নাশপাতির মতো বিদেশি ফল উৎপাদন হয় না বললেই চলে। দেশীয় পণ্য সুরক্ষা দেওয়ার কোনো কারণ নেই। তাই এত শুল্ক-কর আরোপ করার যুক্তি নেই। শুল্ক–কর বেশি হওয়ায় চোরাই পথে ফল আমদানি বেড়ে গেছে।
তাজা ফল বিলাস পণ্য নয়
তাজা ফলকে বিলাস পণ্য হিসেবে মনে করে না ট্যারিফ কমিশন। সংস্থাটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৫৬ সালের এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট অনুযায়ী, খাদ্যপণ্য হিসেবে তাজা ফল ‘অত্যাবশকীয় পণ্য’। ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান প্রথম আলোকে বলেন, আপেল, নাশপাতি, আঙুর, মাল্টা, কমলা এসব এখন আর বিলাস পণ্য নয়। রমজানের সময় এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকে। আবার রোগীর জন্য এসব ফল খাওয়াতে বলেন চিকিৎসকেরা। তাই এসব পণ্যে শুল্ক-কর কমানো উচিত।
সম্প্রতি আমদানি করা ফলের শুল্ক-কর কমাতে এনবিআরকে সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। তাতে সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ, অগ্রিম কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ও ৫ শতাংশ আগাম কর বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
আমদানি কমেছে
বর্তমানে বিদেশ থেকে ৩৮ ধরনের ফল আমদানি হয়। এনবিআরের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আপেল আমদানি আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫১ শতাংশ, মাল্টা ৭০ শতাংশ, আঙুর ২৯ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে গত জানুয়ারিতে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে মেন্ডারিন ৫১ শতাংশ, আঙুর ২১ শতাংশ, আপেল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, নাশপাতি ৪৫ শতাংশ, আনার ও ড্রাগনের ৩২ শতাংশ আমদানি কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায়।
এনবিআরের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বিদেশি ফল আমদানি হয়েছে। এসব ফল আমদানি থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করেছে ৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফল আমদ ন র ফল আমদ ন ত র ফল আমদ ন শ ল ক কর র ন র ফল কর দ ত র ওপর ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
যমুনা সেতুর যানজট এড়াতে কাজীরহাট-আরিচা নৌপথে যানবাহনের চাপ
ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরতি পথে যমুনা সেতু-সংলগ্ন মহাসড়কে তীব্র যানজট। তাই অনেকে পাবনার কাজীরহাট ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন। কাজীরহাট-আরিচা ফেরিঘাটে ভোগান্তি ছাড়াই যানবাহন পারাপার হচ্ছে। আগের ৪টি ফেরির সঙ্গে আরও ২টি যুক্ত হওয়ায় এই নৌপথে মোট ৬টি ফেরি চলাচল করছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) ও বাস কাউন্টারগুলোর সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে যমুনা সেতু-সংলগ্ন সড়কে যানজট শুরু হয়। শুক্র ও গতকাল শনিবার যানজট তীব্রতর হয়। এর মধ্যে শনিবারের যানজটে পাবনা-ঢাকা পথে যাতায়াতকারী অনেক বাস আটকে পড়ে। এতে পাবনা, বেড়াসহ বিভিন্ন বাস কাউন্টারে ঢাকাগামী বাসের সংকট দেখা দেয়। বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকাগামী বাস ও ব্যক্তিগত ছোট গাড়িগুলো যমুনা সেতুর যানজট এড়াতে কাজীরহাট-আরিচা নৌপথের ফেরি পারাপার বেছে নেয়। এতে আজ রোববার দুপুর পর্যন্ত কাজীরহাট ফেরিঘাটে ঢাকাগামী বিভিন্ন যানবাহনের চাপ আছে।
বিআইডব্লিউটিসির কাজীরহাট ফেরিঘাট কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘আগে কাজীরহাট-আরিচা নৌপথে ৪টি ফেরি চলাচল করত। ঈদ উপলক্ষে এখন আরও ২টি ফেরি বাড়িয়ে মোট ৬টি ফেরি করা হয়েছে। এগুলো হলো ২টি রো রো ফেরি শাহ আলী ও বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান এবং ৪টি সেমি রো রো ফেরি বাইগার, গৌরী, চিত্রা ও ধানসিঁড়ি। এই ৬টি ফেরি দিয়ে নির্বিঘ্নে যানবাহনের চাপ সামলানো যাচ্ছে। বাসসহ যানবাহনগুলোকে ফেরিঘাটে বেশি দেরি করতে হচ্ছে না।’
কাজীরহাট ফেরিঘাট হয়ে ঢাকামুখী আলহামরা পরিবহনের যাত্রী আবু হানিফ বলেন, ফেরিতে ওঠানামা মিলিয়ে আড়াই ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে। আর আরিচা থেকে ঢাকা পর্যন্ত তেমন যানজট ছিল না। খুব ভালোভাবে ঢাকা পৌঁছাতে পেরেছেন। অথচ আরও দুই ঘণ্টা আগে রওনা দিয়েও তাঁর পরিচিত একটি পরিবারকে যমুনা সেতু-সংলগ্ন সড়কে ৫-৬ ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়।
বিআইডব্লিউটিসির কাজীরহাট ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি চাপ ছিল শনিবার। আমাদের বেশ বেগ পোহাতে হলেও যানবাহনগুলো ভালোভাবে পার করে দিয়েছি। শনিবার আমাদের এই ঘাট হয়ে ফেরিতে ১০১টি বাস, ৪০১টি ছোট গাড়ি ও ৮০টি ট্রাক পার হয়েছে। আর আজ রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১৫টি বাস, ১৬টি ট্রাক, ৪২টি ছোট গাড়ি ও ২০০টি মোটরসাইকেল পার হয়েছে।’
বেড়া ও ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী আলহামরা পরিবহনের বেড়া শাখার ব্যবস্থাপক বরকত আলী বলেন, ‘যমুনা সেতুর যানজটে আমাদের কয়েকটি বাস এখনো আটকে আছে। এতে নির্ধারিত সময়ে শুধু আমাদের বাসই নয়, অন্য কোম্পানির বাসগুলোও ঢাকার উদ্দেশে ছাড়তে পারছে না। আর কোনো বাস ঢাকা থেকে বেড়া এসে পৌঁছানোর পর সেই বাস এখন থেকে আমরা কাজীরহাট ফেরিঘাট হয়ে ঢাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। বতর্মান অবস্থায় এই পথে যাতায়াতে যাত্রীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন।’