যেই সময়ে দেশব্যাপী সেনাসদস্যসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলমান, সেই সময়েই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্রমবর্ধমান অপরাধ সংঘটিত হইবার উদ্বেগজনক তথ্য আসিতেছে। রবিবার প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রত্যহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধীদের বহুমাত্রিক তৎপরতার খবর মিলিতেছে এবং সংশ্লিষ্টরা এতটাই বেপরোয়া, ভুক্তভোগীকে প্রকাশ্যে অস্ত্রাঘাতে জখম করিতেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে বাসে আরোহণ করিয়া যাত্রীদের মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ, টাকা লুণ্ঠন করিতেছে। এমনকি চলমান বাসে অস্ত্রের মুখে নারীর শ্লীলতাহানিও ঘটাইতেছে। পুলিশের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত জানুয়ারিতে সমগ্র দেশে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২৯৪ জন। এই সময়ে ১৭১টি চুরি, ৭১টি ডাকাতি, ১০৫টি অপহরণ এবং ১ সহস্র ৪৪০ জন নারী- শিশু নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। গত বৎসর একই সময়ে হত্যার শিকার হন ২৩১ জন, ডাকাতি ২৯, চুরি ১৪১, অপহরণ ৪৩ এবং নারী ও শিশু নিপীড়নের ঘটনা ঘটে ১ সহস্র ৪৩টি। স্পষ্টত, গত বৎসরের জানুয়ারি অপেক্ষা এই জানুয়ারিতে সকল প্রকার অপরাধই বৃদ্ধি পাইয়াছে। শুধু ইহা নহে; অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান দিয়া সমাজের প্রকৃত চিত্র অনুধাবন কঠিন। কারণ, ঘটনার শিকার হইয়াও অনেকে মামলা করিতে চাহেন না। মামলা হইলেও পুলিশ গড়িমসি করে। উপরন্তু অভিযোগ, একাদিক্রমে অপরাধমূলক তৎপরতার তথ্যপ্রাপ্তির পরও পুলিশের কাহারও কাহারও মধ্যে রহিয়াছে আত্মতুষ্টির ছাপ। কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হইলেই উহা লইয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হইতেছে। এমনকি রাজধানীর অধিকাংশ থানায় নূতন মুখ হওয়ায় তাহারা এখনও এলাকাভিত্তিক অপরাধী এবং গোয়েন্দা তথ্য না রাখায় অকুস্থলে যথাসময়ে উপস্থিত হইতে পারেন নাই। ফলস্বরূপ, জেল হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া পুনরায় অনেককে বড় অপরাধ সংঘটনে সংশ্লিষ্ট হইতে দেখা যাইতেছে।
শনিবার পুলিশ সদরদপ্তর জানাইয়াছে, সমগ্র দেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এ গত ১৪ দিনে সাকল্যে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৮ সহস্রাধিক। অন্যান্য মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি গ্রেপ্তার হইয়াছে ৫৭২ জন। এতৎসত্ত্বেও অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধি পাইল কেন? সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর হিসাবেই সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলিয়াছেন, অভিযানের মধ্যেও অপরাধমূলক তৎপরতা ইঙ্গিত দেয়– ততটা কার্যকরী অভিযান হইতেছে না। অপরাধ প্রতিরোধে চলমান কার্যক্রম আশানুরূপ নহে। এই প্রসঙ্গে অপরাধ বিশ্লেষক ড.
জুলাই আন্দোলনের সময় বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি হইতে ৫ সহস্র ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়। সেই অস্ত্রগুলির মধ্যে এখনও বেহাত ১৩ শতাধিক অস্ত্র। লুণ্ঠিত অনেক অস্ত্র পেশাদার অপরাধীদের হস্তগত হইয়াছে বলিয়া ধারণা করা হইতেছে। এহেন প্রেক্ষাপটে অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়াই স্বাভাবিক।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এহেন অবনতি এমন সময়ে ঘটিতেছে যখন খোদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সাম্প্রতিক ডিসি সম্মেলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় শক্ত হস্তে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলিয়াছেন। ইহার অর্থ প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ বা আহ্বান মাঠে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হইতেছে না, যাহা দুঃখজনক। আমাদের প্রত্যাশা, পুলিশের দুই কর্মকর্তার সমকালকে প্রদত্ত বক্তব্য অনুযায়ী, বিভিন্ন বাহিনীর সহিত আরও কার্যকর সমন্বয়ে অভিযান পরিচালনার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হইবে। এই বিষয়ও বিবেচনায় রাখিতে হইবে, শুধু বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার যদি চলমান অভিযানের উদ্দেশ্য হয়, তাহা হইলে আটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইবে বটে, প্রকৃত কার্যসিদ্ধি হইবে না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অপর ধ ই সময় হইত ছ সহস র চলম ন
এছাড়াও পড়ুন:
তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।
মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।
সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।
প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।
আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।
মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।