বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে একটি ‘অভূতপূর্ব’ ঘটনা ঘটছে। ঘটনাটি ঘটছে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের করা রিভিউ আবেদনের শুনানিকে কেন্দ্র করে। জামায়াতের পক্ষ থেকে আজহারুলের মুক্তির দাবির মধ্যে এ ঘটনা নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি করেছে। 

২৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো.

আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগ আজহারুলের করা রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য ২৫ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন। রিভিউ আবেদন শুনানির বিষয়টি উত্থাপন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। (প্রথম আলো অনলাইন, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)

মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আজহারুলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা চলাকালে তাঁর পক্ষের আইনজীবী ছিলেন তাজুল ইসলাম। গত ৫ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার তাজুল ইসলামকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেয়। এর ফলে আজহারুলের বিরুদ্ধে মামলায় তাজুল ইসলামের সংশ্লিষ্টতা ‘স্বার্থের সংঘাত’ (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) তৈরি করেছে কি না এবং তিনি পেশাগত আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন কি না—এমন প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের একাধিক আইনজীবী।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি মামলায় একজন আইনজীবী কখনো পক্ষ পরিবর্তন করতে পারেন না। অর্থাৎ কখনো বিবাদীর পক্ষে থাকলে আবার পরে বিবাদীর বিপক্ষে যেতে পারেন না। রাষ্ট্রপক্ষ বা কোনো ট্রাইব্যুনালের আইনজীবীর ক্ষেত্রেও এটা একইভাবে প্রযোজ্য।’

শাহদীন মালিক আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলো খুবই স্পর্শকাতর। তাই এ মামলায় আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিল। আজহারুলের মামলার ক্ষেত্রে কোনো আইনজীবী পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচারবিধি লঙ্ঘন করেছেন কি না, তা বার কাউন্সিলের যাচাই-বাছাই করে দেখা উচিত।’ 

‘অভিভাবক সংস্থা’ হিসেবে আইনজীবীদের পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচারের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচার বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের (মক্কেলের প্রতি আচরণ) ২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান মক্কেল কিংবা পুরাতন মক্কেলের মামলা পরিচালনাকালে একজন আইনজীবী যদি মামলা-সংক্রান্ত কোনো গোপনীয় তথ্যাদি সম্বন্ধে অবগত হইয়া থাকেন, তবে উক্ত আইনজীবী উক্ত তথ্য নির্ভর কোনো মামলায় উক্ত মক্কেলের বিপক্ষে আইনজীবী হিসেবে নিয়োজিত হইতে পারিবেন না।...’

একই অধ্যায়ের ৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘একজন আইনজীবী পরস্পরবিরোধী কোনো ব্যাপারে কোনো মক্কেলের প্রতিনিধিত্ব করিতে পারিবেন না।’  

মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন আজহারুল। এই আপিলের ওপর শুনানি শেষে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজহারুলের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ রায় দেন।

লক্ষণীয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর বাদী হিসেবে থাকেন চিফ প্রসিকিউটর। এ কারণে আজহারুলের রিভিউ শুনানিতে তাজুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ না করলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিনি এখন এই মামলার বাদী। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে মামলাগুলোতে তিনি বিবাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন, চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি হয়ে গেছেন বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী।

আজহারুলের মামলায় তাজুল ইসলামের সংশ্লিষ্টতা একটি ‘অভূতপূর্ব’ পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং তা বার কাউন্সিলের পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচারবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে
বলেন, যে বা যাঁরা আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন, তাঁদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় বিষয়টি নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে। তাঁদের এই নিয়োগ নৈতিকভাবে সঠিক হবে কি না কিংবা ‘স্বার্থের সংঘাত’ তৈরি করবে কি না, অন্তর্বর্তী সরকারের আগেই তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল।

তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ রায় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার অভিযোগ করা হয়েছিল। তবে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে তিনি সেই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। (প্রথম আলো, ৫ মে ২০১৫)

তাজুল ইসলাম জামায়াতঘনিষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ট্রাইব্যুনালে যেসব জামায়াত নেতার বিচার হয়েছিল, তাঁদের অনেকের আইনজীবী হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। ২০১৯ সালে জামায়াতের ‘সংস্কারপন্থীরা’ জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ নামে নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করেন। এক বছর পর ২০২০ সালে এবি (আমার বাংলাদেশ) পার্টি গঠনের ঘোষণা দেন তাঁরা। তাজুল ইসলাম ছিলেন এই দলের যুগ্ম আহ্বায়ক। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন।

আজহারুলের মামলার ঘটনাক্রম

মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন আজহারুল। এই আপিলের ওপর শুনানি শেষে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজহারুলের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ রায় দেন। 

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন তিনি। ২০২৫ সালের ২৩ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রিভিউ শুনানির জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি দিন রাখেন। তবে তাঁর রিভিউ আবেদনের শুনানি শুরু হয় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। আজহারুল বর্তমানে কারাগারে আছেন।

আজহারুলের মুক্তির দাবি ও ‘আদালত অবমাননা’

আজহারুলের মুক্তির দাবিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে তাঁর দল জামায়াত। একই দাবিতে ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে ‘গণ-অবস্থান’ কর্মসূচি দেয় জামায়াত। এদিকে আজহারুলের মুক্তির দাবিতে সেদিন স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন দলটির আমির শফিকুর রহমান। তবে ২৪ ফেব্রুয়ারি দুটি কর্মসূচিই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। 

সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন একটি বিষয়ে এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। 

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের রায় নিয়ে কারও অসন্তোষ থাকলে সেটারও আইনি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। রিভিউ খারিজ হলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে আবেদন করা যায়। কিন্তু সে পথে না গিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যা আদালত অবমাননার শামিল।’

মনজুরুল ইসলামপ্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আজহ র ল র ম ক ত র দ ব ত জ ল ইসল ম র ম নবত ব র ধ ন আজহ র ল প রথম আল ন আইনজ ব র আইনজ ব

এছাড়াও পড়ুন:

শারীরিক শাস্তি শিশুর বিকাশে বড় বাধা, বিলোপ জরুরি

শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রচলিত এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য সহিংসতা। ইউনিসেফ জানাচ্ছে, বিশ্বে প্রতিবছর ১ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি শিশু শারীরিক শাস্তির শিকার হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৮৯ শতাংশ শিশু জরিপ–পূর্ববর্তী এক মাসের মধ্যে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে।

জরিপে আরও দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিশুকে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধ করতে ২০১১ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তারপরও শিশুরা শিক্ষকদের হাতে মারধর ও অপমানের শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদিতেও শিশুদের শাস্তি দেওয়া হয়।

শারীরিক শাস্তি বলতে এমন শাস্তিকে বোঝায়, যেখানে কোনো না কোনো মাত্রার ব্যথা বা অস্বস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে শারীরিক বল প্রয়োগ করা হয়। নিষ্ঠুর ও অবমাননাকর আচরণ এ ধরনের শাস্তির অন্তর্ভুক্ত। শাস্তি শিশুর মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এবং নিঃসন্দেহে শিশু অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন।

শাস্তির নামে নিত্যদিনের সহিংসতা প্রতিবছর হাজার হাজার শিশুর আঘাত ও মৃত্যুর কারণ হয়। শাস্তির ব্যাপক সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে, শিশু প্রতিপালনে কিছুটা সহিংসতা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটি সমাজে শিশুদের অধস্তন অবস্থান তুলে ধরে এবং অন্যান্য ধরনের সহিংসতার পথ তৈরি করে দেয়। সমাজের সবচেয়ে ছোট ও সবচেয়ে অরক্ষিত সদস্য হিসেবে শিশুদের নির্যাতন থেকে কম নয়; বরং বেশি সুরক্ষা পাওয়া উচিত।

শারীরিক ও মানসিক শাস্তির কুফল

গ্লোবাল পার্টনারশিপ টু অ্যান্ড ভায়োলেন্স এগেইনস্ট চিলড্রেন প্রকাশিত ‘করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন: সামারি অব রিসার্চ অন ইটজ ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনস’ (অক্টোবর, ২০২১) জানাচ্ছে, ৩০০টির বেশি গবেষণা শাস্তির সঙ্গে অসংখ্য নেতিবাচক ফলের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করেছে। কোনো গবেষণায় শাস্তির কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।

শাস্তি শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামগ্রিক বিকাশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শৈশবের এই দৈনন্দিন সহিংসতা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে আক্রমণাত্মক মনোভাব, অপরাধপ্রবণতা ও অসামাজিক আচরণের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।

শাস্তি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা

বাংলাদেশের মা-বাবা, শিক্ষকসহ অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা রয়েছে যে শাস্তি শিশুদের সঠিক আচরণ করতে শেখায়। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। বড়রা যখন শিশুদের কিছু শেখানোর নামে মারধর অথবা বকাবকি করেন, তখন শিশুরা শুধু শাস্তি এড়ানোর জন্যই কোনো আচরণ করতে শেখে। কিন্তু তারা এর কারণ উপলব্ধি করে না। এর ফলে পরবর্তী সময়ে তারা পুনরায় একই আচরণ করে। শেখানোর কৌশল হিসেবে শাস্তি একটি অকার্যকর পদ্ধতি।

গবেষণায় প্রমাণিত যে শিশুদের বেড়ে ওঠায় শাস্তি নয়, প্রয়োজন ভালোবাসা এবং বয়স অনুযায়ী নির্দেশনা।

সমাজে সহিংসতার চক্র ভাঙতে হলে শাস্তি বিলোপ করতে হবে

মা-বাবা এবং শিক্ষকদের শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। তাঁরা যখন শাস্তি দেন, তখন শিশুরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে নির্যাতনকে স্বাভাবিক মনে করে, মেনে নিতে শেখে। শাস্তি পাওয়া শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নিজেরাও নির্যাতন করবে অথবা নির্যাতনের শিকার হবে—এমন আশঙ্কা বেড়ে যায়। আমরা যদি শিশুদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ না করি, তাহলে সমাজে সহিংসতার চক্র ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

৬৮টি দেশ সব ক্ষেত্রে শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করেছে

৪০ বছর আগে শুধু সুইডেন ও ফিনল্যান্ড শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন পাস করেছিল, কিন্তু আজ ৬৮টি রাষ্ট্র শিশুদের সুরক্ষায় এবং তাদের অধিকার সমুন্নত রাখতে সব ক্ষেত্রে (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন করেছে। বাংলাদেশ এখনো এ তালিকায় নেই।

যখন আইন বাস্তবায়িত হয়, তখন সমাজে শারীরিক শাস্তির গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যবহার এবং অন্যান্য ধরনের সহিংসতা ক্রমাগত হ্রাস পায়। সুইডেন এর একটি উদাহরণ।

চাই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

প্রায়ই শোনা যায় যে মা-বাবা ও শিক্ষক কর্তৃক শাস্তি প্রদান আমাদের সমাজে বহুদিন ধরেই চলে আসছে এবং এটি এখানে সাধারণ চর্চা। অনেকে এমনও দাবি করেন যে তাঁরা আজ যে অবস্থানে আছেন, শাস্তি না দিলে তাঁরা সে জায়গায় আসতে পারতেন না! মা-বাবা তাঁদের শাস্তি না দিলে তাঁরা কেমন মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতেন, সেটা কিন্তু কেউ জানে না।

আগে প্রচলিত ছিল বলেই আমরা কোনো আচরণ অব্যাহত রাখব, তা হতে পারে না, বিশেষত যখন জানি যে সেটা শিশুদের জন্য ক্ষতিকর।

সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলেই চোখের সামনে শিশুদের শাস্তি পেতে দেখলেও কেউ কিছু বলেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ‘ঠাট্টা’ করে শিশুদের শাস্তি দেওয়ার কথা কোনো মা-বাবা পোস্ট করেন। যাঁরা অন্য অনেক বিষয়ে সংবেদনশীল এবং নানা ধরনের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করেন, তাঁদেরও শিশুদের শাস্তি নিয়ে অসংবেদনশীল আচরণ করতে দেখা যায়।

শিশুদের শাস্তি বিলোপে সুপারিশ

প্রাপ্তবয়স্কদের মতো শিশুদেরও আইনের দ্বারা সহিংসতা থেকে সুরক্ষিত থাকার সমান অধিকার রয়েছে এবং এর মধ্যে শাস্তি থেকে সুরক্ষাও অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের সব দেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ১৬.২-এ শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিশুদের প্রতি শাস্তি বিলোপে বাংলাদেশে যা করণীয়

সব ক্ষেত্রে (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান) শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন; নীতিমালা, কর্মসূচি ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে আইনি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা এবং এর বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধকরণে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছে, তার বাস্তবায়ন ও মনিটরিং; শাস্তি না দিয়ে ইতিবাচকভাবে শিশুদের বড় করা ও শিক্ষা প্রদান সম্পর্কে মা-বাবা এবং শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানো; জাতীয় পর্যায়ে এসডিজি সূচক ১৬.২.১ অন্তর্ভুক্ত করে অগ্রগতি পরিমাপ করা; শিশুদের মতামতকে সম্মান প্রদর্শন করা এবং শাস্তি বন্ধের প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে শিশুদের কথা শোনা।

লায়লা খন্দকার: উন্নয়নকর্মী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে গুরুত্ব আরোপ
  • অফিসে ঢুকে প্রধান শিক্ষককে জুতাপেটা করার অভিযোগ
  • মাওলানা রঈস উদ্দিন হত্যার বিচার দাবি ১০৪ নাগরিকের
  • গোবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি
  • শারীরিক শাস্তি শিশুর বিকাশে বড় বাধা, বিলোপ জরুরি
  • সন্তানের বন্ধু হতে চাইলে
  • সবুজ এলাকায় পুলিশের প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার কম হয়
  • গোবিপ্রবিতে কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলাবিষয়ক কর্মশালা শুরু
  • মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা সম্পৃক্ত করা দরকার: শিক্ষা উপদেষ্টা
  • মেয়েদের সবকিছুতেই জ্বালা: রাতাশ্রী