দেশে পুরকৌশলবিষয়ক সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা ‘ইন-জিনিয়াস’। জিপিএইচ ইস্পাত ও প্রথম আলো যৌথভাবে এ আয়োজন করে। এ আয়োজনের একাডেমিক পার্টনার ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি)। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগ কার্যক্রমটি সমন্বয় করে।

পুরকৌশলের শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতা বাড়াতে এবং আন্তর্জাতিক মানের কাঠামো-নকশার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই এ প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে পড়ুয়া এবং সদ্য স্নাতক শিক্ষার্থীরা দলীয়ভাবে এতে অংশ নেন।

এবার ‘জিপিএইচ ইস্পাত–প্রথম আলো ইন-জিনিয়াস ২০২৪’ প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) দল ‘স্ট্যাবল স্ট্রাকচার’। প্রথম রানার্সআপ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ‘ফিউশন ট্রিনিটি’। দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়েছে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ‘রুয়েট জেনেসিস’। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) মিলনায়তনে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার হিসেবে ক্রেস্ট, মেডেল, সনদ ও নগদ অর্থ তুলে দেওয়া হয়েছে।

এবারের সেরারা

ভবন নির্মাণসংক্রান্ত পড়ালেখার ক্ষেত্রে ক্লাসরুমের শিক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য থাকে। সেই পাথর্ক্য সম্পর্কেই আরও ভালোভাবে জানার সুযোগ পান ইন-জিনিয়াসের প্রতিযোগীরা। স্ট্যাবল স্ট্রাকচার দলের সদস্য মো.

ওয়ালিউল ইসলাম, সৌরভ সাহা ও মো. তানজিমুল হাসানের সঙ্গে এ নিয়েই কথা হচ্ছিল। ওয়ালিউল বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম এলাকার একটি ৯ তলা ভবনের নকশা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের বিল্ডিং কোড মেনে কীভাবে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ও পরিবেশবান্ধব ভবন তৈরি করা যায়, সেটাই ছিল কাজের বিষয়।’ দলের আরেক সদস্য সৌরভ সাহা বলেন, ‘আর কিছুদিন পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করে পেশা জীবনে প্রবেশ করব। বাস্তবে কীভাবে ডিজাইন করা হয়, কীভাবে ভবন নির্মাণ করা হয়, অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা কীভাবে কাজ করেন—এসব নিয়েই অনেক কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি। কীভাবে প্রজেক্ট তৈরি করতে হয়, কীভাবে তা উপস্থাপন করতে হয়, ভবন তৈরিতে কেমন টাকাপয়সা লাগে, এমন অনেক বাস্তবিক জ্ঞান লাভের সুযোগ হয়েছে।’

আরও পড়ুনবুয়েটের শিক্ষার্থীরাই পেলেন সব কটি পুরস্কার২১ এপ্রিল ২০২৪পেশাদারদের কাছ থেকে শেখার সুযোগ

জিপিএইচ ইস্পাত-প্রথম আলো ইন-জিনিয়াস প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন কর্মশালারও আয়োজন করা হয়। এসব কর্মশালায় পেশাজীবী বিশেষজ্ঞরা তাঁদের ভাবনা শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরেন। শিক্ষার্থীরাও নিজেদের নকশা ও আইডিয়া উপস্থাপন করেন। প্রথম রানার্সআপ দল ফিউশন ট্রিনিটির সদস্য তানজিদ হাসান, আম্মার বিন গোলাম মোস্তফা ও তানভীর আহমেদ। তানজিদ হাসান বলেন, ‘সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রথম থেকে আমরা থাকতে পারিনি। বুয়েটে পরীক্ষা শেষ করে তারপর আসতে হয়েছে। প্রকৌশলের পড়াশোনায় ক্লাস-পরীক্ষা ও মাঠের কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। এসব কারণে পেশাজীবনের শুরুতেই পুরকৌশলীরা একরকম ধাক্কা খান। আমরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অনেক নিয়মকানুন শিখেছি।’ আরেক সদস্য তানভীর আহমেদ বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি এই প্রতিযোগিতার কারণে স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের বিভিন্ন বাস্তবধর্মী দিকের ব্যাপারে জানতে পেরেছি। এ রকম প্রতিযোগিতা আরও আয়োজন করা দরকার।’

নতুন বন্ধু পেয়েছি

শুধু জানা-শেখাই নয়, বন্ধুত্ব ও নেটওয়ার্কিংয়ের একটি বড় প্ল্যাটফর্মও এ প্রতিযোগিতা। এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল দ্বিতীয় রানার্সআপ রুয়েট জেনেসিসের সঙ্গে। দলের সদস্য মো. সামিউল ইসলাম, শরিফুল হক ও কামরুল হাসান হিমেল চৌধুরী। কামরুল বলেন, ‘আমরা ক্লাসরুম থেকে অনেক কিছু শিখি। এই শিক্ষা ভবিষ্যতে চাকরিজীবনে প্রবেশের পর প্রয়োগের সুযোগ থাকে। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেই অভিজ্ঞতাই পাওয়ার সুযোগ হলো। অনেক নতুন বন্ধু পেয়েছি। প্রকৌশলী কমিউনিটির সঙ্গেও একটা যোগাযোগ হলো। প্রতিযোগিতার জন্য অনেক রাত জেগে কাজ করেছি আমরা। দেখা গেছে, সারা রাত ধরে ডিজাইন করে সকালে আবার তা বদলে ফেলেছি। সারা রাত কাজ করে আবার সকাল আটটার ক্লাসরুমে ঠিকই হাজির ছিলাম। দারুণ একটা চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু শেখাও হলো।’ শরিফুল হক বলেন, ‘এই প্রতিযোগিতা আসলে পুরোটাই ব্যবহারিক। আমরা থিওরিতে অনেক কিছু শিখি, কিন্তু এ ধরনের প্রতিযোগিতা আমাদের সামনে বাস্তব সমস্যা হাজির করে। শুরুতে অনেক কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কারণ, ক্লাসে পড়েছি এক রকম, কিন্তু নিয়মকানুন বলে আরেক রকম। এ সমস্যা সমাধান করতে আমরা অনেককে বিরক্ত করেছি। শিক্ষক আর সিনিয়রদের কাছে বারবার গিয়েছি। নানা চ্যালেঞ্জ জয় করতে হয়েছে।’

পুরস্কার নয়, এসব চ্যালেঞ্জ জয়ের আনন্দই এই প্রতিযোগিতা থেকে শিক্ষার্থীদের বড় প্রাপ্তি।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইন জ ন য় স র ন র সআপ অন ক ক ছ সদস য প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।

সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।

জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’

ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।

জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।

জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ