তিন বছর বয়সে বাবা মারা গেছেন। ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। দুই বছর পর স্বামীর মৃত্যু হয়। পেটের সন্তান স্বামী দেখে যেতে পারেননি। ছেলের বয়স এখন ৩৬ বছর। ছেলেটা বিয়ে পাস করেছেন; কিন্তু বেকার। মাহমুদা (৫৪) ভোরে উঠে সবজির আড়তে যান। রাত ১২টা পর্যন্ত ফুটপাতে সবজি বেচেন। ৩৬ বছর ধরে একাই লড়াই করে যাচ্ছেন তিনি। মাহমুদার প্রশ্ন, ‘সারা জীবনই কি মানুষের কষ্ট থাকে?’

রাজশাহী নগরের অলকার মোড় এলাকায় ফুটপাতে রাতে সবজির দোকান নিয়ে বসেন মাহমুদা বেগম। গত শনিবার রাতে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হয়, বসে থাকতে থাকতে ঘুমে ঢলে পড়ছিলেন। আবার ধড়মড় করে উঠে বসেন। আশপাশে তাকিয়ে দেখেন কোনো ক্রেতা আছে কি না। আড়মোড়া ভেঙে উঠে কাউকে দেখলেই বলছেন, ‘নেন কী নেবেন, নেন।’ তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে ১১টা। সবজি শেষ হয়নি। তাই অপেক্ষা করছেন। কিন্তু সারা দিনের ক্লান্তি তাঁর চোখে ভর করছে। তিনি আর বসে থাকতে পারছেন না।

মাহমুদার নিজের ডায়াবেটিস এখন ৩৬ পয়েন্ট (মিলি মোল/লিটার)। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার সময় হয় না। তবে মায়ের প্রতিদিন ৫০০ টাকার ওষুধ লাগে। খাওয়ার টাকা না হলেও মায়ের ওষুধের টাকার জোগাড় করতেই হয়। মাহমুদার কথা, ‘মা যেন হামাক ছেড়ে না যায়। হামি দুঃখী মানুষ।’

বয়স কত বলতে পারেন না। বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বছর তাঁর জন্ম হয়েছে। থাকেন রাজশাহী শহরের শিরোইল কলোনি এলাকার একটি খুপরিতে। বাবার বাড়ি ছিল জয়পুরহাটের জাফরপুর গ্রামে। বললেন, ‘কোথায় থাকি, দেখলে বুক ফাইটি যাবি। কোনোরকমে লাকাই থাকি। ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। ১৪ বছরের মাথায় স্বামী মারা যায়। ছেলের মুখ দেখে যেতে পারেনি। রিকশা চালাত। ট্রাকের সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কোথাও যেতে পারিনি। মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে ছেলেকে মানুষ করছি। ছেলে বিএ পাস করেছে।’

মাহমুদা বলেন, আট বছর ধরে আর মানুষের বাড়িতে কাজ করেন না। ভোরে উঠে নগরের খড়খড়ি পাইকারি বাজার থেকে সবজি কিনে দিনের বেলায় এক জায়গায় বিক্রি করেন। রাতে এশার নামাজের পর এসে নগরের অলকার মোড়ে সবজি নিয়ে বসেন। তিনি দুঃখ করে বলেন, তিন বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর মা মানুষের বাড়িতে বাড়িতে ঢেঁকিতে ধান ভেনে তাঁদের চার ভাইবোনকে মানুষ করেছেন। তাঁর ছেলেটার চাকরির ব্যবস্থা হয়নি।

মাহমুদা পৈতৃক জমির ভাগ পেয়েছিলেন ৪ শতাংশ। বিক্রি করে রেলওয়েতে ছেলের চাকরির জন্য এক লোককে টাকা দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, চাকরি হলে বাড়িঘর করতে পারবেন। কিন্তু চাকরি হয়নি। এখন জমিও নেই, টাকাও নেই, সেই লোকও নেই। কোথায় যে গেছেন, খুঁজে পাচ্ছেন না। এখনো সেই কষ্টেই আছেন। মাহমুদা বলেন, ‘নিজের চোখে হামার কষ্ট দেখলে কাকা আপনিও বসে কানবেন। হামি কানছি, হামার ছেলে কানছে, আমার মা কানছে। হামরা তিনডা মানুষ খালি কান্দি।’

ছেলের বিয়ে দিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে বললেন, ‘বয়স ৩৬ হয়েছে। ওর তো একটা জীবন আছে। ছেলে বিয়ে করবে না। জোর করে দিয়েছি। পাঁচ বছরের একটা নাতি আছে। ছেলে বেকার। দু-একটা টিউশনি করে।’

রাত প্রায় ১২টা বাজতে যাচ্ছে। তখনো কলার কাঁদির অর্ধেক অবিক্রীত। একটা বাঁধাকপি আছে। কয়েক কেজি টমেটো থেকে গেছে। সব একে একে বস্তায় ভরতে ভরতে মাহমুদা আবার বললেন, ‘হামি একটা দুঃখিনী। এখন মা হামার কাছে আছে। প্রতিদিন মায়ের ৫০০ টাকার ওষুধ লাগে। এক দিন ওষুধ না পাইলেই কান্দে। তাই মায়ের ওষুধের টাকাডা জোগাড় করতেই হয়। নিজের ডায়াবেটিস ৩৬।’ তিনি আরও বললেন, ‘এখন মাপলেও ৩৬ পাবেন। মাঝেমধ্যেই হাত-পা কাঁপে, পড়ে যাই। আবার উঠি।’

নিজের চিকিৎসা করান কি না, জানতে চাইলে মাহমুদা উল্টো প্রশ্ন করলেন, ‘ট্যাকা পাব কোথায়? আর মেডিকেল যাওয়ার সময়ও হয় না। সেই ভোরে উঠি আর রাত ১২টায় দোকান গোছাই।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বছর বয়স বলল ন র বয়স

এছাড়াও পড়ুন:

চুরির অপবাদে ব্যবসায়ীকে গাছে বেঁধে পেটালেন মহাজন

শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায় সুদের টাকা দিতে না পারায় এক ব্যবসায়ীকে গরু চুরির অপবাদ দিয়ে গাছে বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে মহাজনের বিরুদ্ধে। এর একটি ভিডিও সোমবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। উপজেলার খরিয়া কাজীরচরের ভাটি লঙ্গরপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, খরিয়া কাজীরচরের ভাটি লঙ্গরপাড়া গ্রামের মাদ্রাসা পিয়ন ও ব্যবসায়ী নূর আমিন (৩৮) একই এলাকার সুদে কারবারি আব্দুল জলিলের কাছ থেকে মাসিক ১০ হাজার টাকা সুদের শর্তে ১ লাখ টাকা নেন। তিনি ১০ হাজার টাকা করে চার মাস সুদ দিয়ে আর দিতে পারছিলেন না। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। লাঞ্ছিত করা হয় ব্যবসায়ীকে।

জলিল মারধরের অভিযোগ এনে নূর আমিনের বিরুদ্ধে আদালতে নালিশও করেন। যদিও নূর অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন। কিছুদিন পর ভুক্তভোগীর একটি মোটরসাইকেল আটকে রাখেন জলিল। এ নিয়ে নূর আমিন থানায় অভিযোগ দেন। এর পর তাদের সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। এরই মধ্যে রোববার কয়েকজনকে পাঠিয়ে তাঁকে লঙ্গরপাড়া বাজার থেকে ধরে আনেন জলিল।

এক পর্যায়ে গরু চুরির অপবাদ দিয়ে তাঁকে বাড়ির গাছে বেঁধে ব্যাপক নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, বাড়ির সবাই মিলে তাঁকে লাঠিপেটা করেন। শরীরের কাপড়ও ছিঁড়ে ফেলা হয়। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, দুই হাত গাছে বাঁধা নূরের। এক নারী জামার কলার ধরে তাঁকে নির্যাতন করছেন।

নূর আমিনকে মারধরের সময় বলতে শোনা যায়, ‘এ ... একটা গরু চোর, তাই ধইরি (ধরে) বান্ধিছি। মাইনষের টাইন (কাছ থেকে) ট্যাহা নিছে। আংগর টাইন ৬ লাখ ট্যাহা নিছে।’ 

ঘটনা জানাজানি হলে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আশরাফুল কবীর রূপা ঘটনাস্থলে যান। তিনি দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা করে বিষয়টি সুরাহা করেন। বিএনপি নেতা বলেন, ‘সেখানে শত শত মানুষ ছিল। দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলে আগামী আগস্ট মাসে টাকা ফেরত দেওয়ার শর্তে নূরকে মুক্ত করি।’ 

অভিযুক্ত আব্দুল জলিলের ভাষ্য, ‘অনেক দিন ধরে দেড় লাখ টাকা পাই। তাঁকে বাজার থেকে ধরে এনেছিলাম, নির্যাতন করা হয়নি। বাড়ি আনার পর খারাপ আচরণ করায় বেঁধে রেখেছিলাম। নেতারা সমঝোতা করে দেওয়ায় ছেড়ে দিয়েছি।’

ভুক্তভোগী নূর আলম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘জীবনে কোনোদিন এত অপমান কেউ করেনি। মারধর করেছে, অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছে। সুদের টাকার জন্য এক বছর ধরে আমার মোটরসাইকেল আটকে রেখেছে। টাকাও দাবি করছে। মাসে ১০ হাজার করে চার মাস টাকা দিয়েছি। এখন আসল টাকা পাবেন ৬০ হাজার।’

এ বিষয়ে শ্রীবরদী থানার ওসি মো. আনোয়ার জাহিদ বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। তার আগেই স্থানীয় নেতারা সমঝোতা করেন। ভুক্তভোগীকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ