আমি কি পাস করেছিলাম কখনও, ফেল-এর কথা লিখব? জীবনের যত সংকট, পরীক্ষার নামান্তর যদি হয়, ফেলই তো করেছি সারাবেলা। হয়তো খুব টেনেটুনে উতরে গেছি দুয়েকবার, তা দিয়েই চলছি, তা নিয়েই চালিয়ে নিচ্ছি। আর তা দিয়ে কেটেছে বেলা, চলেছে পরিণতিতে। একবার স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেলে আমার এক শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন, এত ভাবনার কী আছে? ফলাফল তো দুটি– হয় পাস, নয় ফেল। যে কোনো একটা তো হবেই। তাই তো যে কোনো একটা তো হবেই– হয় পাস, নয় ফেল। হয় জীবন, না-হয় মৃত্যু। দুয়ের বাইরে তো জীবন ও জগতে কিছু নেই; সাদা আর কালো দুটি রঙে রাঙিয়ে নিয়েছি চেতনার রং। পান্নাকে করেছি সবুজ, চুনিকে রাঙিয়েছি। ধূসর যা কিছু অস্পষ্ট পাস আর ফেইলের মাঝামাঝি কিছু অস্তিত্ব কই তার? তবু এই জীবন আর মৃত্যু নিয়ে মানুষের কী অক্লান্ত দৌড়ঝাঁপ। অতর্কিতে পাওয়া এক জীবন মানুষ হারাতে পারে অতর্কিতে। তবু কত ভালোবাসা প্রতিটি মুহূর্তের জন্য। কত চুলচেরা হিসাব। হারলাম, না জিতলাম। জিততেই হবে। প্রত্যেকের এ এক অবাস্তব দৌড়। দৌড়.
আমি কি কখনও ফেল করেছিলাম, ফেইলের কথা লিখব। প্রথম ফেল। আসলে পাস-ফেল কি কেবলই একাডেমিক শ্রেণিকক্ষের পরিমাপক? স্কুলের প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠার সময় প্রথম যখন প্রথম হয়ে গেলাম, তখনও এর মর্যাদা বুঝিনি। কাইদাজম, বাড়ির কাছের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে এই নামেই ডাকতাম তখন; বড় হতে হতে জানলাম আসলে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে স্কুলটির নাম ছিল কায়েদ-এ-আজম। ৩০ লাখ প্রাণ ঝরে গেছে, পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েছে নতুন দেশ, স্বাধীন পতাকা, সার্বভৌম সীমানা। তবু নাম আঁকড়ে আছে লোকমুখে, বিকৃত হয়েও। সেই কাইদাজম স্কুলের প্রধান শিক্ষক, কেবল নামটি মনে আছে তাঁর, বিভাদি। শহরের একমাত্র দাঁতের ডাক্তার অনিল দাদুর স্ত্রী, পারিবারিক সম্পর্কের খাতিরেই বোধকরি আমাকে এক পোটলা চীনাবাদাম কিনে দিয়েছিলেন। অমূল্য সেই পোটলা নিয়ে আমার নৃত্য দেখে কে। নাচতে নাচতে মায়ের হাতে গুঁজে দিয়েছি সেই বাদামের পোটলা, জীবনের প্রথম অনাকাঙ্ক্ষিত উপহার। অথচ এর চেয়ে অনেক অনেক মূল্যবান লাল কালিতে ‘১ম’ লেখা টুকরো কাগজটা আমি বুঝিনি তখনও।
পরে বড় হতে হতে জানা হয়েছে জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার প্রয়োজনে, সাফল্য কিংবা ফুটানির প্রয়োজনে ক্লাসে প্রথম হতে হয়। জীবনের পরীক্ষায় পাস করতে হয়। যে পাস করে সময় তার পাসের গাথা নানা রং বাহারে লিখে রাখে, পৌঁছে দেয় ভবিষ্যতের কাছে। কিন্তু ফেল যে করে তার কাছে কেউ জানতে চায় না ফেইলিউরের কারণ। পৃথিবীর ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয় না পরাজিতের কোনো গাথা। তার জন্য কোনো করুণা নেই। মায়া নেই। আক্ষেপ নেই, ক্ষমা নেই। সে ইরেজ হয়ে যায় সময়ের পাতা থেকে।
আমি পাস করেছিলাম কবে যে প্রথম ফেইলের গল্প লিখব। জীবন তো অসংখ্য ফেইলের সমাহার। তবু প্রথম ফেল! জ্যামিতি বক্সে বেতনের টাকা রেখে ক্লাসে ঘোষণা দিয়েছিলাম– এই আমার ব্যাগে কিন্তু টাকা আছে, কেউ নিও না। ফের বারান্দা থেকে ক্লাসে ফিরতেই দেখি টাকা নেই। জ্যামিতি বক্সসহ উধাও। ভয় পেয়েছিলাম বাবার বকাকে। কিন্তু আমাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে সেদিন কিচ্ছুটি বলেননি তিনি। পরদিন সন্ধ্যায় বুঝিয়ে বলেছিলেন, এই দুনিয়া কতটা কঠিন। আমি যে সরলতায় বিশ্বাস করি, আমি না করে গেলে আমার টাকা কেউ নেবে না; সেই সরলতা দিয়ে দুনিয়া চলে না। হ্যাঁ, ফেল তারাই করে, যারা বিশ্বাস করে। সরলতা দিয়ে জটিল পৃথিবী দেখে। আমার জীবনের প্রথম ফেল বোধহয় সেটাই। সেই সরল বিশ্বাসকে হারানো। জীবনকে দেখার দর্শনে ধাক্কা লাগা।
সেই কৈশোরে জানা হয়েছিল জীবন এবং জগৎ সরল নয়, যেমন সরল করে আমি ভাবি। তাই বলে কি জটিল জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে জটিল করে তুলতে পেরেছিলাম যে আমার প্রথম ফেলই শেষ ফেল হবে। পরের জন্য কাষ্ঠাহরণ যাহার স্বভাব– আমি সেই নবকুমার। এই একটু কায়দা করে, চালাকি করে, জটিল করে কেবল পাসের পর পাস করে যাব, নিজেকে এভাবে কেঁচেগণ্ডূষ করা যায় না। কেউ কেউ চাইলেও পারে না। সরল বোকামি অন্তর্গত রক্তে বাস করে। চাইলেই উপড়ানো যায় না। আমিও পারিনি। ফেইলের পর ফেল করে গেছি। বুঝেও ফেল করেছি, না বুঝেও ফেল করেছি। প্রতিটি ফেলকেই ভেবেছি প্রথম ফেল। কিন্তু আত্মদহন হয়নি। ফেইলের ক্ষতিতে ভেঙেচুরে গেছি। জীবনজুড়ে মাশুল দিতে দিতে প্রতিদিন ফেলগুলো দেখি, নিজেকে করুণা করি, বাহবাও দিই। ফেল করেছি, কিন্তু দিন শেষে নিজের কাছে নিজের কিছু কৈফিয়ত নেই। হেরেছি। পরাজিত হয়েছি। ক্ষতি মেনে নিয়েছি। কিন্তু আত্মদহন নেই। সব সময় নিজের সরল বিশ্বাসের কাছেই বিশ্বস্ত থেকেছি। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেইলে আগুন জ্বেলেছি বারে বারে। একলা রাতের অন্ধকারে আলো পেয়েছি ঠিক। পথ হারাইনি।
আমার পুতুলের শাড়ি চুরি করা খেলার সাথীটিকে চোর বলতে পারিনি। আমার পরীক্ষার খাতা দেখে ডিসিপ্লিন রচনা লেখা বন্ধুটি আমাকে না জানা প্রশ্নের উত্তর বলে না দিলে আমি তাকে প্রতারক বলতে পারিনি। আমার নোট নিয়ে পরীক্ষা পাস করা সহপাঠী স্বীকার না করলেও আমি তাকে অকৃতজ্ঞ বলতে পারিনি। প্রেমিকের চাতুর্য ধরতে পেরেও বুঝতে না পারার ভান করে আমি নির্বিকার থেকেছি। সংসারে নিজেকে বিলিয়ে দিতে দিতে ভেবেছি এই ভবিতব্য। প্রতিটি দিন সংগ্রামমুখর। যুদ্ধক্লান্ত। অথচ বাইরের দুনিয়া দেখে আমার বাহ্যিক অবয়ব, অজানা কারণে সেখানে এই যুদ্ধ ক্লান্তি কোনো ছায়া ফেল-এ না। এটাই বোধকরি আমার জিতে যাওয়া। সোকল্ড সাফল্য নামক পাসের খাতায় নাম না লিখেও নিজেকে ফেল না ভাবা, ব্যর্থতার গ্লানি বহন না করা। হ্যাঁ, কোথাও পাস করতে পারিনি। অথচ পারতাম। কী না হতে পারতাম! নিজের প্রকৃতিপ্রদত্ত যোগ্যতা, সামর্থ্য কিংবা পার্থিব সুযোগ একটু কায়দা করে ব্যবহার করা গেলেই জাতে ওঠা যেত, ওঠা যেত সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায়। যাকে এই সমাজ-সংসার সাফল্য বলে। পাসের অন্য নাম।
অথচ বোকার মতো, সরলতার মতো আমি জীবনভর ‘ফেল’ করেই গেলাম। ফেইলে ফেইলে ভরা আমার জীবন। কোথাও কোথাও দিন শেষে ফেইলিউরের অপর নাম পাস। নিজের কাছে নিজের পাস। জীবনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো যে স্বভাব, সে স্বভাবে অবশেষে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় নিজেকে। সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়া মানে জীবন থেকে বিচ্যুত হওয়া। আমি জীবন থেকে বিচ্যুত হইনি। ফেল করে নিজের কাছে নিজে জিতে গেছি। প্রতিবার প্রতিটি ফেলকে ভেবেছি প্রথম ফেল।
‘আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার, জীর্ণ করে একে কোথায় নেবে?’ v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রথম ফ ল ফ ল কর ছ জ বন র প র প রথম স ফল য প স কর পর ক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত
বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ।
সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।
আরো পড়ুন:
একা বাস করতে পারে যে পাখি
কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?
সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।
তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না।
এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস।
তিনি জানেন, প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে। বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।
সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন।
একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।
সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।
চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।
গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা/লিপি