খুলনায় সাড়া ফেলেছে শিক্ষার্থীদের ‘বিনা লাভের দোকান’
Published: 8th, March 2025 GMT
রোজার শুরু থেকেই হঠাৎ করেই বাজারে বেড়ে গেছে কিছু পণ্যের দাম। অসাধু ব্যবসায়ীরা ‘সিন্ডিকেট’ করে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। বাজারের এই সিন্ডিকেট ভাঙতে বিনা লাভের দোকান চালু করেছেন খুলনার শিক্ষার্থীরা। নগরের শিববাড়ী মোড়ে চালু হওয়া ওই দোকানে পাইকারি দামে নিত্যপণ্য ও সবজি বিক্রি করা হচ্ছে।
৩ রমজান থেকে চালু হওয়া এই দোকান ইতিমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সব পণ্য। স্বল্পমূল্যে কিনতে পেরে ক্রেতারাও খুশি। প্রতিদিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দোকান চালু রাখার কথা থাকলেও বর্তমানে বেলা ৩টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দোকান বসছে। দোকানটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিনা লাভের দোকান’। এটির আয়োজন করেছে খুলনার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও টাস্কফোর্স টিম।
আয়োজকেরা বলছেন, রমজানের মাত্র কয়েক দিন আগে যে বেগুন ছিল মাত্র ৩০ টাকা কেজি, সেই বেগুন বর্তমানে ৮০-৯০ টাকা। শুধু বেগুনই নয়, বেড়েছে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও। এসব অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট ভাঙতে ও বাজারে সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে স্বস্তি ফেরাতে বিনা লাভের দোকান খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রমজান মাসজুড়ে এই দোকান চালু থাকবে। এখান থেকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ পণ্য কিনতে পারছেন।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে শিববাড়ী মোড়ে অবস্থিত ওই দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের পাশেই বাঁশ ও সাদা কাপড় দিয়ে দোকানের মতো তৈরি করা হয়েছে। সামনে ব্যানারে লেখা ‘বিনা লাভের দোকান, ক্রয়কৃত দামে পণ্য বিক্রি’। দোকান পরিচালনা করছেন গোটা বিশেক শিক্ষার্থী। দোকানের সামনে বেশ ভিড়। ক্রেতাদের চাহিদামতো পণ্য দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। দুজন ছাত্র হ্যান্ড মাইকে দোকান থেকে পণ্য কেনার জন্য মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছেন। মাইকেই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে দোকানে থাকা পণ্যের দামও।
দোকানে প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা, আলু ১৭ টাকা, শসা ২৫ টাকা, ছোলা ৯৫ টাকা, বেসন ৬৫ টাকা, মুড়ি ৬৫ টাকা, চিড়া ৬০ টাকা, টমেটো সাড়ে ৭ টাকা, কাঁচা মরিচ ৪০ টাকা, রসুন ১০০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৩৫ টাকায়। এ ছাড়া এক লিটার সয়াবিন তেলের বোতল ১৭৫ টাকা, প্রতিটি ডিম ১০ টাকা, বোম্বাই ঝাল প্রতিটি ২ টাকা, লেবুর হালি ২৭ টাকা ও ধনেপাতা চাহিদা মোতাবেক নিতে পারছেন ক্রেতারা।
দোকান থেকে ছোলা, বেগুন ও পেঁয়াজ কিনছিলেন সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার শারমিন আলম। তিনি বলেন, ‘পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখি শিক্ষার্থীরা মাইকিং করে পণ্য বিক্রি করছে। কৌতূহলী হয়ে দোকানে এসে দেখি, পণ্যের দাম বেশ কম। এরপর কয়েকটি পণ্য কিনেছি। তেলের কথা জিজ্ঞাসা করলে বলেছে, তেল শেষ হয়ে গেছে। বাজারের চেয়ে ১৫-২০ টাকা কমে এখানে পণ্য পাওয়া যাচ্ছে।’
দোকানের সামনেই কথা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা মহানগর শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ও খুলনা জেলা টাস্কফোর্স টিমের সদস্য আরিফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে নিজেরা চাঁদা দিয়ে ফান্ড গঠন করে পাইকারি বাজার থেকে পণ্য কেনা হচ্ছে। বাজার থেকে যে দামে পণ্য কিনেছেন, তাঁদের দোকানে সেই দামেই পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। পণ্যের মধ্যে পরিবহন খরচও ধরা হয়নি। আর শিক্ষার্থীরা কাজ করছেন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে।
সংগঠনটির মহানগর শাখার সংগঠক সোহানুর রহমান বলেন, কল্পনার বাইরে সাড়া পাওয়া গেছে। সাধারণ মানুষ এসে পণ্য কিনছেন। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ৩০০-৪০০ ক্রেতা আসছেন। ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে। পণ্যের সংখ্যা ও পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।