ফাইনালের মঞ্চে পিসিবির কাউকে না দেখে অবাক শোয়েব, আসলে যা ঘটেছে
Published: 10th, March 2025 GMT
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির অফিশিয়াল আয়োজক পাকিস্তান। সেই টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছে ভারত। গতকাল দুবাইয়ে ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে ৪ উইকেটে হারায় রোহিত শর্মার দল। কিন্তু পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি।
তাতে নিজের বিস্ময় লুকাতে পারেননি পাকিস্তানের সাবেক ফাস্ট বোলার শোয়েব আখতার। আয়োজক দেশ হয়েও পিসিবির কোনো সদস্য কেন ফাইনালে গেলেন না, সেটা শোয়েবের কাছে বোধগম্য নয়। বিষয়টাকে দুঃখজনক বলেও মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্রুততম ডেলিভারির রেকর্ড গড়া সাবেক এ ক্রিকেটার।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারত নিজেদের সব ম্যাচ খেলেছে দুবাইয়ে। রাজনৈতিকভাবে বৈরী প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে কোনো ম্যাচ খেলতে যেতে রাজি হয়নি ভারত। টুর্নামেন্টটি তাই হাইব্রিড পদ্ধতিতে আয়োজন করা হয়। ভারত ফাইনালে ওঠায় শিরোপা লড়াইয়ের ম্যাচটাও হয়েছে দুবাইয়ে।
আরও পড়ুনশামির মায়ের পা ছুঁয়ে পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ কোহলির১ ঘণ্টা আগেফাইনালের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের কোনো প্রতিনিধি না দেখে বিস্মিত শোয়েব নিজের ফেসবুক পেজে বলেছেন, ‘আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ভারত জিতে নিয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করলাম। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কোনো সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিল না। পাকিস্তান চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আয়োজক দেশ। কিন্তু তাদের একজন লোককেও সেখানে দেখলাম না।’
পুরো বিষয়টা বোধগম্য হচ্ছে না জানিয়ে শোয়েব আরও বলেছেন, ‘এ বিষয়টা আমি বুঝতে পারছি না। তারা কেউ প্রতিনিধিত্ব করতে কিংবা ট্রফি তুলে দেওয়ার জন্য কেন এলেন না। এটা একেবারেই আমার বোধগম্য না। এটা নিয়ে ভাবুন দয়া করে। এটা একটা বিশ্বমঞ্চ, এখানে আপনাদের থাকা উচিত ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কোনো সদস্যকে সেখানে দেখলাম না। অথচ এটার আয়োজক আমরাই, কিন্তু আমাদের কেউ সেখানে থাকল না।
পরে অবশ্য বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআই। সূত্রের বরাত দিয়ে তারা জানিয়েছে, পিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুমাইর আহমেদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাঁকে পুরস্কার বিতরণীর মঞ্চে ডাকা হয়নি।
আরও পড়ুন‘এখনই ওয়ানডে ছাড়ছি না’—চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ের পর রোহিত শর্মা১০ ঘণ্টা আগেসেই সূত্র জানায়, আগে থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে ভিন্ন প্রতিশ্রুতি থাকায় পিসিবি চেয়ারম্যান মহসিন নাকভি দুবাইয়ে যাননি। পিসিবির পক্ষ থেকে সিইওকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো কারণে বা ভুল–বোঝাবুঝিতে তাঁকে মঞ্চে ডাকা হয়নি।
পিসিবির সমালোচনা করলেও শিরোপা জেতা ভারতের দারুণ প্রশংসা করেছেন শোয়েব, ‘সেরা দল ভারতই চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতেছে। এটা বলতে হবে যে টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা দল হিসেবেই তারা শিরোপা জিতেছে। আমার ধারণা, গত ১০ বছরে আইসিসি টুর্নামেন্টে সেরা দল হিসেবেই যে দলটি আবির্ভূত হয়েছে, সেটি ভারত। গত বছরও তারা জিতেছে, এবারও জিতল। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অসাধারণ খেলল তারা। বরুণ এসে দুর্দান্ত খেলল, বিরাট (কোহলি) দারুণভাবে ফিরে এল। বাকি সবাইও দারুণ খেলেছে। তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা। এটা তাদের প্রাপ্য ছিল।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা
মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে প্রায়ই বিজ্ঞান, স্থাপত্য বা শাসনব্যবস্থার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু এর মানবিক দিক অধরা রয়ে যায়। বিশেষ করে দরিদ্রদের প্রতি দয়া ও চিকিৎসাসেবার গল্প আড়ালে রয়ে গেছে সব সময়।
মুসলিম সভ্যতায় কীভাবে দরিদ্র ও অসুস্থদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা, আশ্রয় এবং মানসিক সান্ত্বনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা এক অপূর্ব কাহিনি।
বিমারিস্তান: দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসার আশ্রয়মুসলিম সভ্যতায় দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবায় ‘বিমারিস্তান’ নামের হাসপাতাল ছিল একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। এগুলো শুধু চিকিৎসার জায়গা ছিল না, বরং দরিদ্রদের জন্য বিনা মূল্যে আশ্রয়, খাদ্য ও যত্নের ব্যবস্থা ছিল। বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত নগরে, বিশেষ করে বড় রাজধানীগুলোতে বিমারিস্তান ছিল। দামেস্কে বিমারিস্তানের নাম ছিল ‘নুরি’, বাগদাদে ‘আদুদি’।
প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ (রহ.)প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকের সময়, ৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি এতে চিকিৎসক নিয়োগ করেন এবং তাঁদের বেতনের ব্যবস্থা করেন। সমাজের স্বাস্থ্য রক্ষায় কুষ্ঠরোগীদের জন্য পৃথক স্থানে বিনা মূল্যে খাদ্য ও যত্ন দেওয়া হতো।
অন্ধদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা ও সাহায্যকারী নিয়োগ করা হতো। খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘প্রতিটি অন্ধ বৃদ্ধের জন্য এমন একজন সাহায্যকারী নিয়োগ কর, যে তাকে অত্যাচার বা অবহেলা না করে।’ (ইবনে আসাকির, তারিখে দিমাশক, ৪৪/১২৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)
আরও পড়ুন“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”০১ অক্টোবর ২০২৫ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালও ছিল, যা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হতো। দূরবর্তী অঞ্চলে মহামারি মোকাবিলায় ৪০টি উটের কাফেলায় চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হতো।
মিসরে প্রথম বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় আহমদ ইবন তুলুনের সময়, ৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে, ফুসতাতে। এর নাম ছিল ‘বিমারিস্তান আতিক’।
এর জন্য ওয়াক্ফ তহবিল রাখা হয়েছিল, এবং শর্ত ছিল যে এটি শুধু সাধারণ মানুষের জন্য, সৈন্য বা দাসদের জন্য নয়। এর বার্ষিক খরচ ছিল ৬০ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)। ইবন তুলুন নিজে প্রতি সপ্তাহে এটি পরিদর্শন করতেন এবং জুমার দিনে মুসল্লিদের জন্য জরুরি সেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে ছিল ১ লাখের বেশি বইয়ের গ্রন্থাগার। (মাকরিজি, খিতাত, ২/৪০৫, দারু সাদির, কায়রো, ১৮৫৩)
সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।সালাহউদ্দিন আইয়ুবি বিমারিস্তান ‘নাসিরি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে মিসর ও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বিমারিস্তান ছিল মনসুর কালাউনের প্রতিষ্ঠিত বিমারিস্তান, ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। এখানে নারী-পুরুষ সবার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল, চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সময়সীমা ছিল না। এখানে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো।
সংগীতজ্ঞ ও গল্পকারেরা এখানে রোগীদের মনোবল বাড়াতেন। রাতের দীর্ঘ সময় রোগীদের জন্য কষ্টকর হতো, তাই ফজরের আজান দুই ঘণ্টা আগে দেওয়া হতো, যাতে রোগীরা সকালের আশায় উৎফুল্ল হয়। ঘরে সুগন্ধি গাছ রাখা হতো, রোগীদের হাতপাখা দেওয়া হতো গরম ও পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য।
সুস্থ হওয়ার পর রোগীদের পোশাক ও কিছু টাকা দেওয়া হতো, যাতে তারা তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে না বাধ্য হয়। এই বিমারিস্তান ২০০ জনের বেশি দরিদ্র রোগীকে বাড়িতে চিকিৎসা দিত। (মাকরিজি, খিতাত, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৭)
দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসাগ্রন্থমুসলিম সভ্যতার চিকিৎসকেরা লক্ষ করেন, চিকিৎসা কখনো কখনো ধনীদের কাছে ব্যবসায় পরিণত হন। তাই তাঁরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তারা নিজেরা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে বা ছোট চিকিৎসকেরা তাদের সহজে চিকিৎসা দিতে পারেন। এই গ্রন্থগুলোয় স্থানীয় ও সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতো; কারণ, ভারত বা চীন থেকে আমদানি করা ওষুধ ছিল দামি।
আরও পড়ুনইসলামে দারিদ্র্য দূরীকরণের ৮টি ব্যবহারিক উপায়০২ নভেম্বর ২০২৫আবু বকর আর-রাজি: তিনি দরিদ্রদের প্রতি অসাধারণ দয়া দেখাতেন এবং তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করতেন। তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন: ‘বুরউ সা’আত’ (তাৎক্ষণিক চিকিৎসা) এবং ‘মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব’ (যার কাছে চিকিৎসক নেই), যাকে ‘তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন’ (দরিদ্রদের চিকিৎসা) বলা হয়।
তিনি লিখেছেন, ‘অনেক চিকিৎসক ওষুধ ও খাবারের কথা লেখেন, যা শুধু রাজাদের ভান্ডারে পাওয়া যায়। আমি সাধারণ ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে চিকিৎসার একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লিখতে চাই, যাতে সবাই এর সুবিধা পায়।’ (আল-রাজি, মান লা ইয়াহদুরুহু তাবিব, পৃষ্ঠা ১৫, দারুল কুতুব, বৈরুত, ১৯৮৫)
মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো।ইবনে জাজ্জার কায়রাওয়ানি: তিনি কখনো দরিদ্রদের কাছ থেকে চিকিৎসার ফি নিতেন না। তিনি তিব্বুল ফুকারা ওয়াল মাসাকিন গ্রন্থে লিখেছেন, ‘দরিদ্ররা স্বাস্থ্য ও রোগ–সম্পর্কিত বইয়ের সুবিধা পায় না। তাই আমি এমন একটি গ্রন্থ লিখলাম, যাতে সহজলভ্য ওষুধ দিয়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করা যায়।’ (ইবনে জাজ্জার, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ১০, দারুল ফিকর, কায়রো, ১৯৯০)
ইবনে আকফানি: তিনি গুনইয়াতুল লাবিব ফি গাইবাতিত তাবিব (চিকিৎসক না থাকলে জ্ঞানীর সম্পদ) গ্রন্থে জরুরি রোগের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য রক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন।
জামালুদ্দিন ইউসুফ মাকদিসি: তিনি ‘তিব্বুল ফুকারা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ধনীরা সুস্বাদু খাবার খায়, তাই তাদের রোগ বেশি। দরিদ্ররা সাধারণ খাবারে সন্তুষ্ট থাকে, তাই তাদের রোগ কম। কিন্তু দরিদ্ররা অসুস্থ হলে তাদের জন্য সহজ ও সস্তা ওষুধ দরকার।’ (মাকদিসি, তিব্বুল ফুকারা, পৃষ্ঠা ৮, দারুল মারিফা, বৈরুত, ১৯৯২)
মুসলিম সভ্যতা দরিদ্রদের চিকিৎসায় অসাধারণ মানবিকতা দেখিয়েছে। বিমারিস্তান ছিল দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হতো। চিকিৎসকেরা দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে তারা নিজেদের চিকিৎসা করতে পারে। এই ঐতিহ্য দেখায়, ইসলামি সভ্যতা কেবল জ্ঞান বা শক্তিতে নয়, মানবিকতা ও দয়াতেও শ্রেষ্ঠ ছিল।
আরও পড়ুনআপনার মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিচ্ছেন তো২১ জুন ২০২৫