পাকিস্তানে গতকাল মঙ্গলবার একটি ট্রেনে হামলা করেছে ‘বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী’। ট্রেনটি বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা থেকে খাইবার পাখতুনখাওয়ার রাজধানী পেশোয়ার যাচ্ছিল। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবিতে সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারা কোয়েটা থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরের সিবি শহরের কাছে একটি টানেলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়।

নিরাপত্তা সূত্রগুলো জানিয়েছে, হামলার পরপরই সামরিক অভিযান শুরু হয়। তবে কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, কিছু যাত্রী নিরাপদে কাছের একটি ছোট স্টেশনে পৌঁছাতে সক্ষম হন। কোয়েটায় পাকিস্তান রেলওয়ের কর্মকর্তা রানা ফারুখ জানান, প্রায় ৭০ জন যাত্রী—এর মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরাও ছিলেন—ছয় কিলোমিটার হেঁটে পানির রেলস্টেশনে পৌঁছান।

ট্রেনটি যখন দুর্গম ও পার্বত্য বোলান পাস অঞ্চল পার হচ্ছিল, তখনই হামলার শিকার হয়। এ হামলা, বর্তমান পরিস্থিতি ও পাকিস্তানের সঙ্গে বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কয়েক দশকের সংঘাতের পেছনের প্রেক্ষাপট কী?

জাফর এক্সপ্রেসে কী হলো

জাফর এক্সপ্রেসে যাত্রী ছিলেন ৪০০ জনের বেশি। তাঁদের মধ্যে বহু নারী, শিশু ও নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। মঙ্গলবার সকাল নয়টায় কোয়েটা থেকে ট্রেনটি দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যে যাত্রা করে। পাঞ্জাব প্রদেশ পেরিয়ে ট্রেনটির পেশোয়ার যাওয়ার কথা ছিল।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয় সময় বেলা একটার দিকে ট্রেনটি বোলান পাস পার হওয়ার সময় হামলা হয়। এই পাহাড়ি অঞ্চলে ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়া অনেক টানেল আছে। আক্রমণকারীরা এ সুযোগই নেয়।

কয়েক বছর ধরে বেলুচিস্তানে একাধিক হামলা চালানো বিএলএ এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।

এক বিবৃতিতে তারা দাবি করেছে, কমপক্ষে ছয়জন সেনাসদস্যকে হত্যা করেছে এবং রেললাইন উড়িয়ে দিয়েছে। এ কারণে ট্রেনটি থেমে যেতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, এ হামলার প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনী কোনো অভিযান চালালে তার ‘ভয়াবহ পরিণতি’ হবে। বিএলএ আরও দাবি করেছে, ট্রেনের যাত্রীদের তারা জিম্মি করেছে। তবে অনেক যাত্রী পরে পানির স্টেশনে পৌঁছাতে পেরেছেন।

এখন পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে প্রাদেশিক সরকারের মুখপাত্র শাহিদ রিন্দ জানিয়েছেন, নিকটবর্তী সিবি শহরের হাসপাতালগুলোয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া যায়।

সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হামলাটির তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি আহত ব্যক্তিদের দ্রুত সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেছেন এবং বলেছেন, ‘নিরীহ যাত্রীদের ওপর যারা হামলা চালায়, তারা কোনো সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য নয়।’

কোয়েটা ও সিবির হাসপাতালগুলোয় সতর্কতা জারি করা হয়েছে, তবে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কোনো আহত যাত্রী সেখানে পৌঁছাননি। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুর্গম পার্বত্য এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক কার্যত অচল। এ কারণে হামলার বিস্তারিত তথ্য দ্রুত পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র অনুযায়ী, হামলাকারীরা কিছু নারী ও শিশুকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এ কারণে ব্যাপক অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে বলে কর্তৃপক্ষ সতর্কবার্তা দিয়েছে।

বেলুচিস্তানে হামলা কেন বাড়ছে

বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় কিন্তু সবচেয়ে অনুন্নত প্রদেশ। প্রায় দেড় কোটি জনসংখ্যার এই অঞ্চল প্রচুর খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী। আছে তামা, প্রাকৃতিক গ্যাসসহ আরও অনেক খনিজ। তবে দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্ব চলছে।

বিচ্ছিন্নতাবাদী বালুচ গোষ্ঠীগুলো স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে আসছে। তারা অভিযোগ করে যে রাষ্ট্র তাদের দমন-পীড়ন করছে এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের গুম করছে। এই সংঘাতের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যোগ করেছে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিইসি)। এ প্রকল্প ৬২ বিলিয়ন ডলারের মেগা প্রজেক্ট। চালু হয়েছিল এক দশক আগে।

অস্থিরতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধসিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্র আর নাগরিকের মাঝে এই বাড়তে থাকা ব্যবধান থেকে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। তারা ব্যাপকভাবে তরুণদের দলে টানতে পারছে। বাড়ছে আত্মঘাতী হামলা।

বিএলএ বারবার চীনা স্বার্থের ওপর হামলা চালিয়েছে, বিশেষ করে গদর বন্দরে, যা সিপিইসির কেন্দ্রবিন্দু। এসব হামলায় বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বেলুচিস্তানে হঠাৎ করেই সহিংসতা বেড়েছে। গত মাসে কালাত শহরে বিএলএর হামলায় কমপক্ষে ১৮ জন সেনা নিহত হন। এ বছরের মার্চে একজন নারী আত্মঘাতী হামলাকারী কালাতেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্যকে হত্যা করেন।

জাফর এক্সপ্রেসও বহুবার হামলার লক্ষ্য হয়েছে। গত বছর বিএলএ রেললাইন উড়িয়ে দেয়। এ কারণে দুই মাসের জন্য ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া নভেম্বরে কোয়েটার রেলস্টেশনে জাফর এক্সপ্রেস লক্ষ্য করে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো হয়, যাতে অন্তত ৩০ জন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন।

বিএলএ কীভাবে আরও শক্তিশালী হয়েছে

বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা এবং পুরোনো কৌশলের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে বিএলএ ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক বেলুচিস্তান–বিশেষজ্ঞ মালিক সিরাজ আকবর বলেন, আগে বিএলএ মূলত ব্যক্তিগত হামলা বা পাইপলাইন ধ্বংসের মতো ছোট আকারের হামলা চালাত। কিন্তু এখন তারা বৃহৎ পরিসরের সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে।

আকবর বলেন, ‘এই গোষ্ঠী এখন যাত্রীবাহী ট্রেনের ওপর আক্রমণ চালানোর মতো বড় হামলা করছে। এটি প্রমাণ করে যে তারা শুধু আগের চেয়ে বেশি সাহসীই হয়নি, বরং তারা বিশ্বাস করে যে সরকার তাদের দমাতে পারবে না। এমনকি হামলার পরও সরকার কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম নয়।’ বেলুচিস্তানবিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক রফিউল্লাহ কাকর জানান, বিএলএ তাদের কমান্ড কাঠামো আরও সংগঠিত করেছে। ফলে মাঠপর্যায়ে যোদ্ধারা সরাসরি অপারেশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন।

রফিউল্লাহ কাকর বলেন, বিএলএ এখন উন্নত অস্ত্র হাতের নাগালে পাচ্ছে। এসব অস্ত্রের কিছু আসছে আফগানিস্তানে ফেলে যাওয়া মার্কিন অস্ত্রের থেকে। ফলে আক্রমণ এখন আগের চেয়ে প্রাণঘাতী ও কৌশলগতভাবে উন্নত হয়েছে।

সরকার কি বালুচদের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছেন রফিউল্লাহ কাকর। তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, শুধু গোয়েন্দা ব্যর্থতা থেকেই যে নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, ব্যাপারটা এমন নয়। এর মূল কারণ হচ্ছে বালুচ নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের বাড়তে থাকা দূরত্ব। কয়েক দশক ধরে বালুচিস্তান প্রদেশ সামরিক বাহিনীর হাতে যেন রাজনৈতিক পরীক্ষার ল্যাবরেটরি হয়ে আছে। গত ১০ বছরে ৬ জন মুখ্যমন্ত্রী বদল হয়েছে এখানে। কোনো কেয়ারটেকার নির্বাচনের বালাই নেই।

এ অস্থিরতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধসিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্র আর নাগরিকের মাঝে এই বাড়তে থাকা ব্যবধান থেকে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। তারা ব্যাপকভাবে তরুণদের দলে টানতে পারছে। বাড়ছে আত্মঘাতী হামলা। আর বালুচরা মনেই করেন যে রাষ্ট্র তাঁদের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করে না।

বালুচিস্তানে এখন যে প্রাদেশিক প্রশাসন, তা আসলে সামরিক বাহিনীর হাতের পুতুল। ইসলামাবাদের ভরসা এই পুতুল সরকার, জনগণ যাদের ভরসা করে না।

আবিদ হুসেইন আল–জাজিরার ইসলামাবাদ প্রতিনিধি

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত র র ওপর সবচ য় ব এলএ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ক্যানসারে আক্রান্ত ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারো

ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর শরীরে ত্বকের ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে। বমি ও নিম্ন রক্তচাপের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার শরীরে ক্যানসারের প্রাথমিক ধাপ ধরা পড়ে। বর্তমানে তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।

বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আনাদোলু এজেন্সি।

আরো পড়ুন:

৬ বছর পর ব্রাজিলকে হারিয়ে বিশ্বকাপ প্লে-অফে বলিভিয়া

মারাকানায় ব্রাজিলের বড় জয়

প্রতিবেদনে বলা হয়, এক সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয়বার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার একদিন পর তার ত্বকের ক্যানসারের প্রাথমিক ধাপ ধরা পড়ে।

বুধবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, তার ত্বকের পরীক্ষা করে ‘স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা’ শনাক্ত হয়েছে।এটি ত্বকের মাঝারি মাত্রার ক্যানসার, যা সবচেয়ে হালকা ও সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ধাপের মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে।

চিকিৎসকরা বলেছেন যে, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হবে। ৭০ বছর বয়সী বলসোনারো গত মঙ্গলবার বমি এবং নিম্ন রক্তচাপের কারণে ব্রাসিলিয়ার একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে ক্যানসারের বিষয়টি গত রবিবারের পরীক্ষায় ধরা পড়ে, যখন তার বুক ও হাতে থাকা ক্ষতস্থানের টিস্যু অপসারণ করা হয়েছিল।

তার অনকোলজিস্ট ক্লাউদিও বিয়ারোলিনি জানিয়েছেন, বলসোনারোর ক্যানসার ‘ইন সিটু’ ধাপে রয়েছে, অর্থাৎ অস্বাভাবিক কোষগুলো এখনো ছড়িয়ে পড়েনি। অস্ত্রোপচারই এর চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট হবে। বর্তমানে বলসোনারোর শরীরে সেলাই ও ব্যান্ডেজ রয়েছে, যা দুই সপ্তাহের মধ্যে খোলা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বুধবার তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরেছেন, যেখানে তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।

বলসোনারো ২০২২ থেকে ২০২৩ সালে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই গৃহবন্দি ছিলেন। সম্প্রতি তাকে ২৭ বছর তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

বিচারপতি আলেকজান্দ্রে দে মোরেসের নির্দেশ অনুযায়ী, গৃহবন্দিত্বে থাকলেও চিকিৎসা জরুরি হলে তিনি বাসার বাইরে যেতে পারেন। তবে প্রতিবারই তার আইনজীবীদের আদালতে চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হয়।

বলসোনারোর সমর্থকরা তার স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছেন, যাতে তিনি কারাগারে না গিয়ে বাড়িতেই সাজা ভোগ করতে পারেন। তাদের দাবি, কারাগারে নিলে তার শারীরিক জটিলতা বা দুর্ব্যবহারের ঝুঁকি বাড়বে।

তার জ্যেষ্ঠ পুত্র সিনেটর ফ্লাভিও বলসোনারো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন, “আমার বাবা আগেও কঠিন লড়াই লড়ে জয়ী হয়েছেন। এবারও ভিন্ন কিছু হবে না।”

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ