‘সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করা যাবে না’ বলে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতারা যে কথা বলে আসছেন, তার কড়া সমালোচনা করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, ‘কিছু লোভী রাজনীতিবিদ আছেন, কিছু লোভী রাজনৈতিক দল আছে, যারা শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে। এই দলগুলো পাকিস্তান সৃষ্টির লগ্ন থেকে, ভারত বিভক্তি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত শুধু বিরোধিতাই করে গেল, দেশপ্রেমের লেশমাত্র তাদের ভেতরে নাই।’

আজ বুধবার বিকেলে শাহজাহানপুর রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাব মাঠে থানা বিএনপি আয়োজিত ‘রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা আব্বাস এসব কথা বলেন।

ওই দলের প্রতি ইঙ্গিত করে মির্জা আব্বাস বলেন, তারা দেশকে ভালোবাসে না, দেশের মানুষকে ভালোবাসে না। তারা ভালোবাসে যেভাবেই হোক ক্ষমতায় থাকতে হবে, যেভাবেই হোক ক্ষমতায় যেতে হবে।

মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমাদের তো আপত্তির কিছু নাই, দেশের লোক যদি ভোট দিয়ে আপনাদের ক্ষমতায় নেয়। আপত্তির কী আছে, ভোটে আসেন। ভোটকে ভয় পান কেন, নির্বাচনকে ভয় পান কেন আপনারা। এইটা না হলে নির্বাচন করা যাবে না, ওইটা না হলে নির্বাচন করা যাবে না। আরে ভাই, ১৭ বছরে বহু নেতার ফাঁসি হয়েছে, ১৭ বছরে বহু নেতা-কর্মী গুম হয়েছে, বহু নেতা-কর্মী খুন হয়েছে। এই ১৭ বছরে এই মঞ্চে যাঁরা আছেন মা-বোনসহ কমবেশি বহু লোক জেল খেটেছেন। এইটা কি খামোখা করেছি আমরা?’

বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমরা বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েছি গণতন্ত্রের জন্য, কথা বলার জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য। আজকে ভোটের সময় যখন এল, তখন বলেন এইটা না করলে ভোট হবে না, ওইটা না করলে ভোট হবে না—কেনরে ভাই!’ তিনি বলেন, ‘আজকে যারাই লম্বা লম্বা কথা বলেন, বুকে হাত দিয়ে বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আপনাদের কয়জন নেতা-কর্মী শাহাদাত বরণ করেছেন। বিএনপির ৪২২ জন নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন এক মাসে। আপনাদের কয়জন হয়েছে।’

কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে বিএনপির এই নেতা হিসাব করে কথা বলার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তো দেশটাকে বাপের তালুক ভাবছিল। যে কারণে তারা যা খুশি তাই বলেছিল, অপানরাও কী তাই ভাবেন? এই বাংলাদেশ কারও তালুকদারি নয়। সুতরাং কথাবার্তা বলার সময় হিসাব করে বলবেন, যাতে আমাদেরও বেহিসাবি কথা বলতে না হয়।’

গতকাল মঙ্গলবার দলীয় এক অনুষ্ঠানে দেওয়া একটি বক্তব্যে উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমি কালকে একটা বক্তব্যে বলেছি, আমাদের সাংবাদিক ভাইয়েরা আজকাল অনেক দলের খারাপ কথা লেখেন না। ভালো কথাগুলো হয়তো লেখে দু-একটা। বিএনপির ভালো কথাগুলো লেখে না, খারাপ কথাগুলো লিখে দেয়। .

..অপকর্ম করে তারা, চাঁদাবাজি করে তারা, দুষ্কর্ম করে তারা—চাপিয়ে দেয় বিএনপির ওপরে। এসব চাঁদাবাজদের প্রতিরোধ করতে হবে, প্রতিহত করতে হবে। মুখের কথায়, না হয় কাজে। যদি না করি, আওয়ামী লীগের পরিণতি হবে।’

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্ষদ জাতীয় স্থায়ী কমিটির এই নেতা আরও বলেন, ‘আমার একটা এলাকায় ১০০ কর্মী আছে। দুইটা কর্মী খারাপ, বদমায়েশি করে, অপকর্ম করে। এটা যদি হয়, আমরা ৯৮ জন কর্মী তো আর খারাপ না। সুতরাং দুজন লোকের জন্য আমার সব কর্মী কালিমালিপ্ত হবে, এটা হতে দেওয়া যাবে না। যদি কোনো চাঁদাবাজ ঢুকে পড়ে বা (দলে) আসে। অনেক চান্দাবাজ আওয়ামী লীগের কিন্তু এখন দলের (বিএনপি) মধ্যে আছে। সব দলেই আছে, বিএনপিতে আছে, জামায়াতে আছে...সব দলেই কমবেশি আশ্রয় নিয়ে নিয়েছে। এগুলোকে চিহ্নিত করেন, দল থেকে বের করে দেন, নইলে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন।’

নির্বাচন যদি দিতেই হয়, এখনই কেন নয়

বিএনপির দেওয়া ৩১ দফা রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার প্রস্তাবের উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস বলেন, সরকারের সংস্কার কমিশনগুলো প্রস্তাবে নতুন এমন কিছু নেই, যা ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেওয়া ৩১ দফায় নেই।

মির্জা আব্বাস বলেন, ‘এখন দেশে অনেক রাজনৈতিক নেতারা তৈরি হয়েছেন, কিংবা কেউ কেউ তৈরি করছেন। তাঁরা বিভিন্ন রকম কথা বলছেন। যেসব কথার অর্থ, আমাদের এই ৩১ দফায় আছে এবং সেগুলো জাতির সামনে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি বলে আমি বিশ্বাস করি।’ এ প্রসঙ্গে তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা কত দিনে সংস্কার বাস্তবায়ন করবেন আমি বুঝি না। আমি এটা বুঝি, সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনটা যদি দিয়ে দেন, যতটুকু পারেন সংস্কার করেন, বাকিটা নির্বাচনের পরে নির্বাচিত সরকার করবে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজের উল্লেখ করে আব্বাস বলেন, ‘আমি কিন্তু ওনাদের সংস্কারে নতুন এমন কিছু পাই নাই, যেটা আমাদের ৩১ দফায় নেই। সুতরাং সংস্কার সংস্কার করতে করতে নির্বাচন দেরি হয়ে যাবে, এটা অমূলক নয়, এ ধারণা জাতি করছে। কিংবা এর অসিলা ধরে নির্বাচন পেছানো, এ ধারণাও অমূলক নয়। আমি আশা করব, সরকার ৩১ দফাকে কিছুটা এদিক-ওদিক করে হলেও সংস্কার দ্রুত শেষ করে নিতে পারে এবং দ্রুত জুন-জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা ওনারা দিতে পারে।’

এ প্রসঙ্গে আব্বাস বলেন, যদিও ওনারা বলেছেন, ডিসেম্বরে মধ্যে নির্বাচন দেবেন। কিন্তু কেন অযথা বিলম্ব হবে নির্বাচনের। নির্বাচন যদি দিতেই হয়, এখনই কেন নয়।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু আজকের কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন।  সঞ্চালনা করেন সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ। কর্মশালায় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রশিদ হাবিব, মির্জা খোকন, মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক লিটন মাহমুদ, কে সিকান্দার কাদির, সাইদুর রহমান, ফরহাদ হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা গোলাম হোসেন, ইউনুস মৃধা, শাহজাহানপুর থানা বিএনপির আহ্বায়ক ফজলে রুবাইয়াত, যুবদল দক্ষিণের আহ্বায়ক খন্দকার এনামুল হক, কৃষক দল দক্ষিণের সভাপতি কামাল হোসেন, মহিলা দল দক্ষিণের সভাপতি রুমা আকতার প্রমুখ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব এনপ র ক র কর র জন য আম দ র উল ল খ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে

সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।

এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’

আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ