কিডনির রোগে ব্যবসা হারিয়েছেন, ধারদেনা আর স্বজনের সাহায্যে চলে ডায়ালাইসিস
Published: 13th, March 2025 GMT
বোধিসত্ত্ব বড়ুয়া (৪৯) একসময় ব্যবসা করতেন। সাত বছর আগে তাঁর কিডনির জটিলতা ধরা পড়ে। সাড়ে ছয় বছর ধরে ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে। শুরুর দিকে সপ্তাহে দুটি করে ডায়ালাইসিস করতে হতো। এখন সপ্তাহে তিনটি ডায়ালাইসিস নিতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্যানডরে ডায়ালাইসিস নিতে আসা বোধিসত্ত্ব বড়ুয়া বলেন, মাসে তাঁর খরচ হয় ৭৫ হাজার টাকা। একেকটি ইনজেকশন কিনতে হয় চার হাজার টাকা দামে। এ ছাড়া রক্ত দিতে হয়। আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় তিনি এখনো বেঁচে আছেন। ওষুধের দোকানের যে ব্যবসা ছিল, তা এখন আর নেই।
চমেক হাসপাতালে গত এক বছরে ১০ হাজার ৬০০ কিডনি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। নেফ্রাইটিস (বৃক্কের প্রদাহ), উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও অসচেতনতার কারণে রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। কিডনি রোগীদের সবচেয়ে বড় সংকটে পড়তে হয় ডায়ালাইসিস খরচ জোগাতে। সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস খরচ পড়ে প্রায় ১৫ হাজার টাকা।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, কিডনি ওয়ার্ডে বর্তমানে ৩০০ স্থায়ী কিডনি রোগী রয়েছেন, যাঁরা ডায়ালাইসিস করছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আরও ৭০০ স্থায়ী কিডনি রোগী নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে চলেছেন বলে চিকিৎসকেরা জানান। তবে সরকারি পর্যায়ে আরও ডায়ালাইসিস মেশিন এবং চিকিৎসা সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো দরকার বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
চমেক হাসপাতালে নেফ্রোলজি বিভাগটি ৩০ থেকে ৪০ শয্যায় উত্তীর্ণ করা হয়েছে। এখানে গত বছর অন্তর্বিভাগে মোট রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন ৬ হাজার ৫২০ জন, বহির্বিভাগে ৪ হাজার ৭৮ জন। স্থায়ী রোগীর ডায়ালাইসিস হয়েছে ২০ হাজার ৫২৮ বার। অস্থায়ী রোগীর ডায়ালাইসিস হয়েছে ৭ হাজার ১৬৬ বার।
নেফ্রোলজি বিভাগের অধীনে বর্তমানে ১৩টি ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে। এর বাইরে রোগীদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্যানডরের শরণাপন্ন হতে হয়। চমেক হাসপাতালের নিচতলায় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ এই ডায়ালাইসিস সেবা চালু রয়েছে। এখানে শয্যা ৩১টি শয্যায় ভর্তুকি দিয়ে ডায়ালাইসিস করানো যায়। স্যানডরে এখন ভর্তুকি মূল্যে ৫৯১ টাকায় ডায়ালাইসিস করা যায়। ভর্তুকি ছাড়া দিতে হয় ৩ হাজার ২৮৫ টাকা।
নেফ্রোলজি বিভাগের রেজিস্ট্রার বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, নেফ্রোলজি বিভাগে ১৩টি মেশিনে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করা হয়। এর বাইরে স্যানডরের শরণাপন্ন হতে হয়। যদি বেসরকারি কোনো হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করতে হয়, তাহলে ওষুধপত্র সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ পড়ে।
এই যেমন রহিমা বেগম (৭০) কিডনির জটিলতায় ভুগছেন প্রায় তিন বছর ধরে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে তিনি চমেক হাসপাতালের নিচতলায় স্যানডরে ডায়ালাইসিস করতে আসেন। প্রতি সপ্তাহে তাঁর দুটি ডায়ালাইসিস দরকার হয়। এ জন্য সপ্তাহে খরচ ছয় হাজার টাকা। এর বাইরে ওষুধপত্র এবং রক্তের জন্য আলাদা টাকা দরকার হয়। রহিমার মেয়ে রিজু আকতার বলেন, প্রতি মাসে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয় মায়ের পেছনে। আত্মীয়স্বজনের সাহায্য এবং ধারদেনা করে এই খরচ চালাচ্ছেন।
কিডনি জটিলতায় ভোগা রোগীদের সপ্তাহে কমপক্ষে দুবার ডায়ালাইসিস নিতে হয়। দিন দিন কিডনি এবং ডায়ালাইসিস দুই ঘরানার রোগী বেড়েই চলেছে বলে চিকিৎসকেরা জানান। ২০২৩ সালে চমেক নেফ্রোলজি বিভাগে ১০ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এবার তা বেড়ে ১০ হাজার ৬০০ হয়েছে।
চমেক হাসপাতালের কিডনি বিভাগের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এখানে যেসব রোগী ভর্তি হয়, এর ৫৭ শতাংশ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভুগছেন। ২৩ শতাংশ সাময়িক কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের উল্লেখযোগ্য কারণ হলো নেফ্রাইটিস, ৩৪ শতাংশ। এ ছাড়া ডায়াবেটিসের কারণে ২৮ শতাংশ এবং উচ্চ রক্তচাপের জন্য ১৭ শতাংশ কিডনি জটিলতায় ভোগেন।
নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো.
এদিকে চমেক শিশু নেফ্রোলজি ওয়ার্ডের বহির্বিভাগে গত এক বছরে ১ হাজার ২৯ জন শিশু ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া একই সময়ে ৪৬৫ জন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। কিডনি বায়োপসি করা হয় ২৬ জন শিশুর।
শিশু নেফ্রোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মারুফ উল কাদের বলেন, শিশু কিডনির রোগীও আগের চেয়ে বেড়েই চলেছে। ডায়ালাইসিসও নিতে হচ্ছে। একটিমাত্র ডায়ালাইসিস মেশিনে শিশুদের সেবা দেওয়া হয়।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
স্তন ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করতে নিয়মিত স্ক্রিনিং জরুরি
স্তন ক্যানসারের রিস্ক ফ্যাক্টর বলতে আমরা বুঝি ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয় এমন কারণগুলো। এগুলো দুইভাবে ভাগ করা যায়। একটি হলো জেনেটিক কারণ, যেমন ‘বিআরসিএ১’ ও ‘বিআরসিএ২’ জিনে মিউটেশন থাকলে ব্রেস্ট ক্যানসারের আশঙ্কা বেড়ে যায়। আরেকটি হলো, নন-জেনেটিক কারণ। তবে প্রাথমিক পর্যায়েই ক্যানসার শনাক্ত করার জন্য নিয়মিত স্ক্রিনিং জরুরি।
‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথাগুলো বলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. মো. নাহিদ হোসেন। উপস্থাপনায় ছিলেন নাসিহা তাহসিন। ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে এসকেএফ অনকোলজি।
এবারের আলোচনায় মেডিকেল অনকোলজি, কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি ও ইমিউন থেরাপিসহ স্তন ক্যানসারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন চিকিৎসক। পর্বটি গত বুধবার (২৯ অক্টোবর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
ক্যানসার কীভাবে হয়স্তন ক্যানসার এবং এটি হওয়ার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে শুরুতেই চিকিৎসকের কাছে জানতে চান উপস্থাপক। উত্তরে ডা. মো. নাহিদ হোসেন বলেন, আসলে যেকোনো ক্যানসারই হলো শরীরের কোনো সেল বা কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি। যদি সেই কোষের গ্রোথ অনিয়ন্ত্রিতভাবে হয়, সেটাই ক্যানসার। আর স্তন ক্যানসারও একইভাবে ঘটে—যখন ব্রেস্টের সেলগুলোর আনকন্ট্রোলড গ্রোথ হয়।
স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কাদেরডা. মো. নাহিদ হোসেন বলেন, সাধারণত দুই ধরনের ব্রেস্ট ক্যানসার বেশি দেখা যায়—ডাক্টাল কারসিনোমা, যা দুধ বহনকারী ডাক্টে ক্যানসার হলে। অন্যটি লোবুলার কারসিনোমা, যা ব্রেস্টের দুধ উৎপাদনকারী গ্ল্যান্ডে ক্যানসার হলে।
নন–মডিফায়েবল কারণগুলো সম্পর্কে ডা. মো. নাহিদ হোসেন বলেন, ‘এগুলো হলো, মেয়েদের অল্প বয়সে অর্থাৎ ১২ বছরের আগে মাসিক শুরু হওয়া, দেরিতে অর্থাৎ ৫৫ বছরের পরে মেনোপজ হওয়া, পরিবারে ব্রেস্ট ক্যানসারের ইতিহাস থাকা। আর মডিফায়েবল কারণগুলো হলো স্থূলতা বা মোটা হওয়া, হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নেওয়া, দেরিতে অর্থাৎ ৩০ বছর পর সন্তান নেওয়া বা সন্তান না নেওয়া, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, অ্যালকোহল গ্রহণ এবং উচ্চ ফ্যাটযুক্ত খাবার খাওয়া। এগুলো এড়িয়ে চললে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।’
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট। ফলে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৭টি দেশে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে। এ ছাড়া এসকেএফ অনকোলজির সারা দেশে রয়েছে ৩৩টি সেবাকেন্দ্র, যার মাধ্যমে ক্যানসারের ওষুধ পাওয়া যায়। শুধু তা–ই নয়, ঘরে বসে অর্ডার করলেই বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে সহজেই পৌঁছে দেওয়া হয়।
সচেতনতা জরুরিনন-মডিফায়েবল রিস্ক ফ্যাক্টরের মধ্যে জিনগত ফ্যাক্টর কীভাবে ভূমিকা রাখে? সে ক্ষেত্রে স্ক্রিনিং কখন থেকে শুরু করা উচিত? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মো. নাহিদ হোসেন বলেন, স্ক্রিনিং আসলে করা হয় স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য, যাদের এখনো ক্যানসার হয়নি—যেন প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করা যায়। স্ক্রিনিংয়ের কিছু ধাপ রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ব্রেস্ট সেলফ এক্সামিনেশন, এটি মাসিক শেষ হওয়ার ৩ থেকে ৫ দিন পর প্রতি মাসে নিজে নিজে ব্রেস্ট পরীক্ষা করা উচিত। তিন আঙুলের সাহায্যে ব্রেস্ট ও বগল ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা উচিত কোনো গোটা বা স্রাব আছে কি না। আরেকটি হলো, স্ক্রিনিং মেমোগ্রাম। তিনি বলেন, মেমোগ্রাম ৪০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতিবছর করা উচিত। যদি কারও পরিবারে ক্যানসারের ইতিহাস থাকে, যেমন মা বা বোনের ব্রেস্ট বা ওভারি ক্যানসার ছিল—তাহলে স্ক্রিনিং আরও আগে থেকে শুরু করা উচিত। আর হাই–রিস্ক গ্রুপের জন্য ‘এমআরআই’ করা যেতে পারে। এই স্ক্রিনিং প্রক্রিয়াগুলো ক্যানসারকে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান পরিস্থিতি, রোগনির্ণয়, ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা-সুবিধা বিষয়ে পরামর্শ দেন ডা. মো. নাহিদ হোসেন