ওয়াইচিংনু মারমা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। চারপাশে শুধু গাড়ির হর্ন, ধোঁয়া, ভিড়, কোলাহল। ঢাকার আকাশটাও যেন ধূসর। একটুও নীল নয়। সবকিছুই কেমন যেন বেমানান লাগছে তার কাছে।
বান্দরবানের পাহাড়ি বাতাসে মিশে থাকা বাঁশির সুর, ঝরনার শব্দ, পাখির ডাক, এসবের কিছুই এখানে নেই। ছোট্ট কাঠের ঘরের উঠোনের পাশে ছিল লাল-নীল ফুলের গাছ। আর ঢাকার এই বাসার বারান্দায় শুধু কয়েকটা শুকনো টব পড়ে আছে।
‘তোর চেহারাটা এমন গম্ভীর কেন?’ মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।
ওয়াইচিংনু কোনো উত্তর দিল না। পাহাড়ের উঁচু ঢালে বসে বাবা-মায়ের সঙ্গে সূর্যাস্ত দেখা, ছড়ার পানিতে পা ভিজিয়ে বসে থাকা, এসব কথা মনে পড়ছে। বান্দরবানে সবাই তার নাম জানত। সবাই তাকে চিনত। কিন্তু এখানে?
কাল তার স্কুলে প্রথম দিন। মাও দুশ্চিন্তায় আছে, সে টের পাচ্ছে। কিন্তু মা কিছু বলছে না।
‘স্কুলটা ভালোই হবে, তাই না মা?’ ওয়াইচিংনু আস্তে করে বললো।
‘অবশ্যই হবে!’ মা হেসে বললেন। ‘নতুন জায়গা, নতুন বন্ধু। তোর সব ঠিক হয়ে যাবে।’
স্কুলের ক্লাসরুমটায় ঢুকতেই হালকা একটা গুঞ্জন উঠল। নতুন ছাত্র-ছাত্রী এলেই নাকি এমন হয়। সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কারো চোখে কৌতূহল, কারো চোখে নিছকই অবজ্ঞা। ওয়াইচিংনু ধীরে ধীরে পা বাড়ালো।
শিক্ষক বললেন, ‘নতুন বন্ধু এসেছে। সবাই ওকে স্বাগত জানাও।’
সবাই স্বাগত জানালো।
শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী?’
ওয়াইচিংনু একটু ইতস্তত করলো।
‘ওয়াই.
ক্লাসে হাসির রোল উঠলো। কেউ বললো, ‘ওয়াই-চিনা?’ কেউ বললো, ‘ইচিনু?’ কেউ আবার বললো, ‘চিনু-মিনু?’
ওয়াইচিংনুর গলা শুকিয়ে গেলো। ক্লাসের সব মুখ যেন কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। এতোদিন তার নাম শুনে কেউ হাসেনি। বান্দরবানে সবাই ঠিকঠাক বলতো, কেউ কখনো ভুল উচ্চারণ করতো না। আর এখানে?
শিক্ষক সবাইকে ধমক দিয়ে থামালেন। ‘তোমার আর কোনও ডাক নাম আছে? থাকলে বলো।’
কথাটা শোনার পর ওয়াইচিংনুর মনে হলো, সে যেন কোথাও খুব নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। না তার ডাক নাম নেই। তার নিজের নাম তাহলে কঠিন? বাবা বলতেন, ‘তোর নামটা আমাদের গর্ব, ওয়াইচিংনু।’ ওয়াইচিংনু মাথা নেড়ে বললো, তার কোনও ডাক নেম নেই। সবাই আবার একটু হাসলো। স্যার আবার ধমক দিয়ে সবাইকে ওয়াইচিংনু নামে ডাকতে বললো।
বাসায় ফিরে সে আর কারো সঙ্গে কথা বললো না। বিছানায় চুপচাপ বসে থাকলো। মা এসে পাশে বসলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে সোনা?’
ওয়াইচিংনু কোনো উত্তর দিল না। শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। ঢাকার আকাশটা আজও ধূসর। একটুও নীল নয়।
বিকেলে দাদুর ফোন এলো।
‘ওয়াইচিংনু, কেমন আছিস?’
ওয়াইচিংনু চুপ।
দাদু আবার বললেন, ‘নতুন শহর, নতুন স্কুল, ভালো লাগছে তো?’
ওয়াইচিংনু এবারও চুপ।
দাদু হেসে বললেন, ‘আমি জানি, তুই মন খারাপ করে বসে আছিস। তোর নাম নিয়ে সবাই হয়তো হাসছে, তাই না?’
ওয়াইচিংনুর গলা কেঁপে উঠলো। কীভাবে দাদু জানলেন?
দাদু আবার বললেন, ‘শোন, তোর নাম বদলানোর দরকার নেই। তোর নাম কোনো সাধারণ নাম না। তোর নাম মানে জানিস? শুভ আলোর কন্যা। তুই তো আমাদের আলো! আলো কি অন্য নামে ডাকা যায়?’
ওয়াইচিংনুর চোখ ভিজে এলো।
দাদু গল্প শুরু করলেন।
‘যখন তুই জন্মালি, তখন আকাশে বিশাল চাঁদ ছিলো, পাহাড়ের ওপরে ছিলো নরম আলো। তোর বাবা-মা ভাবল, এই আলোই তো আশীর্বাদ! তোর নাম রাখলো ওয়াইচিংনু। তুই পাহাড়ের আলো।’
ওয়াইচিংনু চোখ বন্ধ করলো। পাহাড়ের সবুজ মাঠ, ঝর্ণার ঠান্ডা জল, বাঁশবনের নরম বাতাস–সব চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
ঢাকার ধুলোভরা রাস্তা, বাসের বিকট হর্ন, অপরিচিত মুখগুলো যেন কিছুক্ষণের জন্য দূরে সরে গেলো।
দাদু বললেন, ‘শোন, নাম বদলানো মানে নিজের শিকড় ভুলে যাওয়া। পাহাড়ের মেয়ে কি নিজের পরিচয় হারাতে পারে?’
ওয়াইচিংনুর মন হঠাৎই শক্ত হয়ে গেলো।
সে কি সত্যিই নিজের পরিচয় হারাবে?
পরদিন সকালে সে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বললো, ‘আমার নাম ওয়াইচিংনু।’
নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর।
তার নাম বদলাবে না। কিছুতেই না।
স্কুলের করিডোরে ওয়াইচিংনু ধীরে ধীরে হাঁটছে। মনে হচ্ছে, আজ কিছু একটা বদলে গেছে। ক্লাসরুমে ঢুকতেই আবার গুঞ্জন। কেউ বললো, ‘ওই চিনু-টিনু আসছে!’ কেউ বললো, ‘ওয়াই-চিনা? আবার কোন দেশ থেকে এলো?’ ওয়াইচিংনু এবার থামলো। আজ আর চুপ করে থাকবে না। লম্বা একটা শ্বাস নিলো। তারপর স্পষ্ট করে বললো, ‘আমার নাম ওয়াইচিংনু। ওয়াই-চিং-নু। আমি আদিবাসী। তাই তোমাদের মতো আমার নাম না। আমাদের নিজস্ব ভাষায় আমার নাম। তোমরা চেষ্টা করলে ঠিক বলতে পারবে!’
ক্লাস হঠাৎ থমথমে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আরিয়ান, যে সবচেয়ে বেশি তার নাম নিয়ে মজা করতো, এবার বিড়বিড় করে বললো, ‘ওয়াই... চিং... নু?’
ওয়াইচিংনু হাসলো। ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। এবার আর ভুল হবে না!’
শিক্ষক হঠাৎ ক্লাসে এসে শুনে খুশি হলেন। বললেন, ‘দেখলে? চেষ্টায় সব হয়।’
কিন্তু ওয়াইচিংনুর গল্প এখানেই শেষ নয়। সেই দুপুরে টিফিনের সময় তার পাশে এসে বসলো রেশমা। বললো, ‘তোমার নামের মানে কী?’ ওয়াইচিংনু একটু থামলো। তারপর বললো, ‘আমার নামের মানে শুভ আলোর কন্যা।’ রেশমার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। ‘আরে, কী সুন্দর নাম! কে রেখেছে?’
ওয়াইচিংনু বললো, ‘আমার দাদু। আমি যখন জন্মেছিলাম, পাহাড়ের ওপরে তখন চাঁদের আলো ছড়াচ্ছিলো। সবাই বললো, আমি নাকি সেই আলো নিয়ে এসেছি। তাই আমার নাম রাখা হলো ওয়াইচিংনু।’
রেশমা মুগ্ধ হয়ে বললো, ‘তুমি তো দারুণ গল্প বলতে পারো!’
তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন বন্ধু এসে যোগ দিলো। তারা জানলো, বান্দরবানের পাহাড়ে কেমন জীবন। কীভাবে মানুষ নদী পেরিয়ে স্কুলে যায়। কীভাবে পাহাড়ি উৎসব হয়।
আরিয়ানও চুপচাপ এসে বসে রইলো। তারপর বললো, ‘ওয়াইচিংনু, তুমি আমাদের আরও গল্প বলবে?’
ওয়াইচিংনু এবার সত্যিই হাসলো। তাদের জন্য তার অনেক গল্প আছে। তার নাম নিয়ে কেউ আর হাসবে না। বরং সবাই জানবে, সে কে, কোথা থেকে এসেছে এবং কীভাবে পাহাড়ের আলো ঢাকা শহরের বুকে এসে জ্বলে উঠেছে! n
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব ন দরব ন আম র ন ম ক উ বলল আম দ র ত রপর বলল ন র বলল
এছাড়াও পড়ুন:
নায়িকা হতে আসিনি, তবে...
গুটি, সুড়ঙ্গ, মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন থেকে ওমর—সব সিনেমা-সিরিজেই প্রশংসিত হয়েছে আইমন শিমলার অভিনয়। অল্প সময়ের উপস্থিতিতেও নিজের ছাপ রাখতে পেরেছেন এই তরুণ অভিনেত্রী। ধূসর চরিত্রেও তিনি সাবলীল, অন্য তরুণ অভিনেত্রীদের থেকে এখানেই আলাদা শিমলা। তবে একটা কিন্তু আছে। এখন পর্যন্ত তাঁর অভিনীত আলোচিত চরিত্রগুলোর সবই চাটগাঁইয়া। শিমলা নিজে চট্টগ্রামের মেয়ে, একটা সময় পর্যন্ত বন্দরনগরীর বাইরে চেনাজানা ছিল সীমিত। এক সিরিজে তাঁর চাটগাঁইয়া ভাষা আলোচিত হওয়ায় পরপর আরও কাজে তাঁকে চাটগাঁইয়া চরিত্রের জন্য ভেবেছেন নির্মাতা।
এ প্রসঙ্গ দিয়েই অভিনেত্রীর সঙ্গে আলাপের শুরু করা গেল। শিমলা জানালেন, এ নিয়ে তাঁর নিজেরও অস্বস্তি আছে। চেষ্টা করছেন ‘চাটগাঁইয়া দুনিয়া’র বাইরে যেতে। সঙ্গে এ–ও জানিয়ে রাখলেন, ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তাঁর নিজের চরিত্র পছন্দ করে নেওয়ার সুযোগ কমই ছিল।
‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শুটিংয়ের ঠিক আগে জেনেছি চরিত্রটি সম্পর্কে। তখন তো কিছু করার থাকে না। তবে যেসব কাজ করেছি, সবই আলোচিত পরিচালক আর অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে; এ অভিজ্ঞতার মূল্যও কম নয়। শিহাব (শিহাব শাহীন) ভাইয়ের সঙ্গে মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন, কাছের মানুষ দূরে থুইয়া, রবিউল আলম রবি ভাইয়ের সঙ্গে ফরগেট মি নট আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। এ ছাড়া (শহীদুজ্জামান) সেলিম ভাইয়ের কথা বিশেষভাবে বলব। সুড়ঙ্গ ও ওমর—দুই সিনেমায় তিনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন,’ বলছিলেন তিনি।
ঈদে মুক্তি পাওয়া এম রাহিমের সিনেমা জংলিতেও আছেন শিমলা। এ ছবিতে অবশ্য তাঁর চরিত্রটি চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে না। সে জন্য সিনেমাটি নিয়ে তিনি বেশি উচ্ছ্বসিত। ‘মুক্তির পর থেকে সিনেমা তো বটেই, আমার অভিনীত চরিত্রটি নিয়ে প্রশংসা পাচ্ছি কিন্তু দুঃখের কথা, আমি নিজেই এখনো দেখতে পারিনি। ব্যক্তিগত ঝামেলা, শুটিংয়ে ব্যস্ততার কারণে সম্ভব হয়নি। শিগগিরই আমার টিমের সঙ্গে দেখতে চাই,’ বলছিলেন তিনি।
আইমন শিমলা