ওয়াইচিংনু মারমা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। চারপাশে শুধু গাড়ির হর্ন, ধোঁয়া, ভিড়, কোলাহল। ঢাকার আকাশটাও যেন ধূসর। একটুও নীল নয়। সবকিছুই কেমন যেন বেমানান লাগছে তার কাছে।
বান্দরবানের পাহাড়ি বাতাসে মিশে থাকা বাঁশির সুর, ঝরনার শব্দ, পাখির ডাক, এসবের কিছুই এখানে নেই। ছোট্ট কাঠের ঘরের উঠোনের পাশে ছিল লাল-নীল ফুলের গাছ। আর ঢাকার এই বাসার বারান্দায় শুধু কয়েকটা শুকনো টব পড়ে আছে।
‘তোর চেহারাটা এমন গম্ভীর কেন?’ মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।
ওয়াইচিংনু কোনো উত্তর দিল না। পাহাড়ের উঁচু ঢালে বসে বাবা-মায়ের সঙ্গে সূর্যাস্ত দেখা, ছড়ার পানিতে পা ভিজিয়ে বসে থাকা, এসব কথা মনে পড়ছে। বান্দরবানে সবাই তার নাম জানত। সবাই তাকে চিনত। কিন্তু এখানে?
কাল তার স্কুলে প্রথম দিন। মাও দুশ্চিন্তায় আছে, সে টের পাচ্ছে। কিন্তু মা কিছু বলছে না।
‘স্কুলটা ভালোই হবে, তাই না মা?’ ওয়াইচিংনু আস্তে করে বললো।
‘অবশ্যই হবে!’ মা হেসে বললেন। ‘নতুন জায়গা, নতুন বন্ধু। তোর সব ঠিক হয়ে যাবে।’
স্কুলের ক্লাসরুমটায় ঢুকতেই হালকা একটা গুঞ্জন উঠল। নতুন ছাত্র-ছাত্রী এলেই নাকি এমন হয়। সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কারো চোখে কৌতূহল, কারো চোখে নিছকই অবজ্ঞা। ওয়াইচিংনু ধীরে ধীরে পা বাড়ালো।
শিক্ষক বললেন, ‘নতুন বন্ধু এসেছে। সবাই ওকে স্বাগত জানাও।’
সবাই স্বাগত জানালো।
শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী?’
ওয়াইচিংনু একটু ইতস্তত করলো।
‘ওয়াই.
ক্লাসে হাসির রোল উঠলো। কেউ বললো, ‘ওয়াই-চিনা?’ কেউ বললো, ‘ইচিনু?’ কেউ আবার বললো, ‘চিনু-মিনু?’
ওয়াইচিংনুর গলা শুকিয়ে গেলো। ক্লাসের সব মুখ যেন কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। এতোদিন তার নাম শুনে কেউ হাসেনি। বান্দরবানে সবাই ঠিকঠাক বলতো, কেউ কখনো ভুল উচ্চারণ করতো না। আর এখানে?
শিক্ষক সবাইকে ধমক দিয়ে থামালেন। ‘তোমার আর কোনও ডাক নাম আছে? থাকলে বলো।’
কথাটা শোনার পর ওয়াইচিংনুর মনে হলো, সে যেন কোথাও খুব নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। না তার ডাক নাম নেই। তার নিজের নাম তাহলে কঠিন? বাবা বলতেন, ‘তোর নামটা আমাদের গর্ব, ওয়াইচিংনু।’ ওয়াইচিংনু মাথা নেড়ে বললো, তার কোনও ডাক নেম নেই। সবাই আবার একটু হাসলো। স্যার আবার ধমক দিয়ে সবাইকে ওয়াইচিংনু নামে ডাকতে বললো।
বাসায় ফিরে সে আর কারো সঙ্গে কথা বললো না। বিছানায় চুপচাপ বসে থাকলো। মা এসে পাশে বসলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে সোনা?’
ওয়াইচিংনু কোনো উত্তর দিল না। শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। ঢাকার আকাশটা আজও ধূসর। একটুও নীল নয়।
বিকেলে দাদুর ফোন এলো।
‘ওয়াইচিংনু, কেমন আছিস?’
ওয়াইচিংনু চুপ।
দাদু আবার বললেন, ‘নতুন শহর, নতুন স্কুল, ভালো লাগছে তো?’
ওয়াইচিংনু এবারও চুপ।
দাদু হেসে বললেন, ‘আমি জানি, তুই মন খারাপ করে বসে আছিস। তোর নাম নিয়ে সবাই হয়তো হাসছে, তাই না?’
ওয়াইচিংনুর গলা কেঁপে উঠলো। কীভাবে দাদু জানলেন?
দাদু আবার বললেন, ‘শোন, তোর নাম বদলানোর দরকার নেই। তোর নাম কোনো সাধারণ নাম না। তোর নাম মানে জানিস? শুভ আলোর কন্যা। তুই তো আমাদের আলো! আলো কি অন্য নামে ডাকা যায়?’
ওয়াইচিংনুর চোখ ভিজে এলো।
দাদু গল্প শুরু করলেন।
‘যখন তুই জন্মালি, তখন আকাশে বিশাল চাঁদ ছিলো, পাহাড়ের ওপরে ছিলো নরম আলো। তোর বাবা-মা ভাবল, এই আলোই তো আশীর্বাদ! তোর নাম রাখলো ওয়াইচিংনু। তুই পাহাড়ের আলো।’
ওয়াইচিংনু চোখ বন্ধ করলো। পাহাড়ের সবুজ মাঠ, ঝর্ণার ঠান্ডা জল, বাঁশবনের নরম বাতাস–সব চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
ঢাকার ধুলোভরা রাস্তা, বাসের বিকট হর্ন, অপরিচিত মুখগুলো যেন কিছুক্ষণের জন্য দূরে সরে গেলো।
দাদু বললেন, ‘শোন, নাম বদলানো মানে নিজের শিকড় ভুলে যাওয়া। পাহাড়ের মেয়ে কি নিজের পরিচয় হারাতে পারে?’
ওয়াইচিংনুর মন হঠাৎই শক্ত হয়ে গেলো।
সে কি সত্যিই নিজের পরিচয় হারাবে?
পরদিন সকালে সে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বললো, ‘আমার নাম ওয়াইচিংনু।’
নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর।
তার নাম বদলাবে না। কিছুতেই না।
স্কুলের করিডোরে ওয়াইচিংনু ধীরে ধীরে হাঁটছে। মনে হচ্ছে, আজ কিছু একটা বদলে গেছে। ক্লাসরুমে ঢুকতেই আবার গুঞ্জন। কেউ বললো, ‘ওই চিনু-টিনু আসছে!’ কেউ বললো, ‘ওয়াই-চিনা? আবার কোন দেশ থেকে এলো?’ ওয়াইচিংনু এবার থামলো। আজ আর চুপ করে থাকবে না। লম্বা একটা শ্বাস নিলো। তারপর স্পষ্ট করে বললো, ‘আমার নাম ওয়াইচিংনু। ওয়াই-চিং-নু। আমি আদিবাসী। তাই তোমাদের মতো আমার নাম না। আমাদের নিজস্ব ভাষায় আমার নাম। তোমরা চেষ্টা করলে ঠিক বলতে পারবে!’
ক্লাস হঠাৎ থমথমে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আরিয়ান, যে সবচেয়ে বেশি তার নাম নিয়ে মজা করতো, এবার বিড়বিড় করে বললো, ‘ওয়াই... চিং... নু?’
ওয়াইচিংনু হাসলো। ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। এবার আর ভুল হবে না!’
শিক্ষক হঠাৎ ক্লাসে এসে শুনে খুশি হলেন। বললেন, ‘দেখলে? চেষ্টায় সব হয়।’
কিন্তু ওয়াইচিংনুর গল্প এখানেই শেষ নয়। সেই দুপুরে টিফিনের সময় তার পাশে এসে বসলো রেশমা। বললো, ‘তোমার নামের মানে কী?’ ওয়াইচিংনু একটু থামলো। তারপর বললো, ‘আমার নামের মানে শুভ আলোর কন্যা।’ রেশমার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। ‘আরে, কী সুন্দর নাম! কে রেখেছে?’
ওয়াইচিংনু বললো, ‘আমার দাদু। আমি যখন জন্মেছিলাম, পাহাড়ের ওপরে তখন চাঁদের আলো ছড়াচ্ছিলো। সবাই বললো, আমি নাকি সেই আলো নিয়ে এসেছি। তাই আমার নাম রাখা হলো ওয়াইচিংনু।’
রেশমা মুগ্ধ হয়ে বললো, ‘তুমি তো দারুণ গল্প বলতে পারো!’
তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন বন্ধু এসে যোগ দিলো। তারা জানলো, বান্দরবানের পাহাড়ে কেমন জীবন। কীভাবে মানুষ নদী পেরিয়ে স্কুলে যায়। কীভাবে পাহাড়ি উৎসব হয়।
আরিয়ানও চুপচাপ এসে বসে রইলো। তারপর বললো, ‘ওয়াইচিংনু, তুমি আমাদের আরও গল্প বলবে?’
ওয়াইচিংনু এবার সত্যিই হাসলো। তাদের জন্য তার অনেক গল্প আছে। তার নাম নিয়ে কেউ আর হাসবে না। বরং সবাই জানবে, সে কে, কোথা থেকে এসেছে এবং কীভাবে পাহাড়ের আলো ঢাকা শহরের বুকে এসে জ্বলে উঠেছে! n
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব ন দরব ন আম র ন ম ক উ বলল আম দ র ত রপর বলল ন র বলল
এছাড়াও পড়ুন:
পিডিবির ভুলে ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হলো বাংলাদেশকে
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) খামখেয়ালিজনিত এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশকে দুই কোটি মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে।
খামখেয়ালিটি হলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২০০০ সালে হওয়া ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে (বিরোধ নিষ্পত্তির আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা) একটি মামলায় পক্ষভুক্ত না হওয়া। পক্ষভুক্ত হতে গেলে বাংলাদেশকে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হতো। তা করেনি পিডিবি। ফলে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে একতরফা রায় হয়েছে। দুই যুগ পর এখন বাংলাদেশকে জরিমানা দিতে হয়েছে ৩৩৩ গুণ বেশি অর্থ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গত ১৯ মে পিডিবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, এ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ হিসেবে পিডিবিকে দেওয়া হবে, যা তারা দেবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডকে। হরিপুরে ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্পনসর (পৃষ্ঠপোষক) ছিল এই স্মিথ কো-জেনারেশন।
আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানঅবশ্য পিডিবি অর্থ বিভাগের ঋণ নেয়নি। সংস্থাটি নিজের তহবিল থেকে গত ২৩ মে ২৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কোম্পানিটি।
এই পাওনা টাকাকে কেন্দ্র করেই ২০২৪ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। জটিলতা এড়াতে তাঁরা দুজন পরে হোটেল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় (বাংলাদেশ হাউস) গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।’
ঘটনা শুরু যেভাবেমূল ঘটনা ১৯৯৭ সালের অক্টোবরের। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার হরিপুরে বেসরকারি খাতে ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কো-জেনারেশন ইন্টারন্যাশনালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে দুটি চুক্তি করে বাংলাদেশ। কোম্পানিটির সঙ্গে পিডিবির একটি চুক্তি হয় ১৯৯৭ সালের ১৪ অক্টোবর। দুই দিন পর ১৬ অক্টোবর সরকারের সঙ্গে আরেকটি চুক্তি হয় বিদ্যুৎ কেনার (পিপিএ)।
চুক্তি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ১৯৯৮ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু কোম্পানিটি তা পারেনি। শর্ত ছিল নির্ধারিত দিন থেকে উৎপাদন করতে না পারলে দুই মাস মেয়াদ বাড়াবে সরকার, তবে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার মার্কিন ডলার করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কোম্পানিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তো দূরের কথা, কোনো নির্মাণকাজ করতে পারেনি; বরং আরও ৬ মাস ২০ দিন সময় চায়। সরকার তা না মেনে ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পিপিএ ও জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করে দেয়। শুধু তা–ই নয়, ব্যাংক নিশ্চয়তার (পিজি) ১৫ লাখ ডলারও নিয়ে নেয় পিডিবি।
সচিবালয়ে গত ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক থেকে মার্কিন কোম্পানিটিকে ২ কোটি ডলার দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। বিদ্যুৎসচিব ফারজানা মমতাজ এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এতে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কথা আসেনি। যদিও সম্প্রতি আলাদা এক চিঠিতে অর্থ বিভাগ এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।
বিদ্যুৎসচিবের সঙ্গে গত ১৫ মে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করে জানতে চাওয়া হয় যে যাঁদের কারণে বাংলাদেশকে এখন ২৪৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে, তাঁদের তিনি বাঁচিয়ে দিলেন কেন। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।
ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদবিষয়টি যেভাবে আদালতে গড়ালঅর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে পাঠানো বিদ্যুৎসচিবের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটি ২০০০ সালে ঢাকার সাব জজ পঞ্চম আদালতে আরবিট্রেশন মিসকেইস (বিবিধ মামলা) এবং নারায়ণগঞ্জের সাব জজ প্রথম আদালতে আরেকটি আরবিট্রেশন বিবিধ মামলা করে। উভয় মামলাই আদালত খারিজ করে দেন। আদালতে মামলার পাশাপাশি কোম্পানিটি পরে পিপিএ বাতিল ও পিজি নগদায়নের বিরুদ্ধে আইসিসি আরবিট্রেশনে যেতে পিডিবিকে নোটিশ দেয়। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটিকে চিঠি দিয়ে জানায়, আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি হতে পারেন আরবিট্রেটর।
কিন্তু আইসিসি বিদেশে আরবিট্রেশন মামলায় অংশগ্রহণের জন্য ট্রাইব্যুনাল খরচ বাবদ নির্ধারণ করে ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা উভয় পক্ষকে সমানভাবে বহন করতে হবে। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার দিতে হবে অগ্রিম। অর্ধেক হিসেবে তখন পিডিবির খরচ করতে হতো অগ্রিমের ৬০ হাজার ডলার।
তখনকার পিডিবির পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ট্রাইব্যুনাল খরচের কোনো অর্থ দেবে না। পিডিবির তৎকালীন আইনজীবী প্যানেল একই পরামর্শ দেয়। আইনজীবীরা আরও মত দেন, দেশে আরবিট্রেশন আইন হয়েছে ২০০১ সালে। এর আগে আইসিসির আরবিট্রেশনের রায় বাংলাদেশের বাইরে কার্যকর হবে না। তাঁরা মামলায় পক্ষভুক্ত না হতে পিডিবিকে পরামর্শ দেন।
পরে একপক্ষীয় শুনানি শেষে আইসিসি আরবিট্রেশন আদালত ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর রায় দেন। রায়ে বলা হয়, পিডিবি বছরে ৪ শতাংশ সুদসহ মোট ১ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে।
রায় বাস্তবায়নের ছয় মামলাআইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়নে স্মিথ কো-জেনারেশন পরে ছয়টি মামলা করে। এগুলো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব অব কলাম্বিয়া, ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্ক, সুপ্রিম কোর্ট অব নিউইয়র্ক, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের কোর্ট অব সেশন, সুইজারল্যান্ডের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব বাডেন এবং ঢাকার আদালতে।
আইসিসির রায় বাস্তবায়নে ২০০৭ সালের ২০ জুলাই রায় দেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব কলাম্বিয়া। স্মিথ কো-জেনারেশন এ আদালতে বিষয়টি আবার উত্থাপন করে। এরপর ২০২৪ সালের ১৯ মে পিডিবির বিরুদ্ধে সংশোধিত চূড়ান্ত রায় দেন আদালত। এবারের রায়ে বলা হয়, পিডিবি ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার পরিশোধ করবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে। কোম্পানিটি তখন তার আইনি প্রতিষ্ঠান ডোয়ান মরিস এলএলপিকে বিষয়টি জানায়। কিন্তু রায় আর বাস্তবায়ন হচ্ছিল না।
বিষয়টি নিয়ে জানতে গত ২৮ মে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনিও কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর যে বিপদে পড়েছিলেনআন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন যায় উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন একটি দল, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও ছিলেন। ২১-২৬ অক্টোবর (২০২৪) ছিল এ বার্ষিক সভা।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপদেষ্টা ও গভর্নরের ওয়াশিংটন যাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে স্মিথ কো-জেনারেশন আরেকটি মামলা করে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায়। আদালত তখন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের জবানবন্দি নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু যেহেতু অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা আছে এবং তাঁরা পিডিবির সঙ্গে সম্পর্কিত নন, তাই তাঁরা জবানবন্দি দেননি।
স্মিথ কো-জেনারেশন তখন আবার আদালতে (যুক্তরাষ্ট্র) যায়। আদালত ২৫ অক্টোবর (২০২৪) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আহসান এইচ মনসুরকে আটক করে আদালতে নিয়ে আসতে ইউএস মার্শাল সার্ভিসকে নির্দেশ দেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা দুজন তখন আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সরকারি বাসভবনে। তাঁরা ছিলেন ওয়াশিংটন ডিসির ১০ নম্বর সড়কে অবস্থিত অ্যাম্বাসি স্টু হোটেলে। দূতাবাসের গাড়িতে করে তাঁরা ম্যারিল্যান্ডে রাষ্ট্রদূতের বাসায় চলে যান।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগ এলএলপিকে নিয়োগ দেয়। তারা আপিল করলে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা স্থগিত করেন এবং শুনানির দিন ধার্য করেন ২৮ অক্টোবর (২০২৪)। ফলি হোয়াগ এলএলপি বিষয়টি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতার আবেদন জানায় বিচারকের কাছে এবং বিচারক তা গ্রহণ করেন। এভাবেই অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর ওই যাত্রায় রক্ষা পান।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ৩০ জুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়।’
বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।নিষ্পত্তির পথ খুলল যেভাবেমধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায়কে ভিত্তি ধরে দেশে তখন গুরুত্বের সঙ্গে কাজ শুরু করেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর এ বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এরপর স্মিথ কো-জেনারেশনের মধ্যস্থতাকারী, বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির কর্মকর্তা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান অনলাইনে ৫টি বৈঠক করেন। শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, জব্দ করা ব্যাংক নিশ্চয়তার ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হোক। বিপরীতে স্মিথ কো-জেনারেশন দাবি করে ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। আরও দাবি করে, মামলার খরচ বাবদ আরও ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার তাদের দিতে হবে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রস্তাবে কোম্পানিটিকে বলা হয়, ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান আইনের আওতায় বিদ্যুৎ খাতে তাদের বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। এতেও রাজি হয়নি স্মিথ কো–জেনারেশন। বাংলাদেশ পরে ১ কোটি ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়। স্মিথ কো-জেনারেশন তখন নতুন প্রস্তাব দেয়। সেটি হলো, এককালীন ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। অথবা ২ কোটি ৪০ লাখ ডলার ও দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে তারা মেনে নেবে।
বিষয়টি নিয়ে মধ্যস্ততায় থাকা বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে গত ২৬ মে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অবশ্য অর্থ বিভাগ ও পিডিবি সূত্র জানায়, পরে স্মিথ কো-জেনারেশন ২ কোটি ডলারে রাজি হয়। বাংলাদেশ সরকারও সিদ্ধান্ত নেয়, এই পরিমাণ অর্থ ওই কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে আগেই সম্মতি দিয়ে রেখেছিলেন (গত ১৮ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা। গত ২৮ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।
ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ‘দেশের বদনাম হলো’১৯৯৬-৯৯ সময়ে পিডিবির চেয়ারম্যান ছিলেন নুরউদ্দিন মাহমুদ কামাল, তিনি ২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বর মারা যান। ১৯৯৯-০০ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক সচিব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক, যিনি মারা যান ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ২০০০-০২ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ মালেক, যিনি মারা যান ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ জীবিত থাকলে শাস্তি দিতে হবে। এমনকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবিরও শাস্তি পাওয়া উচিত। অর্থ বিভাগের পরামর্শ মেনে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত করা।