অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে জাতীয় বাজেট-পূর্ব আলোচনা শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কার্যকরী করহার প্রযোজ্য করহারের তুলনায় অনেক বেশি– এমন অভিযােগ করে বেশির ভাগ সংগঠন কার্যকরী কর যৌক্তিক পর্যায়ে আনার দাবি জানাচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী বাজেটে করহার যৌক্তিক পর্যায়ে নামানোর পদক্ষেপ নেবেন। বিশেষত উৎসে করহার কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন। কীভাবে আয়করের ক্ষেত্রে আইনগত বাধ্যবাধকতা পরিপালন সহজ করা যায় এবং বিভিন্ন পর্যায়ে নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণের বিষয় পরিবর্তনের মাধ্যমে কীভাবে কার্যকরী করহার কমানো যায়– সে বিষয়ে আলোচনার দাবি রাখে।
কার্যকরী করহার বৃদ্ধির কারণ মূলত দুটি। প্রথমত, উৎসে করহার এবং দ্বিতীয়ত, কিছু খরচ বিয়োজনের ক্ষেত্রে আয়কর আইন অনুযায়ী আইনগত বাধ্যবাধকতা পরিপালন না করলে ওই খরচকে খরচ হিসেবে দাবি করা যায় না। আবার কোনো ব্যবসায় আয়ের তুলনায় বিভিন্ন খাতে সর্বোচ্চ কত খরচ দেখানো যাবে, তারও নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে; যার অতিরিক্ত খরচ দাবি করা যায় না।
রিটার্ন দাখিল বাড়ানোর জন্য কিছু ক্ষেত্রে পিএসআর বা রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ জমার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এটা সত্যি, এর ফলে রিটার্ন দাখিল উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের পিএসআর সংগ্রহ না করার কারণে খরচ বিয়োজন না পাওয়ার বিধান আইন থেকে বাদ দিতে হবে। নিম্নলিখিত পদক্ষেপের মাধ্যমে রিটার্ন দাখিল বাড়ানো যাবে এবং ব্যবসায়ীদের ব্যবসার করভার ও খরচ কমানো এবং সহজ করা সম্ভব হবে।
প্রথমত, বর্তমানে ৪০ লাখ রিটার্ন দাখিলকারীর মধ্যে ১৪ লাখ অনলাইনে দাখিল করেছেন। যারা কর অফিসে রিটার্ন দাখিল করেন, তাদের জন্য একটি পোর্টাল তৈরি করতে হবে, যাতে তারা দাখিল করা রিটার্নের করদাতার টিআইএন নম্বর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করদাতার আয়, সম্পদ ও করের পরিমাণ ইনপুট দিতে বলবে। দাখিল করার পর কর কর্মকর্তার ড্যাশবোর্ডে এই তথ্য নিশ্চিত করতে বলবে। কর কর্মকর্তা রিটার্ন রেজিস্টারের সঙ্গে তথ্যের মিল পেলে ‘ইয়েস’ বাটনে চাপ দেবেন অথবা এডিট অপশনে গিয়ে তথ্য ‘এডিট’ করলে পিএসআর তথ্যভান্ডার স্বয়ংক্রিয়ভাবে হালনাগাদ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করা যায় না। আয়কর আইনের ২৬৪ ধারা অনুযায়ী ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ বা নবায়নের সময় পিএসআর দাখিল করতে হয়। এনবিআর ট্রেড লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থাসহ অন্যান্য সংস্থা, যাদের পিএসআর সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা আয়োজন করে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পারে। এর পর সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক করে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি তৈরি করে প্রতিনিয়ত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কার্যকরভাবে পিএসআর সংগ্রহ করতে পারে।
সব খরচ ব্যবসা খরচ নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে খরচের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়ে থাকে, যাতে অযৌক্তিক খরচ ‘ব্যবসা খরচ’ হিসেবে বিয়োজন দাবি করা না যায়। বাংলাদেশের আয়কর আইন অনুযায়ী ধারা ৫৫-তে এরকম কিছু সীমা নির্ধারণ করা আছে। ধরুন, একটি কোম্পানি একজন ব্যবস্থাপককে বছরে ৮০ লাখ টাকা বেতন ও সুবিধা দেয়। এর মধ্যে পারকুইজিট উপাদান ৩০ লাখ টাকা এবং পারকুইজিট ব্যতীত উপাদান ৫০ লাখ টাকা। যেহেতু পারকুইজিট ১০ লাখ টাকা অতিক্রম করেছে, তাই এখানে অতিরিক্ত পারকুইজিট ২০ লাখ টাকা। যদি করহার ২৫ শতাংশ হয়, তবে কোম্পানিকে ৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত কর দিতে হবে। বাস্তবে এটি একটি দ্বৈত কর। কারণ, একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি যখন কোনো অর্থ আয় হিসেবে গ্রহণ করেন, তখন তাঁকে ওই আয়ের ওপর কর দিতে হয়। অন্যদিকে খরচের ওপর কোম্পানিকেও কর দিতে হয়। হাইকোর্ট বিভাগের রায় অনুযায়ী বিষয়টি অবৈধ হলেও, এ বিষয়ে আপিল বিভাগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মামলা চলমান। যদি সম্ভব হয়, এ বিধান প্রত্যাহার করতে হবে। তা না হলে পারকুইজিটের সীমা বাড়াতে হবে।
আবার ধরুন, একটি কোম্পানি তার গ্রুপভুক্ত কোম্পানিকে ১০ কোটি টাকা কারিগরি সহায়তা ফি হিসেবে দিল। ওই ফি বিদেশে পাঠানোর সময় ২ কোটি টাকা উৎসে কর কর্তন করা হলো। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কারিগরি সহায়তা ফি পাঠানো যায় না। ধরি, কোনো বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হলো ৫০ কোটি টাকা। আয়কর আইন অনুযায়ী নিট মুনাফার ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ দাবি করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৫ কোটি টাকার ওপর ২৫ শতাংশ হারে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত কর দিতে হবে। ব্যবসার একটি প্রয়োজনীয় খরচ আয়কর আইনের দৃষ্টিতে বিয়োজনযোগ্য নয়। এ ধরনের বিধান বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করে। যদি এ ধরনের খরচ অপ্রয়োজনীয় হয়, তবে বিদ্যমান আইনের অধীনে ট্রান্সফার প্রাইসিং নিরীক্ষার মাধ্যমে করারোপ করা যায়। তাই সময় এসেছে, এমন বিধান প্রত্যাহার করে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল সক্রিয় করা।
এখন ধরুন, একটি কোম্পানির বিজ্ঞাপন ব্যতীত অন্যান্য প্রচারণামূলক ব্যয় ২০ কোটি টাকা। ওই বছর কোম্পানির বিক্রয় হলো ১ হাজার কোটি টাকা। আয়কর আইন অনুযায়ী, বিক্রয়ের শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থাৎ ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ দাবি করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১৫ কোটি টাকার ওপর ২৫ শতাংশ হারে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত কর দিতে হবে। ব্যবসার একটি প্রয়োজনীয় খরচ আয়কর আইনের দৃষ্টিতে বিয়োজনযোগ্য নয়।
সাধারণত চলমান ভোগ্যপণ্য এবং অনুরূপ শিল্পে টার্নওভারের প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত প্রমোশন খাতে ব্যয় করা হয়ে থাকে, যা মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি সহায়ক প্রচলিত চর্চা। এ ধরনের সীমা নির্ধারণের ফলে অতিরিক্ত করের বোঝা এড়াতে প্রচারণামূলক কার্যক্রম কমে যেতে পারে এবং এর প্রত্যক্ষ প্রভাব সরাসরি সহযোগী শিল্প প্রতিষ্ঠানে পড়বে, সে ক্ষেত্রে তাদের রাজস্ব উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যেতে পারে। এ কারণেও সরকারি রাজস্ব আহরণ কমার শঙ্কা থাকে। ব্যবসায়িক প্রমোশনের সঙ্গে হাজার হাজার লোকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ ধারার প্রভাবে তাদের কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যাবে। ২০১৯ সালের অর্থ আইনে যখন এ বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল, শুধু ওষুধ শিল্পের প্রচারণা ব্যয় কমানোর জন্যই এ বিধান হয়েছে। বাস্তবে আইনে সুস্পষ্ট করা হয়নি। ফলে এ বিধান সব কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে। অন্যদিকে আয়কর আইনের ৫৫(ঝ) ধারায় বিভিন্ন শিল্পের জন্য ফ্রি স্যাম্পল বাবদ আলাদা সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেহেতু ফ্রি স্যাম্পলের জন্য একটি পৃথক ধারা রয়েছে, তাই ৫৫(ঞ) ধারাটি কিছুটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কারণ ফ্রি স্যাম্পলও তো এক ধরনের প্রচারণামূলক ব্যয়।
ওপরের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করলে করজাল বাড়বে। দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাবেন। আস্থা বাড়লে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানও বাড়বে। কর আহরণও বাড়বে বলে আশা করা যায়।
লেখক: পরিচালক, এসএমএসি
অ্যাডভাইজেরি সার্ভিসেস
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আয়কর আয়কর আইন র দ খ ল কর ক র যকর ব যবস য় ত খরচ দ প এসআর র জন য কর দ ত ব য় জন ধরন র করহ র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার যেভাবে হলে ভালো হয়
অন্তর্বর্তী সরকার গত ১২ মে একটি অধ্যাদেশ জারি করে ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’ (এনবিআর) এবং ‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ’ (আইআরডি)-এর বিলুপ্তি ঘোষণা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি নতুন বিভাগ– ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’ এবং ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ গঠনের প্রস্তাব করেছে। তবে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিপুল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে সরকার গত ২২ মে পুরো সংস্কার প্রস্তাবটি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। সরকার অংশীজনের সঙ্গে আরও আলোচনা করে তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে।
দেশের মোট রাজস্বের ৯১ ভাগই কর-রাজস্ব, যার প্রায় পুরোটাই আদায় করে এনবিআর। সে কারণে এনবিআরের সংস্কার এত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীর বহু দেশেই রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং রাজস্বনীতি বাস্তবায়ন বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পৃথক সংস্থার হাতে আছে; উভয়ের মধ্যে একটি বিভাজন বা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ থাকে। রাজস্বসংক্রান্ত আইন যেমন– শুল্ক আইন, আয়কর আইন তেমনি অর্থ আইন সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান যেমন– আয়কর ও শুল্কবিধি, সময়ে সময়ে জারিকৃত স্ট্যাটিউটরি রেগুলেশনস অর্ডার (এসআরও) এবং বিভিন্ন ধরনের করের হার নির্ধারণ রাজস্বনীতির অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, এসব কর আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োগ এবং রাজস্ব আদায় করা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অংশ। প্রায় সব দেশেই রাজস্বনীতি প্রণয়নের দায়িত্বটি থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে এবং এই নীতি বাস্তবায়ন বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটি পালন করে সেই মন্ত্রণালয়েরই অধীন কোনো কার্যনির্বাহী বিভাগ/অধিদপ্তর বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা (স্ট্যাটিউটরি বডি)। এটি লোক প্রশাসনের মৌলিক নীতি-ব্যবস্থাপনা বিভাজনের স্বীকৃত পন্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তা সব সেক্টরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে কর বা রাজস্বনীতি প্রণয়নের দায়িত্ব (অন্তত তাত্ত্বিকভাবে) পালন করে আসছিল অর্থ মন্ত্রণালয়েরই একটি অংশ ‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ’, যদিও বাস্তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারাই খসড়া আইন, বিধিবিধান, এসআরও এবং কর প্রস্তাব তৈরি করে তা আইআরডিতে প্রেরণ করে থাকে। অন্যদিকে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ রাজস্বনীতির প্রয়োগ এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডই পালন করে আসছে। রাজস্বনীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মধ্যে কোনো বিভাজন বা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ নেই– সেটি বলা যায় না।
এদিক থেকে করনীতি ও কর ব্যবস্থাপনার বিভাজন বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো সংস্কার বা অনন্য বিষয় নয়। নতুন প্রস্তাবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বর্তমানের সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ‘এনবিআর’-এর স্থলে প্রস্তাবিত ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’কে (যা অর্থ মন্ত্রণালয়েরই একটি অংশ) দেওয়া হয়েছে, যা কার্যত ‘সোনার পাথর বাটি’ বলে মনে হয়। কারণ মন্ত্রণালয়ের তো নীতিনির্ধারণের কাজই করার কথা। পৃথিবীর কোনো দেশেই রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকে না। এটি থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন এক বা একাধিক কার্যনির্বাহী সংস্থা যেমন– সরকারি বিভাগ/অধিদপ্তর বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার হাতে। প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়ন করা হলে রাজস্বনীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মধ্যে যেমন সমন্বয় কঠিন হয়ে পড়বে (কারণ কেউ কারও অধীন মেনে নেবে না), তেমনি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব আদায় আরও জটিল হয়ে পড়বে। কারণ এতে ব্যবস্থাপনার মধ্যে অতিরিক্ত আরও একটি স্তর বাড়বে, শীর্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান এবং মাঠ পর্যায়ের ইউনিটগুলোর বর্তমান সহজ আন্তঃসংযোগ কঠিন হয়ে পড়বে এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ভাবধারার উদ্ভব ঘটবে। তবে ‘রাজস্বনীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’র সংস্কারগুলো নিম্নরূপ হতে পারে বলে আমি মনে করি:
এক. রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটির স্থলে দুটি বোর্ড গঠন: বর্তমানের একটি রাজস্ব বোর্ডের স্থলে দুটি রাজস্ব বোর্ড বা সংস্থা গঠন করা যায়-(ক) একটি প্রত্যক্ষ করের (আয়কর) জন্য, (খ) অপরটি পরোক্ষ করের (শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি) জন্য, ভারতে যেমন আছে। অনেকেই মনে করেন, দুটি বোর্ডের মধ্যে আয় বাড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে এবং কর ব্যবস্থাপনা অধিকতর লক্ষ্যভিত্তিক হবে। অন্যদিকে এনবিআরে আগে থেকেই উক্ত দুই দিকেই পর্যাপ্ত এবং সমসংখ্যক সদস্য থাকায় দুটি বোর্ড গঠিত হলে কোনো ব্যয় বাড়বে না। ভারতের মতো এই সংস্থা দুটির প্রধান হবেন যথাক্রমে বিসিএস আয়কর এবং বিসিএস শুল্ক ক্যাডারের জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তা এবং তাদের সরকারের একজন সচিবের পদমর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। বোর্ডের অন্য সদস্যরা জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ক্যাডার হতে নিয়োগ পাবেন।
দুই. এনবিআরে বেসরকারি খাত থেকে
অ-নির্বাহী সদস্য নিয়োগ বা পরামর্শ কমিটি গঠন : এনবিআরের স্থলে যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের জন্য দুটি পৃথক বোর্ড গঠন করা হয়, তবে কর্ম-সম্পাদনে সাফল্য, দক্ষতা, করদাতাদের সেবা প্রদান, কর্ম-কৌশল এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে বোর্ডকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, পেশাজীবী এবং বেসরকারি খাতের নির্বাহীদের বোর্ডের অ-নির্বাহী সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে তাদের নিয়ে বোর্ডের পরামর্শ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তবে করনীতি প্রণয়ন এবং কোনো ব্যক্তি-বিশেষ বা প্রতিষ্ঠানের কর নির্ধারণ বিষয়ে অ-নির্বাহী সদস্যদের অথবা পরামর্শ কমিটির সদস্যদের পরামর্শ দেওয়ার কোনো ক্ষমতা থাকবে না।
সিঙ্গাপুরের ‘ইনল্যান্ড রেভিনিউ অথরিটি অব সিঙ্গাপুর’-এর উপদেষ্টা বোর্ডে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি রয়েছেন। ‘সিঙ্গাপুর কাস্টমস’-এর পরামর্শক কমিটিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পোর্ট অথরিটি, এয়ারলাইনস, লজিস্টিকস কোম্পানি এবং ফ্রেইট অ্যাসোসিয়েশন প্রতিনিধিরা উপদেষ্টা পরিষদে অ-নির্বাহী সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। যুক্তরাজ্যে এইচএমআরসি পরিচালনার জন্যও একটি বোর্ড রয়েছে এবং এতে বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকজন পেশাজীবী অ-নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। বোর্ডের অ-নির্বাহী পরিচালক পদে কর, অ্যাকাউন্ট্যান্সি, তথ্যপ্রযুক্তি, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, ইত্যাদি বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পেশাজীবী এবং বেসরকারি খাতের নির্বাহীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। বেসরকারি খাতের পরিচালকদের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা এবং পেশাদার ব্যাকগ্রাউন্ড বোর্ডের পরামর্শের জন্য একটি বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে এবং তাতে বোর্ডের কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কর্ম-কৌশল নির্ধারণে গুণগত পরিবর্তন আশা করা যায়।
তিন. ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’ কীভাবে গঠিত হওয়া উচিত: ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’ মূলত কাস্টমস ও আয়কর এবং অর্থ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য ক্যাডার সদস্যদের দ্বারা গঠিত হওয়া উচিত। কারণ, এটি একটি অত্যন্ত বিশেষায়িত কাজ, অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর মতো নয়। সাধারণ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পক্ষে রাজস্বনীতি কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সহজ হবে না, কারণ এটির জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ জ্ঞান এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার বাস্তব অভিজ্ঞতা। তবে সেই সঙ্গে বাজার থেকে অর্থনীতিবিদ ও অন্য পেশাজীবীদেরও ‘রাজস্বনীতি বিভাগে’ আনতে হবে। এই জনবল নীতির পাশাপাশি, ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’কে পরিকল্পনা কমিশনের মতো একটি বিশেষ স্বাধীন সংস্থার আদলে পরিচালিত হতে হবে এবং এর গঠন কাঠামো ফ্ল্যাট বা সমতল হতে হবে, যেখানে একাধিক সদস্য সমান পদমর্যাদা ও অবস্থানে থাকবেন। এটি যেন সচিব, অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম সচিব ইত্যাদির মতো আমলাতান্ত্রিক ও পদসোপান-ভিত্তিক (হায়ারার্কিকেল) কাঠামোতে পরিণত না হয়।
ফিরোজ আহমেদ: সদস্য, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন; সাবেক কর্মকর্তা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক
firozlxp@gmail.com