অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে জাতীয় বাজেট-পূর্ব আলোচনা শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কার্যকরী করহার প্রযোজ্য করহারের তুলনায় অনেক বেশি– এমন অভিযােগ করে বেশির ভাগ সংগঠন কার্যকরী কর যৌক্তিক পর্যায়ে আনার দাবি জানাচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী বাজেটে করহার যৌক্তিক পর্যায়ে নামানোর পদক্ষেপ নেবেন। বিশেষত উৎসে করহার কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন। কীভাবে আয়করের ক্ষেত্রে আইনগত বাধ্যবাধকতা পরিপালন সহজ করা যায় এবং বিভিন্ন পর্যায়ে নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণের বিষয় পরিবর্তনের মাধ্যমে কীভাবে কার্যকরী করহার কমানো যায়– সে বিষয়ে আলোচনার দাবি রাখে।
কার্যকরী করহার বৃদ্ধির কারণ মূলত দুটি। প্রথমত, উৎসে করহার এবং দ্বিতীয়ত, কিছু খরচ বিয়োজনের ক্ষেত্রে আয়কর আইন অনুযায়ী আইনগত বাধ্যবাধকতা পরিপালন না করলে ওই খরচকে খরচ হিসেবে দাবি করা যায় না। আবার কোনো ব্যবসায় আয়ের তুলনায় বিভিন্ন খাতে সর্বোচ্চ কত খরচ দেখানো যাবে, তারও নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে; যার অতিরিক্ত খরচ দাবি করা যায় না।
রিটার্ন দাখিল বাড়ানোর জন্য কিছু ক্ষেত্রে পিএসআর বা রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ জমার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এটা সত্যি, এর ফলে রিটার্ন দাখিল উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের পিএসআর সংগ্রহ না করার কারণে খরচ বিয়োজন না পাওয়ার বিধান আইন থেকে বাদ দিতে হবে। নিম্নলিখিত পদক্ষেপের মাধ্যমে রিটার্ন দাখিল বাড়ানো যাবে এবং ব্যবসায়ীদের ব্যবসার করভার ও খরচ কমানো এবং সহজ করা সম্ভব হবে।
প্রথমত, বর্তমানে ৪০ লাখ রিটার্ন দাখিলকারীর মধ্যে ১৪ লাখ অনলাইনে দাখিল করেছেন। যারা কর অফিসে রিটার্ন দাখিল করেন, তাদের জন্য একটি পোর্টাল তৈরি করতে হবে, যাতে তারা দাখিল করা রিটার্নের করদাতার টিআইএন নম্বর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করদাতার আয়, সম্পদ ও করের পরিমাণ ইনপুট দিতে বলবে। দাখিল করার পর কর কর্মকর্তার ড্যাশবোর্ডে এই তথ্য নিশ্চিত করতে বলবে। কর কর্মকর্তা রিটার্ন রেজিস্টারের সঙ্গে তথ্যের মিল পেলে ‘ইয়েস’ বাটনে চাপ দেবেন অথবা এডিট অপশনে গিয়ে তথ্য ‘এডিট’ করলে পিএসআর তথ্যভান্ডার স্বয়ংক্রিয়ভাবে হালনাগাদ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করা যায় না। আয়কর আইনের ২৬৪ ধারা অনুযায়ী ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ বা নবায়নের সময় পিএসআর দাখিল করতে হয়। এনবিআর ট্রেড লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থাসহ অন্যান্য সংস্থা, যাদের পিএসআর সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা আয়োজন করে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পারে। এর পর সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক করে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি তৈরি করে প্রতিনিয়ত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কার্যকরভাবে পিএসআর সংগ্রহ করতে পারে।
সব খরচ ব্যবসা খরচ নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে খরচের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়ে থাকে, যাতে অযৌক্তিক খরচ ‘ব্যবসা খরচ’ হিসেবে বিয়োজন দাবি করা না যায়। বাংলাদেশের আয়কর আইন অনুযায়ী ধারা ৫৫-তে এরকম কিছু সীমা নির্ধারণ করা আছে। ধরুন, একটি কোম্পানি একজন ব্যবস্থাপককে বছরে ৮০ লাখ টাকা বেতন ও সুবিধা দেয়। এর মধ্যে পারকুইজিট উপাদান ৩০ লাখ টাকা এবং পারকুইজিট ব্যতীত উপাদান ৫০ লাখ টাকা। যেহেতু পারকুইজিট ১০ লাখ টাকা অতিক্রম করেছে, তাই এখানে অতিরিক্ত পারকুইজিট ২০ লাখ টাকা। যদি করহার ২৫ শতাংশ হয়, তবে কোম্পানিকে ৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত কর দিতে হবে। বাস্তবে এটি একটি দ্বৈত কর। কারণ, একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি যখন কোনো অর্থ আয় হিসেবে গ্রহণ করেন, তখন তাঁকে ওই আয়ের ওপর কর দিতে হয়। অন্যদিকে খরচের ওপর কোম্পানিকেও কর দিতে হয়। হাইকোর্ট বিভাগের রায় অনুযায়ী বিষয়টি অবৈধ হলেও, এ বিষয়ে আপিল বিভাগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মামলা চলমান। যদি সম্ভব হয়, এ বিধান প্রত্যাহার করতে হবে। তা না হলে পারকুইজিটের সীমা বাড়াতে হবে।
আবার ধরুন, একটি কোম্পানি তার গ্রুপভুক্ত কোম্পানিকে ১০ কোটি টাকা কারিগরি সহায়তা ফি হিসেবে দিল। ওই ফি বিদেশে পাঠানোর সময় ২ কোটি টাকা উৎসে কর কর্তন করা হলো। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কারিগরি সহায়তা ফি পাঠানো যায় না। ধরি, কোনো বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হলো ৫০ কোটি টাকা। আয়কর আইন অনুযায়ী নিট মুনাফার ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ দাবি করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৫ কোটি টাকার ওপর ২৫ শতাংশ হারে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত কর দিতে হবে। ব্যবসার একটি প্রয়োজনীয় খরচ আয়কর আইনের দৃষ্টিতে বিয়োজনযোগ্য নয়। এ ধরনের বিধান বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করে। যদি এ ধরনের খরচ অপ্রয়োজনীয় হয়, তবে বিদ্যমান আইনের অধীনে ট্রান্সফার প্রাইসিং নিরীক্ষার মাধ্যমে করারোপ করা যায়। তাই সময় এসেছে, এমন বিধান প্রত্যাহার করে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল সক্রিয় করা।
এখন ধরুন, একটি কোম্পানির বিজ্ঞাপন ব্যতীত অন্যান্য প্রচারণামূলক ব্যয় ২০ কোটি টাকা। ওই বছর কোম্পানির বিক্রয় হলো ১ হাজার কোটি টাকা। আয়কর আইন অনুযায়ী, বিক্রয়ের শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থাৎ ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ দাবি করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১৫ কোটি টাকার ওপর ২৫ শতাংশ হারে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত কর দিতে হবে। ব্যবসার একটি প্রয়োজনীয় খরচ আয়কর আইনের দৃষ্টিতে বিয়োজনযোগ্য নয়।
সাধারণত চলমান ভোগ্যপণ্য এবং অনুরূপ শিল্পে টার্নওভারের প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত প্রমোশন খাতে ব্যয় করা হয়ে থাকে, যা মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি সহায়ক প্রচলিত চর্চা। এ ধরনের সীমা নির্ধারণের ফলে অতিরিক্ত করের বোঝা এড়াতে প্রচারণামূলক কার্যক্রম কমে যেতে পারে এবং এর প্রত্যক্ষ প্রভাব সরাসরি সহযোগী শিল্প প্রতিষ্ঠানে পড়বে, সে ক্ষেত্রে তাদের রাজস্ব উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যেতে পারে। এ কারণেও সরকারি রাজস্ব আহরণ কমার শঙ্কা থাকে। ব্যবসায়িক প্রমোশনের সঙ্গে হাজার হাজার লোকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ ধারার প্রভাবে তাদের কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যাবে। ২০১৯ সালের অর্থ আইনে যখন এ বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল, শুধু ওষুধ শিল্পের প্রচারণা ব্যয় কমানোর জন্যই এ বিধান হয়েছে। বাস্তবে আইনে সুস্পষ্ট করা হয়নি। ফলে এ বিধান সব কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে। অন্যদিকে আয়কর আইনের ৫৫(ঝ) ধারায় বিভিন্ন শিল্পের জন্য ফ্রি স্যাম্পল বাবদ আলাদা সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেহেতু ফ্রি স্যাম্পলের জন্য একটি পৃথক ধারা রয়েছে, তাই ৫৫(ঞ) ধারাটি কিছুটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কারণ ফ্রি স্যাম্পলও তো এক ধরনের প্রচারণামূলক ব্যয়।
ওপরের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করলে করজাল বাড়বে। দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাবেন। আস্থা বাড়লে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানও বাড়বে। কর আহরণও বাড়বে বলে আশা করা যায়।
লেখক: পরিচালক, এসএমএসি
অ্যাডভাইজেরি সার্ভিসেস
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আয়কর আয়কর আইন র দ খ ল কর ক র যকর ব যবস য় ত খরচ দ প এসআর র জন য কর দ ত ব য় জন ধরন র করহ র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
৩০ নভেম্বরের মধ্যে করদাতাদের ই-রিটার্ন জমা দিতে বলেছে এনবিআর
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে তাঁদের ই-রিটার্ন জমা দিয়েছেন। গত আগস্টে সব করদাতার জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
ই-রিটার্ন সিস্টেম ব্যবহার করে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে সব ব্যক্তি করদাতাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে এনবিআর। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ অনুরোধ জানায় সংস্থাটি।
গত বছর নির্দিষ্ট এলাকার অধিক্ষেত্রের ব্যক্তি করদাতা, সারা দেশে ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়। তাতে ১৭ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেন।
দেশে বর্তমানে ১ কোটি ১২ লাখের মতো কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিবছর মাত্র ৪০ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন দাখিল করেন।
এনবিআর জানায়, এক বিশেষ আদেশের মাধ্যমে চলতি বছর ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের প্রবীণ করদাতা, শারীরিকভাবে অসমর্থ বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন করদাতা, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতা, মৃত করদাতার পক্ষে আইনগত প্রতিনিধি কর্তৃক রিটার্ন দাখিল এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিক ছাড়া সব ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
চলতি ২০২৫-২৬ করবর্ষে যেসব করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, তাঁরাও চাইলে অনলাইনে ই-রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। অন্যদিকে ই-রিটার্ন সিস্টেমে নিবন্ধনসংক্রান্ত সমস্যার কারণে কোনো করদাতা অনলাইনে রিটার্ন জমা দিতে না পারলে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপকর কমিশনারের কাছে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে আবেদন করলে অতিরিক্ত বা যুগ্ম কর কমিশনারের অনুমোদনক্রমে কাগুজে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এই সময়সীমা ৩১ অক্টোবর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে।
এনবিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, করদাতার পক্ষে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিও অনলাইনে ই-রিটার্ন জমা দিতে পারছেন। এ ছাড়া বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতাদের ক্ষেত্রে অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও তাঁদের পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, ই-মেইল ইত্যাদি তথ্য দিয়ে ই-মেইল করলে ই-রিটার্নের নিবন্ধন লিংক পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতারা ই-রিটার্ন সিস্টেমে নিবন্ধন করে সহজেই অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন। কোনো ধরনের কাগজপত্র বা দলিল আপলোড না করেই করদাতারা তাঁদের আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায়ের প্রকৃত তথ্য ই-রিটার্ন সিস্টেমে এন্ট্রি করে ঝামেলাহীনভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন। ই-রিটার্ন দাখিলের পর তাৎক্ষণিকভাবে জমা স্লিপ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে আয়কর সনদও প্রিন্ট করে নিতে পারছেন করদাতারা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ই-রিটার্ন জমা সহজ করার জন্য গত বছরের মতো এবারও করদাতাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ই-রিটার্নসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় করদাতাদের সহায়তা দিতে একটি কল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। আবার ওয়েবসাইটে ই-রিটার্নসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা লিখিতভাবে জানালেও তার সমাধান পাচ্ছেন করদাতারা। কোনো করদাতা সশরীর নিজ নিজ কর অঞ্চলে গিয়েও ই-রিটার্ন জমা দেওয়াসংক্রান্ত সেবা নিতে পারছেন।