ইউএসএআইডির তহবিল: বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিপথ কি হুমকির মুখে
Published: 15th, March 2025 GMT
বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিপথ কি বাধাগ্রস্ত হতে চলেছে—এ প্রশ্ন এখন অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সম্প্রতি মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির বাংলাদেশে তহবিল বন্ধের ঘোষণা আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটি দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, নারীর ক্ষমতায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছিল। হঠাৎ তহবিল বন্ধের এ সিদ্ধান্ত শুধু উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্যই চ্যালেঞ্জ তৈরি করেনি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে।
তহবিল বন্ধের কারণ ও সম্ভাব্য প্রভাবইউএসএআইডির তহবিল বন্ধের সিদ্ধান্তের পেছনে আনুষ্ঠানিক কারণ উল্লেখ না করা হলেও বিশেষজ্ঞরা এটিকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে যুক্ত করছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবাধিকারসংক্রান্ত ইস্যু ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির পরিবর্তন এ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। ইউএসএআইডি বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নে।
এ ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়ন, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও কৃষি খাতে খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষিপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও কৃষকদের প্রশিক্ষণে সংস্থাটির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। নারীর ক্ষমতায়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগসহনশীল অবকাঠামো উন্নয়নেও ইউএসএআইডি কাজ করে আসছে। তহবিল বন্ধের কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও চাকরির বাজারইউএসএআইডির তহবিল বন্ধের প্রভাব শুধু উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; এটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) কর্মসংস্থানের ওপরও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। এ সিদ্ধান্তের কারণে অনেক এনজিও কর্মী চাকরি হারাচ্ছেন, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য নতুন সংকট তৈরি করেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রেও এ ঘোষণার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে কর্মরত মার্কিন নাগরিক ও মার্কিন সংস্থাগুলোর ওপরও তার প্রভাব পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটমার্কিন সরকারের নতুন নীতিগত অগ্রাধিকার এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় সহায়তা কমিয়ে আনা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত তাদের বৈদেশিক নীতির একটি বড় পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে তাদের বৈশ্বিক সহায়তা কৌশলে আরও পরিবর্তন আনতে পারে।
সংকট নাকি সম্ভাবনাএ সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ বটে, কিন্তু এটি আত্মনির্ভরশীলতার পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগও তৈরি করেছে। দেশীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার, বিকল্প আন্তর্জাতিক সহায়তা অনুসন্ধান এবং স্থানীয় বিনিয়োগ উৎসাহিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ এ সংকটকে একটি সম্ভাবনায় রূপান্তর করতে পারে। পাশাপাশি কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উন্নয়নমূলক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
ইউএসএআইডির তহবিল বন্ধের সিদ্ধান্ত শুধু একটি আর্থিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি জটিল সমীকরণ। ডোনাল্ড ট্রাম্পের হটকারী সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে বর্তমান প্রশাসনের নীতিগত পরিবর্তন, আদালতের নির্দেশনা ও মার্কিন প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ চাপ—এ সবকিছুই এই সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করতে পারে। তবে এ সিদ্ধান্তের প্রভাব শুধু বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পেই সীমাবদ্ধ নেই; এটি মার্কিন নাগরিক ও সংস্থাগুলোর ওপরও প্রভাব ফেলেছে।
এ সিদ্ধান্তের পরিণতি যা–ই হোক না কেন, বাংলাদেশের জন্য এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ কীভাবে এ চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে একটি টেকসই ও স্বাধীন উন্নয়নকাঠামো গড়ে তোলে।
মো.
তৌফিক হোসেন, ডেপুটি কো–অর্ডিনেটর, ওয়েভ ফাউন্ডেশন
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউএসএআইড র তহব ল র জন ত ক তহব ল ব র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
ডলারের সিংহাসন কি কেঁপে উঠছে
গত জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হয়ে ফেরার পর বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান মনে করিয়ে দিয়েছেন চার্লস পি কিন্ডলবার্গারের সেই কথা, ‘আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ে বেশি ভাবলে মানুষ পাগল হয়ে যায়।’ এমন অস্থির সময়েই ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে ডলারের আধিপত্য নিয়ে দুটি বই—পল ব্লুস্টেইনের ‘কিং ডলার’ এবং কেনেথ রগফের ‘আওয়ার ডলার, ইয়োর প্রবলেম’।
দুটি বই-ই ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর প্রকাশিত। ব্লুস্টেইনের বইটি বেরিয়েছিল ট্রাম্পের বিশ্ব অর্থনীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরুর আগে। রগফ ও আমি ১৯৮৩ সাল থেকে একসঙ্গে গবেষণা করেছি। ব্লুস্টেইন ছিলেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সাংবাদিক।
এমআইটিতে পড়ার সময় আমরা শিখেছিলাম, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে সবকিছু একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাই ডলারের আধিপত্য বোঝার জন্য বৈশ্বিক রাজনীতি, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক চিন্তায় পরিবর্তনের দিকে নজর দিতে হয়। রগফ ও ব্লুস্টেইনের বই এই বিষয়গুলো সহজ করে ব্যাখ্যা করেছে। ডলার ১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস সম্মেলনের মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা ও বাণিজ্যের মাধ্যম হয়ে ওঠে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি ডলারের শীর্ষস্থান নিশ্চিত করেছিল।
সে সময় অধিকাংশ দেশ নিজেদের মুদ্রাকে ডলারের সহযোগী হিসেবে দাঁড় করায়। আর যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দেয়, চাইলে প্রতি আউন্স সোনার বিনিময়ে তারা ৩৫ ডলার ফেরত দেবে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল অপেক্ষাকৃত স্বাধীন; তবে তাকে বিশ্বব্যবস্থার স্থিতিশীলতার দিকেও খেয়াল রাখতে হতো।
১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধব্যয়, বাজেট–ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন তখন ডলারে স্বর্ণ বিনিময় বন্ধ করেন এবং আমদানি শুল্ক বসান। ট্রেজারি সেক্রেটারি জন কনলি তখন বলেছিলেন, ‘ডলার আমাদের মুদ্রা, কিন্তু এটা তোমাদের সমস্যা।’ এরপর বড় বড় দেশগুলো নিজেদের মুদ্রাকে জাগিয়ে তুলতে শুরু করে। অনেকেই ভেবেছিলেন, ডলারের আধিপত্য কমবে, কিন্তু তা হয়নি।
বিশ্বব্যাপী আর্থিক তত্ত্বাবধানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমে যাচ্ছে। ফেডের ডলার সোয়াপ লাইনের ওপরও আস্থা দুর্বল হচ্ছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি অতিরিক্ত উদার হলেও ডিজিটাল ডলার বা সিবিডিসি চালুর উদ্যোগ বন্ধ করেছে। এটি বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে আরও একঘরে করছে।ডলার নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও টিকে থেকেছে। ১৯৭০-এর দশকে আইএমএফ বিশেষ ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) চালু করলেও, ডলার বিকল্প হারায়নি। ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান পল ভলকারের কঠোর নীতিতে মূল্যস্ফীতি কমে আসে, আর্থিক বাজারের উদারীকরণ হয় এবং মার্কিন ট্রেজারি বন্ড বিশ্বের কাছে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে জনপ্রিয় হয়।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ৮৮ শতাংশে এখনো ডলার বিজড়িত। তবে ডলারের শক্তির ভিত্তি (আইনের শাসন, মুক্তবাজার, মূল্য স্থিতিশীলতা) ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আমেরিকার আর্থিক অব্যবস্থাপনা এত বেড়েছে যে কংগ্রেসের কাছ থেকে দায়িত্বশীল বাজেট প্রত্যাশা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ব্লুস্টেইন কিছুটা আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু রগফ মনে করেন, ডলারের আধিপত্যের সময় ফুরিয়ে আসছে এবং পতনের মূল কারণ আমেরিকার নিজের ভেতর থেকেই আসছে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কমিয়ে দিয়েছে, মিত্রদের আস্থা হারিয়েছে এবং দেশের ভেতর ফেডারেল রিজার্ভ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে। এতে ডলারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আরও পড়ুনএকটি কাগজের নোট যেভাবে অস্ত্র হয়ে উঠল০২ এপ্রিল ২০২৫বিশ্বব্যাপী আর্থিক তত্ত্বাবধানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমে যাচ্ছে। ফেডের ডলার সোয়াপ লাইনের ওপরও আস্থা দুর্বল হচ্ছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি অতিরিক্ত উদার হলেও ডিজিটাল ডলার বা সিবিডিসি চালুর উদ্যোগ বন্ধ করেছে। এটি বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে আরও একঘরে করছে।
এপ্রিলের শুরুতে ট্রাম্প যখন ‘মুক্তির দিন’ ঘোষণা করে নতুন শুল্ক আরোপ করেন, তখন মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার বেড়ে যায়, আর ডলার পড়ে যায়। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মার্কিন সম্পদের ওপর আস্থা কমে যায় এবং শেয়ারবাজারও বড় ধাক্কা খায়।
এই এপ্রিল মাস সত্যিই টি এস এলিয়টের ভাষায় ‘সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাস’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব মুদ্রাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ডলারের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। যদি বর্তমান প্রবণতা চলতে থাকে, তাহলে হয়তো বিশ্ব মুদ্রাব্যবস্থায় ডলারের একক আধিপত্যের যুগ শেষ হয়ে আসছে।
● মরিস অবস্ফেল্ড আইএমএফের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বার্কলে)-এর অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনূদিত