‘হিজড়া’ বাংলাদেশে লিঙ্গ বৈচিত্র্যের একটি জনগোষ্ঠী। এখনও পর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা না থাকলেও, শারীরিক ও মানসিক গঠনে যারা চিরাচরিত নারী বা পুরুষের সবটুকু বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারেন না, এই ধরনের মিশ্র এবং দ্বৈত বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরাই সমাজে ‘হিজড়া’ নামে পরিচিত। ভিন্নধর্মী আচরণের কারণে অধিকাংশ হিজড়া ব্যক্তিই পরিবারচ্যুত হওয়ার ফলে সামাজিক বন্ধনের বাইরে এসে সমগোত্রীয়দের সঙ্গে ভাসমান জীবনযাপনে বাধ্য হন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন। কিন্তু লিঙ্গ বৈচিত্র্যের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণাগত অস্পষ্টতা, পরিচয় প্রকাশের ফলে সামাজিক কলুষতায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়সহ নানা কারণে তাদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে।
সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে এবং ২৮ অনুচ্ছেদে লিঙ্গ বা অন্য কোনো পার্থক্যের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবুও বাস্তবতায় হিজড়া জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার। রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় তাদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু থাকলেও, তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবকাঠামোগত ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ব্যক্তির বৈচিত্র্য বা সীমাবদ্ধতা এখানে প্রধান বাধা নয়; বরং সামাজিক এবং প্রশাসনিক অন্তর্ভুক্তির ঘাটতিই তাদের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ‘কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না’– এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নির্ধারণ করা হলেও, হিজড়া জনগোষ্ঠী এখনও পিছিয়ে রয়ে গেছে।
মূলধারার শিক্ষার অভাব, কর্মসংস্থানের সংকীর্ণ পরিসর, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অভাব, পারিবারিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং নানাভাবে পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার হয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, বাজার, যানবাহন, ট্রাফিক সিগন্যালে চাঁদা তোলার মতো ঐতিহ্যগত অনিশ্চিত পেশার ওপর নির্ভরশীল। ফলে তারা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ থেকে যান এবং খাদ্যনিরাপত্তাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় তাদের।
দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে এ সংকট আরও প্রকট হয়। গত বছর আগস্টের শেষ দিকে দেশের পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় সরকারি-বেসরকারি সহায়তা কার্যক্রমে হিজড়ারা প্রায় উপেক্ষিত ছিলেন। নোয়াখালীর মাইজদীর বাসিন্দা মিথিলা হিজড়া জানান, শুধু হিজড়া পরিচয়ের কারণে একই বিল্ডিংয়ের একই মানের বাসায় থেকেও অন্যদের চেয়ে তাদের বেশি ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। বন্যায় তাদের ডেরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের অনেক সমগোত্রীয় এখানে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলে পাড়াপ্রতিবেশীদের কাছ থেকে নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়েছে। ত্রাণ বিতরণের সময় লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে তারা উপেক্ষিত হয়েছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে ত্রাণ গ্রহণ করতে গিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় চাইতে গিয়েও হয়রানির শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষের কাছ থেকে চেয়ে চাঁদা তুলে জীবন চালাই, খাবারের সংস্থান করি। কিন্তু বন্যায় যখন তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমাদের আয়ের সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনের কথা বাদ দিলেও, প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করাই আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।’
প্রাপ্যতা, প্রবেশগম্যতা, ব্যবহার ও স্থিতিশীলতা– আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত খাদ্যনিরাপত্তার এই চার স্তম্ভ অনুযায়ী হিজড়া জনগোষ্ঠীর অবস্থা বিশ্লেষণ করলে প্রতিটি পর্যায়ে বৈষম্যই চোখে পড়ে। বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যসহায়তা যেমন– ভিজিএফ, ভিজিডি, ১০ টাকার চাল, ওএমএস ইত্যাদি কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণের সুনির্দিষ্ট উপাত্ত অনুপস্থিত। অধিকাংশ হিজড়া ব্যক্তি মূলধারার অর্থনীতির বাইরে থাকায় কৃষি বা খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না এবং একইসঙ্গে অনানুষ্ঠানিক ও অনিশ্চিত পেশার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় দুর্যোগ বা অর্থনৈতিক মন্দার সময় খাদ্য কেনার সামর্থ্য কমে যায়। অনেক হিজড়া ব্যক্তি ভাসমান জীবনযাপন করেন এবং অনেকে ভাড়া বাসায় থেকেও বেশি ভাড়া দিতে বাধ্য হন, যা তাদের দৈনন্দিন খাদ্য কেনার বরাদ্দ কমাতে বাধ্য করে। ফলে পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। যেহেতু তাদের আয়ের উৎস অনিশ্চিত, তাই দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত নয়।
২০১৪ সালে সরকারি চাকরিতে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা আসার পর কিছু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিলেও তা খুবই সীমিত। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু থাকলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে টেকসই কর্মসংস্থানে রূপ নেয়নি। ফলে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা নিশ্চিত না হওয়ায় খাদ্যনিরাপত্তার সংকট থেকেই যাচ্ছে। v
লেখক: উন্নয়ন কর্মী
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জনগ ষ ঠ দ র জন র জন য সরক র ত হওয়
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ