সৃজনশীলতা নাকি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন? কাশ্মীরের বরফে উত্তাপ ছড়ানো ফ্যাশন শো নিয়ে বিতর্ক
Published: 17th, March 2025 GMT
বরফে মোড়া কাশ্মীরের গুলমার্গ। সেখানে এক ফ্যাশন শো-কে কেন্দ্র করে তুমুল বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ফ্যাশন প্যারেডে নারীরা কেন খোলামেলা পোশাক পরেছেন? পুরুষেরাও কেন খোলামেলা পোশাক পরেছেন? তা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। রমজান মাসে এ ধরনের অনুষ্ঠান ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে বলে মনে করছেন অনেকে।
গত শুক্রবার বিশ্ববিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড শিভান এবং নরেশ তাদের স্কিওয়্যার প্রদর্শনের জন্য এই শো আয়োজন করে। এটি ছিল কাশ্মীরে আয়োজিত প্রথম বড় ফ্যাশন শো যেখানে কোনো অ-স্থানীয় বিখ্যাত ব্র্যান্ড অংশ নেয়।
তবে ফ্যাশন প্রকাশক এল ইন্ডিয়া যখন শো-এর একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে, তখনই বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, কিছু মডেল অন্তর্বাস বা বিকিনি পরে রয়েছেন। এছাড়া লাইফস্টাইল এশিয়া ম্যাগাজিনের আরেকটি ভিডিওতে শো-এর পর একটি পার্টির দৃশ্য দেখানো হয়, যেখানে প্রকাশ্যে মদ্যপানের চিত্র ধরা পড়ে।
কাশ্মীরের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার অনেকে রমজান মাসে এমন আয়োজনকে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা বলে মনে করছেন। অনেক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাও এই আয়োজনের কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিছু ধর্মীয় নেতা এটিকে “অশ্লীল” এবং “সফট পর্ন” বলে অভিহিত করেছেন।
তবে শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, অনেক স্থানীয় মানুষ মনে করছেন এটি কাশ্মীরের সংস্কৃতি ধ্বংস করার একটি বহিরাগত প্রয়াস। কাশ্মীর ১৯৮০-এর দশক থেকে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন এবং সহিংসতার সাক্ষী হয়ে আসছে, ফলে অনেক কাশ্মীরি মনে করেন, বাইরের প্রভাব তাদের ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ন করছে।
বিতর্ক বাড়তে থাকায় এল ইন্ডিয়া এবং লাইফস্টাইল এশিয়া তাদের ভিডিও মুছে ফেলেছে। এছাড়া, শো-এর ডিজাইনার শিভান ভাটিয়া ও নরেশ কুকরেজা এক যৌথ বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সৃজনশীলতাকে উদযাপন করা, কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া নয়।”
বিতর্ক কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভাতেও এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। বিরোধী দল সরকারকে দায়ী করে বলে, স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুভূতির কথা জেনেও কেন এই শো-এর অনুমতি দেওয়া হলো?
জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ অবশ্য সরকারকে এর দায় থেকে মুক্ত করেছেন। তিনি জানান, শো-এর আয়োজন সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে করা হয়েছে, সরকার এতে জড়িত নয়। তবে, স্থানীয় প্রশাসনকে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। আইন লঙ্ঘন হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ শেফালি বসুদেব বলেন, দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক স্থানে ফ্যাশন শো আয়োজন নতুন কিছু নয়। বিশ্ববিখ্যাত ডিজাইনার আলেকজান্ডার ম্যাককুইন এবং কার্ল ল্যাগারফেল্ডও তাদের নাটকীয় ও ব্যতিক্রমী ফ্যাশন শো-এর জন্য পরিচিত। তবে, তিনি উল্লেখ করেন, যে কোনো স্থানে এমন আয়োজনের আগে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী পোশাক সাধারণত রক্ষণশীল। স্থানীয় পুরুষ ও নারীরা প্রায়ই ফেরান নামে পরিচিত ঢিলেঢালা পোশাক পরেন। তাই এই ফ্যাশন শো-তে বিকিনি ও অন্তর্বাস প্রদর্শন কাশ্মীরি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান বলে মনে করছেন অনেকে।
সরকারি উদ্যোগে পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটায় কাশ্মীরে পর্যটকদের সংখ্যা বেড়েছে। তবে, অনেক কাশ্মীরি মনে করেন, বহিরাগতরা তাদের সংস্কৃতিকে যথাযথ সম্মান দেখাচ্ছে না। এই বিতর্কের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো যে, কাশ্মীরে যেকোনো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইস্যু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।