বদলে যাচ্ছে দেখার ধরন: সাদা–কালো টিভি থেকে মুঠোফোনে ওটিটি
Published: 18th, March 2025 GMT
একসময় ঘরে ঘরে বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল টেলিভিশন। তখন টেলিভিশনের পর্দা ছিল সাদা–কালো আর আকারে ছিল বেশ বড়সড় বাক্সের মতো। বাংলাদেশে তখন চ্যানেল বলতে বিটিভিই ছিল একমাত্র ভরসা। সন্ধ্যা হলেই পরিবার-পরিজন মিলে টিভির সামনে বসা ছিল একধরনের রীতি। বিনোদনের অন্যতম উৎস ছিল নাটক, খবর বা চলচ্চিত্র। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটতে থাকে, আর টেলিভিশনও হতে থাকে আধুনিক। সাদা–কালো থেকে রঙিন পর্দায় রূপ নেয় টেলিভিশন, আকৃতিতে হয় ‘ফ্ল্যাট’। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির বদৌলতে একে একে চালু হতে থাকে নানা চ্যানেল। খবর, খেলাধুলা, সংগীত, কার্টুন, এমনকি প্রাণিজগৎ নিয়েও আলাদা চ্যানেল গড়ে ওঠে। বড় হতে শুরু করে বিনোদনের পরিসর।
প্রচলিত টেলিভিশনের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এটি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসেই দেখতে হতো। সেই সঙ্গে নির্দিষ্ট চ্যানেলের সময়সূচি অনুযায়ীই দেখতে হতো যেকোনো অনুষ্ঠান। কিন্তু ইন্টারনেট যত সহজলভ্য হতে শুরু করে, ততই বদলে যেতে থাকে এই চিত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার গতি বাড়তে থাকে, ফলে বিনোদনের চাহিদাও বদলে যায়। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার ফলে এই পরিবর্তন আরও গতি পায়। স্মার্টফোন এখন প্রায় সবার হাতে আর স্মার্টফোন মানেই সবকিছু হাতের মুঠোয়—সকালের অ্যালার্ম থেকে শুরু করে অফিসের মিটিং পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই বিনোদনের অভিজ্ঞতাতেও তাই এসেছে পরিবর্তন।
বিনোদনের নতুন প্ল্যাটফর্ম: ওটিটিপ্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিনোদনের ক্ষেত্রেও এসেছে নতুন ধারা, ‘ওভার দ্য টপ’ বা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। এটি মূলত অনলাইনভিত্তিক স্ট্রিমিং সার্ভিস, যেখানে দর্শকেরা নিজেদের সুবিধামতো সময় ও স্থানে ভিডিও কনটেন্ট দেখতে পারেন। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, ডিজনি+ ইত্যাদি। তবে শুধু বিদেশি প্ল্যাটফর্মই নয়, বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দেশীয় ওটিটি সার্ভিসও।
এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে টফি। মোবাইল ফোন বা স্মার্ট টিভিতে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে দর্শকেরা সহজেই এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারেন। টফিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বিনোদনমূলক কনটেন্ট—মুভি, ওয়েব সিরিজ, লাইভ স্পোর্টস—এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ স্ট্রিমিংও। বিশেষভাবে, খেলার প্রতি ভালোবাসার কারণে বাংলাদেশে এটি আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ, একসময় টিভি ছাড়া অন্য কোথাও খেলার সরাসরি সম্প্রচার খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। তাই বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য টফির বিশেষ আকর্ষণ হলো—লাইভ ক্রিকেট ও ফুটবল ম্যাচ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্প্রতি শেষ হওয়া আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সব ম্যাচ শুধু টফিতেই দেখা গেছে।
এ বিষয়ে বাংলালিংকের চিফ ডিজিটাল অফিসার গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্রিকেট কেবল একটি খেলা নয়, এটি একটি আবেগেরও নাম। আমরা চাই, দেশের প্রত্যেক ক্রিকেটপ্রেমী যেন সহজে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে, সবচেয়ে ভালো মানের স্ট্রিমিং উপভোগ করতে পারেন। সে লক্ষ্যেই নিরলস কাজ করে যাচ্ছি আমরা।’
কেন জনপ্রিয় হচ্ছে ওটিটি?ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হলো এর সহজলভ্যতা। প্রচলিত কেব্ল বা স্যাটেলাইট টিভির তুলনায় এটি বেশি সুবিধাজনক। এখানে নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা করতে হয় না, দর্শক নিজেদের পছন্দমতো সময়ে কনটেন্ট দেখতে পারেন। আর টফির ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সুবিধা হলো, বেশির ভাগ কনটেন্ট বিনা মূল্যে দেখা যায় আর কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে নামমাত্র সাবস্ক্রিপশন ফি; অর্থাৎ কম খরচেই প্রিমিয়াম মানের বিনোদন উপভোগ করা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে বিনোদন পুরোপুরি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম–নির্ভর হয়ে যাবে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে টফির মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর চাহিদা আরও বাড়বে। তবে এই খাতের টেকসই উন্নতির জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ এবং নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণ করা গেলে বাংলাদেশেও ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো আরও সমৃদ্ধ হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ল য টফর ম জনপ র য় কনট ন ট
এছাড়াও পড়ুন:
মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ, সভ্যতার তিন শত্রুকে ঠেকাব কী করে
ইউভাল নোয়াহ হারারি তাঁর বহুল আলোচিত হোমো ডিউস বইয়ে যুক্তি দিয়েছেন, মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে তিনটি প্রধান বিপদ। এক. মহামারি, দুই. দুর্ভিক্ষ, এবং তিন. যুদ্ধ।
হারারির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে আমরা প্রথম দুটি বিপদ (মহামারি ও দুর্ভিক্ষ) অনেকটাই জয় করেছি।
মহামারির ইতিহাস নিঃসন্দেহে ভয়ংকর ও বিভীষিকাময়। কিন্তু আশার কথা হলো, আধুনিক মাইক্রোবায়োলজির সাফল্যে আমরা কোভিড-১৯-এর মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসকে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি।
ম্যালেরিয়া মশার কামড়ে ছড়ায়—রোনাল্ড রস ও তাঁর সহকর্মীরা কীভাবে তা আবিষ্কার করেন, ছেলেবেলায় আমরা সেই গল্প পাঠ্যবইয়ে পড়েছি। তার আগে বহু মানুষ ম্যালেরিয়ার জন্য সন্ধ্যার বাতাস বা অলৌকিক কারণকে দায়ী করতেন। কুসংস্কার ছিল মানুষের একমাত্র ব্যাখ্যা। অথচ প্রকৃতিতেই ছিল প্রতিষেধক—দক্ষিণ আমেরিকার সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে তৈরি কুইনাইন।
আরও পড়ুনগাজা থেকে ইউক্রেন—যে কারণে এত যুদ্ধ২১ জুলাই ২০২৫কলেরাকে একসময় বলা হতো ‘ওলা ওঠা’; শরৎচন্দ্রের রচনায় ‘ওলাদেবী’র মতো পৌরাণিক চরিত্রের কথা আমরা পড়েছি, যিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে প্রাণ হরণ করেন। অথচ এই মরণব্যাধির মূল কারণ ছিল দূষিত পানি। আজ এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুড় ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে বানানো ওরস্যালাইনই সেই ‘ওলাদেবী’কে হার মানিয়েছে।
টাইফয়েড, প্লেগ, ব্ল্যাক ফিভার, সিফিলিস ইত্যাদি বহু রোগ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল স্মলপক্স বা বসন্ত, যা দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী জনপদকে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।
আজ বিজ্ঞান সে রোগকেও চিরতরে বিলুপ্ত করেছে—বসন্ত এখন কেবল গবেষণাগারের বিষয়।
হারারির দ্বিতীয় শত্রু—দুর্ভিক্ষ। মানব ইতিহাসে হাজারো দুর্ভিক্ষ নথিবদ্ধ আছে। কিন্তু গত ১৫০ বছরে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৭ থেকে ১২ কোটি মানুষ। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল একটির কারণ, তবে যুদ্ধ, প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক অবহেলা ছিল আরও বড় কারণ।
আরও পড়ুনমহামারি ও যুদ্ধ অপুষ্টি বাড়িয়েছে৩১ জানুয়ারি ২০২৪আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি, খাদ্যশস্যের অধিক উৎপাদন, গুদামজাতকরণ ও বৈজ্ঞানিক বিতরণব্যবস্থা আজ দুর্ভিক্ষকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
তৃতীয় বিপদ—যুদ্ধ। ১৮০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। হারারি মনে করেন, যুদ্ধের পেছনের যুক্তিগুলো আজকাল আর তেমন কার্যকর নয়। একসময় যুদ্ধ হতো জমি, সম্পদ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য। কিন্তু আধুনিক যুগে সেই প্রয়োজন অনেকটাই বিলুপ্ত।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যদি চীন আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি সামরিক শক্তি দিয়ে দখল করতে চায়, তবে তার খরচ হবে বিপুল। বরং সেখানে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে বহুগুণ। আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ‘মানব মেধা’, যা অস্ত্র দিয়ে জবরদস্তিমূলকভাবে দখল করা যায় না।
এই যুক্তিতে হারারি আশাবাদী যে হোমো স্যাপিয়েন্স একসময় রূপ নেবে ‘হোমো ডিউস’ বা এক প্রকার দেবতুল্য প্রজাতিতে। তারা বিজ্ঞানের সহায়তায় শত শত বছর বাঁচবে এবং শুধু বড় দুর্ঘটনাতেই তাদের মৃত্যু হবে।
আরও পড়ুনগাজা নিয়ে ‘গণহত্যামূলক সাংবাদিকতা’ করছে নিউইয়র্ক টাইমস২৬ জুলাই ২০২৫কিন্তু বাস্তবতা এই আশাবাদের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। বইটি প্রকাশের পরপরই শুরু হয়েছে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি এখন আর অলীক নয়, বাস্তবতার অংশ। রাশিয়া পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, তাদের অস্তিত্ব যদি হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে।
এমন কিছু ঘটে গেলে, হারারির পূর্বাভাস যে ভুল প্রমাণিত হবে, তা বলাই বাহুল্য। যদিও তা দেখার মতো তখন কেউ থাকবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
ইরান যদি ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না—এমন নিশ্চয়তা নেই। হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধে ইসরায়েলের গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তারা মিসরের ওপর পারমাণবিক হামলার চিন্তা করছিল।
সেই পরিস্থিতিতে তিনি জরুরি ভিত্তিতে ইসরায়েলকে অস্ত্র ও বিমান সরবরাহ করেন।
বিশ্ব রাজনীতির আরেক উদ্বেগজনক দিক হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় পরিবর্তন। ৯/১১-পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বিখ্যাত ঘোষণা ছিল—‘যদি তুমি আমাদের সঙ্গে না থাকো, তাহলে তুমি আমাদের শত্রু’। এটি শুধু রাজনৈতিক বার্তা নয়, বরং একধরনের বৈশ্বিক দম্ভ ও আধিপত্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
অর্থনৈতিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের দৈন্য এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক আগ্রাসী ভূমিকা নিতে বাধ্য করেছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ইউক্রেন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে চলছে অস্থিরতা, সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়। শান্তি যেন এখন শুধুই এক কৌশলগত বিলাসিতা।
মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ—মানব ইতিহাসের এই তিন মহাশত্রুর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে মানবজাতির অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে অনন্য এক অধ্যায়। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে কৌশলগত স্থিতিশীলতা ও টেকসই শান্তির ভিত্তি রচনা করাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
নইলে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া হোমো ইরেক্টাস, হোমো হ্যাবিলিস কিংবা নিয়ান্ডারথালের মতো আমরাও, মানে আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স একদিন হারিয়ে যেতে পারি সময়ের গর্ভে, অসীম শূন্যতায়।
তুষার কান্তি চাকমা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা