সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবি ঘিরে অশান্ত নাগপুর
Published: 18th, March 2025 GMT
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবিকে ঘিরে মহারাষ্ট্রের নাগপুর শহর অশান্ত হয়ে উঠেছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করা হয়েছে। সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল সোমবার রাতে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এই পরিস্থিতির সূচনা হয় সম্ভাজি নগরকে কেন্দ্র করে। এই জেলার আগের নাম ছিল আওরঙ্গবাদ। বর্তমান নাম ছত্রপতি শিবাজির জ্যেষ্ঠ পুত্র সম্ভাজির নামে, সম্ভাজি নগর। সেখানেই খুলদাবাদ এলাকায় রয়েছে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা সেই সমাধি সেখান থেকে সরানোর দাবি অনেক দিন ধরেই জানিয়ে আসছে। সম্প্রতি সেই দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। গত সোমবার নাগপুর শহরের মহল অঞ্চলে এই দাবিতে বেশ কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রতিনিধিরা জমায়েত করেন। সেই জমায়েতে আওরঙ্গজেবের একটি ছবি এবং সবুজ কাপড়ে ঢাকা এক প্রতীকী কবরে আগুনও লাগানো হয়।
ওই অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে। বিভিন্ন এলাকায় যানবাহন ও দোকানে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশও আক্রান্ত হয়। ওই হাঙ্গামায় অন্তত ২৫ জন পুলিশ কর্মী আহত হন। আহত হন অনেক সাধারণ মানুষও। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ লাঠিপেটা করে ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে।
নাগপুরের পুলিশ কমিশনার রবীন্দ্র সিংঘল জানান, শহরের মোট ১১টি থানা এলাকায় গত সোমবার রাত থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। অশান্তি ছড়ানোর অভিযোগে সোমবার রাতেই শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে পরিস্থিতি থমথমে।
আওরঙ্গজেবের হাতে সম্ভাজি মহারাজের মৃত্যু হয়েছিল। সম্ভাজির জীবনকাহিনি নিয়ে সম্প্রতি এক হিন্দি সিনেমা তৈরি হয়েছে, ‘ছাওয়া’। তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে সেই সিনেমা। তাতে আওরঙ্গজেবের চরিত্রায়ণ মহারাষ্ট্রের অনেক মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাবাবেগকে হাতিয়ার করে কিছু উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আওরঙ্গজেবের সমাধি রাজ্য থেকে সরানোর পুরোনো দাবি নতুন করে তুলতে থাকে। তারা সমাধিক্ষেত্র গুঁড়িয়ে দেওয়ার কর্মসূচিও গ্রহণ করে। সে জন্য খুলদাবাদ অভিযানের ডাক দেওয়া হয়। অভিযান রুখতে জেলা প্রশাসন গত শনিবার থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতাদের জেলায় ঢোকা নিষিদ্ধ করে দেয়। নাগপুর শহরের বিক্ষোভ মিছিল ছিল তারই প্রতিবাদ। বজরঙ্গ দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো সংগঠনও সেই আন্দোলনের পক্ষে থাকার কথা জানিয়েছিল।
সমাধি সরানোর দাবি ঘিরে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত। এই রাজ্যে বিজেপি তার দুই জোট শরিকের সঙ্গে ক্ষমতাসীন। মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাডনবিশ নাগপুরের মানুষ। জনগণকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেছেন, নাগপুর শান্তির জায়গা। নাগপুরবাসী সর্বদা মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। জনতা যেন শান্তি স্থাপনে পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে। তাঁর অভিযোগ, নাগপুরে যা ঘটেছে, তা তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে এক গভীর চক্রান্ত। কেন্দ্রে এনডিএ সরকারের শরিক রিপাবলিকান পার্টি আবার উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দাবির সমালোচনা করে বলেছে, আওরঙ্গজেব ইতিহাসের এক চরিত্র। তাঁর সমাধি সরানোর দাবি ইতিহাসকেই বিকৃত করবে। কংগ্রেস বলেছে, মারাঠাভূমিতে আওরঙ্গজেব পরাস্ত হয়েছিলেন। এটাই ইতিহাস। তাঁর সমাধিও তাই এখানেই। সেই সমাধি সরানোর দাবি জানানোর অর্থ ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানোর চেষ্টা। সম্ভাজি নগরের শিব সেনা (শিন্ডে) নেতারা আবার সমাধি সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে। সব মিলিয়ে নাগপুর হয়ে উঠেছে অশান্ত।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর স থ ত শহর র ব স মব র এল ক য়
এছাড়াও পড়ুন:
বুড়িগঙ্গায় ডুবে যাওয়া কামান কালু ঝমঝমকে কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে একটু সামনে এগোলে ঢাকা গেট। ঢাকা গেটে রাখা আছে মোগল আমলে বাংলার সুবেদার মীর জুমলার কামান ‘বিবি মরিয়ম’। তেমনই একটি কামান ২৩৮ বছর আগে বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে গেছে।
তলিয়ে যাওয়া কামানটির নাম ‘কালু ঝমঝম’। ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনুসন্ধান চালালে কামানটি খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। সে জন্য দরকার সরকারি উদ্যোগ।
কালু ঝমঝম কীভাবে ঢাকায় এল, কে এনেছিল, কীভাবে সেটি বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে গেল—এসবের উত্তর খোঁজা হয়েছে ইতিহাসের বইয়ে। এই লেখায় রয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা। কালু ঝমঝম কোথায় ছিল ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ কর্মচারী হিসেবে ভারতে আসেন রবার্ট লিন্ডসে। তিনি পরে কালেক্টর হয়েছিলেন। ভারতে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন অ্যানেকডোটস অব অ্যান ইন্ডিয়ান লাইফ নামের একটি বই।
রবার্ট লিন্ডসে লিখেছেন, কালু ঝমঝম কামানটি ঢাকা শহরের উল্টো দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর একটি চরে রাখা ছিল। বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদের গ্রন্থে চরটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে মোঘলানী চর।
লিন্ডসে আরও লিখেছেন, কামানটি কোথা থেকে এসেছে, তা স্থানীয় বাসিন্দারা কেউ জানতেন না। অনেকেই বিশ্বাস করতেন, কামানটি অলৌকিকভাবে আকাশ থেকে পতিত হয়েছে। কেউ কেউ কামানটির পূজাও করতেন।
কামানটি বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন রবার্ট লিন্ডসে। তিনি এর কারণ হিসেবে সে সময় ঢাকা শহরে হওয়া বন্যাকে দায়ী করেন। তিনি লিখেছেন, ঢাকা বোর্ডের ভদ্রলোকদের নির্লিপ্ততা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। তাঁরা বন্যার সময় দুই কূল ছাপিয়ে এলাকা প্লাবিত হওয়ার ব্যাপারে কিছুই করেননি। ফলে অস্ত্রটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। উদ্ধার করার আর কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকার সেই ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ১৭৮৭ সালে। সেই ইতিহাস জানা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করা চিকিৎসক জেমস টেইলরের লেখা এ স্কেচ অব দ্য টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস অব ঢাকা গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ১৭৮৭ সালে প্লাবনের ফলে ঢাকা জেলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে দক্ষিণের পরগনাগুলো এবং বুড়িগঙ্গার উত্তরের অঞ্চলটি। বন্যায় কালু ঝমঝমের সলিলসমাধি হয় ১৭৮৭ সালে।
ব্রিটিশ আমলে ঢাকার মোগলানী চরটি ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝখানে, বর্তমান সোয়ারীঘাটের উল্টো দিকে। চরটি মোগল আমলে সামরিক কৌশলগত কারণে ব্যবহৃত হতো।
কালু ঝমঝম কোথায় ছিল ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ কর্মচারী হিসেবে ভারতে আসেন রবার্ট লিন্ডসে। তিনি পরে কালেক্টর হয়েছিলেন। ভারতে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন অ্যানেকডোটস অব অ্যান ইন্ডিয়ান লাইফ নামের একটি বই।কালু ঝমঝমকে স্বচক্ষে দেখেছেন ইংরেজ ভূগোলবিদ ও লেখক জেমস রেনেল। পাশাপাশি রবার্ট লিন্ডসেও সেটি দেখেছেন। দুজনের লেখায় কামানটির বর্ণনা পাওয়া যায়, যা মোটামুটি একই।
জেমস রেনেলের মেমোয়ার অব এ ম্যাপ অব হিন্দুস্তান বইয়ে বলা হয়েছে, ১৪টি লোহার টুকরার ওপর লোহার চাকা পিটিয়ে কামানটি তৈরি করা হয়েছিল। এটির উপরিভাগ মসৃণ ছিল না। কামানটির দৈর্ঘ্য ছিল ২২ ফুট ১০ ইঞ্চি ৫ সেন্টিমিটার। পেছনের অংশের ব্যাস ছিল ৩ ফুট ৩ ইঞ্চি। সামনের অংশ, যেখান থেকে গোলা বের হয়, সেই অংশের ব্যাস ১৫ ইঞ্চি। কামানটির ওজন ছিল ৬৪ হাজার ৮১৪ পাউন্ড (২৯ হাজার ৪০০ কেজি)। কামানের পাশে রাখা ছিল দুটি পাথরের গোলা। আর এর সঙ্গে থাকা প্রতিটি গোলার ওজন ছিল ৪৬৫ পাউন্ড (২১১ কেজি)।
রবার্ট লিন্ডসে কামানটির দৈর্ঘ্য উল্লেখ করেছেন ৩৬ ফুট। উল্লেখ্য, ৬৫ বছর বয়সে লিন্ডসে তাঁর আত্মজীবনী লিখেছিলেন, যার মুখবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তাঁর অনেক স্মৃতিই ধূসর হয়ে গেছে। অন্যদিকে রেনেল তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, তিনি সতর্কভাবে পুরো কামানটির মাপ নিয়েছিলেন এবং আলাদাভাবে প্রতিটি অংশের মাপ হিসাব করেছিলেন। তাই রেনেলের মাপকেই সঠিক বলে গণ্য করেন ইতিহাসবিদেরা।
রবার্ট লিন্ডসে লিখেছেন, কালু ঝমঝম কামানটি ঢাকা শহরের উল্টো দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর একটি চরে রাখা ছিল। বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদের গ্রন্থে চরটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে মোঘলানী চর।রেনেল বা লিন্ডসে কারও বইয়ে কামানটির নাম সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায় না। সেটি পাওয়া যায় ইতিহাসবিদ সৈয়দ মো. তাইফুরের গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে। সেখানে কামানটিকে ‘কালু ঝমঝম’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য কোথাও কোথাও কামানটিকে ‘কালে জমজম’ নামে লেখা হয়েছে। কেউ কেউ একে কালে খাঁ নামও দিয়েছেন। এই নামকরণ কীভাবে, তা জানা যায়নি।
কালু ঝমঝমের সময়ের ১১ ফুট দৈর্ঘ্যের আরও একটি কামান ব্রিটিশদের নজর কেড়েছিল। গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে যেটিকে বিবি মরিয়ম নামে উল্লেখ করা হয়েছে। কামানটি ১৮৩২ সালের আগ পর্যন্ত রাখা ছিল পুরান ঢাকার সোয়ারী ঘাটে।
ধারণা করা হয়, মোগল আমলে বাংলার সুবেদার মীর জুমলা কামানটি সোয়ারি ঘাটে স্থাপন করেছিলেন। ডুবে যাওয়ার শঙ্কায় ১৮৩২ সালে তা আবার স্থানান্তর করা হয় চকবাজারে। এরপর ১৯১৭ সালে সদরঘাটে, সেখান থেকে পাকিস্তান আমলে গুলিস্তানে এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কামানটি সরিয়ে নেওয়া হয় ওসমানী উদ্যানে।
দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়ে থাকার পর গত বছর বিবি মরিয়ম কামানটি ওসমানী উদ্যান থেকে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরের কাছে ঐতিহাসিক ঢাকা গেটে স্থাপন করা হয়।
মীর জুমলা ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবেদার ও মোগল সাম্রাজ্যের একজন প্রভাবশালী সেনাপতি ছিলেন। জগদীশ নারায়ণ সরকারের লাইফ অব মীর জুমলা: দ্য জেনারেল অব আওরঙ্গজেব বই থেকে জানা যায়, মীর জুমলার জন্ম ইরানে। এক দরিদ্র তেল ব্যবসায়ীর পুত্র থেকে তিনি হন ধনী হীরা ব্যবসায়ী এবং পরবর্তী সময়ে গোলকুন্ডার উজির। উল্লেখ্য, গোলকুন্ডা ছিল প্রাচীন ভারতের একটি দুর্গ। তখন দুর্গকেন্দ্রিক একটি রাজ্য ছিল; যেটির অবস্থান ছিল বর্তমান ভারতের তেলেঙ্গানায়। এক পর্যায়ে গোলকুন্ডা মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে।
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীন মীর জুমলা শাহ সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেন ও বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন। ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা, প্রশাসনিক সংস্কার, রাস্তাঘাট, সেতু ও দুর্গ নির্মাণ ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়ে থাকার পর গত বছর বিবি মরিয়ম কামানটি ওসমানী উদ্যান থেকে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরের কাছে ঐতিহাসিক ঢাকা গেটে স্থাপন করা হয়।কামান দুটি এল কোথা থেকেকালু ঝমঝম ও বিবি মরিয়ম কামান দুটি ঢাকায় কীভাবে এল, তা ইতিহাসের বইয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। কামান দুটি একই জায়গায় তৈরি কি না, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে কামান দুটির মধ্যে একটি সাধারণ মিল হলো সম্ভবত দুটি কামানই মীর জুমলার আসাম-কোচবিহার অভিযানের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যাওয়া কামানটির নাম আওরঙ্গজেবের অস্ত্রের তালিকায় থাকা ঝমঝম নামের একটি কামানের সঙ্গে মিলে যায়। আওরঙ্গজেবের অস্ত্রের তালিকাটি পাওয়া যায় ইতালির ভেনিসে জন্ম নেওয়া পর্যটক নিকোলাও মানুচির বিবরণ থেকে। এই বিবরণ উল্লেখ করেছেন সৈয়দ মো. তাইফুর তাঁর গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে। লেখকের দাবি, বুড়িগঙ্গায় হারিয়ে যাওয়া কামানটি বাদশাহ আলমগীরের (আওরঙ্গজেবের উপাধি) সময়ের অর্থাৎ মোগল আমলের।
গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে বলা হয়েছে, সপ্তদশ শতাব্দী বা এরও আগে থেকে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কামান তৈরির কারখানা ছিল। এ প্রসঙ্গে লেখক ঢাকা জাদুঘরে রক্ষিত ‘দেওয়ানবাগ’ কামান এবং মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ‘জাহানখুশা’ কামানের কথা উল্লেখ করেন।
যতীন্দ্রমোহন রায়ের ঢাকার ইতিহাস বইয়ে বলা আছে, জাহানখুশা কামানটি ১৬৩৭ সালে তৈরি বলা হয়েছে। জনার্দন নামে একজন কারিগর এটি তৈরি করেছিলেন।
গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বই থেকে আরও জানা গেছে, ১৬৬০ সালে মীর জুমলা যখন বাংলার সুবেদার, তখন টমাস প্র্যাট নামের একজন ইংরেজ বাণিজ্য প্রতিনিধি তাঁর অধীন কাজ করতেন। তাঁর কাজ ছিল ঢাকার নদীর তীরে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র তৈরির কাজ তত্ত্বাবধান করা। এ থেকে মোগল আমলে ঢাকায় অস্ত্র তৈরি হতো বলে ধারণা পাওয়া যায়।
সৈয়দ তাইফুরের ওই গ্রন্থে বিবি মরিয়ম কামান সম্পর্কে বলা হয়েছে, কামানটি সুবেদার মীর জুমলার আসাম অভিযানে জব্দ করা। কামানটি সে সময় ঢাকায় আনা হয়।
গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে বলা হয়েছে, সপ্তদশ শতাব্দী বা এরও আগে থেকে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কামান তৈরির কারখানা ছিল। এ প্রসঙ্গে লেখক ঢাকা জাদুঘরে রক্ষিত ‘দেওয়ানবাগ’ কামান এবং মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ‘জাহানখুশা’ কামানের কথা উল্লেখ করেন।জলপথে যুদ্ধকামানভারতীয় ইতিহাস গবেষক জগদীশ নারায়ণ সরকারের লেখা দ্য লাইফ অব মীর জুমলা: দ্য জেনারেল অব আওরঙ্গজেব বই থেকে জানা যায়, আসাম অভিযানের আগে কোচবিহার অভিযান করেন মীর জুমলা। ১৬৬১ সালে কোচবিহার দখলের পর সেখানে থাকা বিভিন্ন যুদ্ধসরঞ্জাম জব্দ করেন তিনি, যার মধ্যে ১০৬টি ভারী কামানও ছিল। সেগুলো পরবর্তী সময়ে ঢাকায় পাঠান তিনি। তবে পরে কামানগুলোর কী হয়েছিল, তা জানা যায়নি
কালু ঝমঝম কামানটি কোচবিহার-আসাম অভিযানে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনাও পাওয়া যায় জগদীশ নারায়ণ সরকারের বই থেকে। সেখানে বলা হয়েছে, কোচবিহার আক্রমণের সময় মীর জুমলা ৩২৩টি যুদ্ধজাহাজ ও বড় নৌকার বহর নিয়ে গিয়েছিলেন। তার সেই বহরে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ‘ঘুরাব’ নামের একপ্রকার ভ্রাম্যমাণ কামানবাহী জাহাজ, যার প্রতিটিতে থাকত ১৪টি করে কামান এবং ৫০ থেকে ৬০ জনের জাহাজ পরিচালনাকারী। এগুলো পরিচালনার ভার ছিল ডাচদের ওপর। প্রতিটি ঘুরাব টেনে নিয়ে যেতে লাগত চারটি করে ‘কুসা’ বা বড় বৈঠাবিশিষ্ট নৌকা। যেহেতু মীর জুমলা কোচবিহার ও আসাম অভিযান প্রায় একই সময়ে করেছিলেন সুতরাং ঝমঝম কামানটি কোচবিহার ও আসাম অভিযানে ব্যবহৃত হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়।
ঘুরাব এবং কুসার আরও উল্লেখ পাওয়া যায় ডাচ নাবিক ফ্রান্স জান্স হেইডেনের লেখা ভ্রমণকাহিনি থেকে। যিনি এক ভয়াবহ নৌকাডুবির শিকার হয়ে মীর জুমলার কোচবিহার অভিযানে জড়িয়ে পড়েন। ডাচ ভাষায় লেখা ওই গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেন ডব্লিউ গ্লানিয়াস নামে এক ইংরেজ লেখক। ‘এ রিলেশন অব অ্যান আনফরচুনেট ভয়েজ টু দ্য কিংডম অব বেঙ্গালা’ নামের ওই গ্রন্থে ঘুরাব নামক কামানবাহী জাহাজে নিজে চড়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন লেখক।
১৬৬১ সালে কোচবিহার দখলের পর সেখানে থাকা বিভিন্ন যুদ্ধসরঞ্জাম জব্দ করেন তিনি, যার মধ্যে ১০৬টি ভারী কামানও ছিল। সেগুলো পরবর্তী সময়ে ঢাকায় পাঠান তিনি। তবে পরে কামানগুলোর কী হয়েছিল, তা জানা যায়নিকালু ঝমঝম কি খুঁজে পাওয়া সম্ভবকালু ঝমঝম বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যাওয়ার পর কেটে গেছে ২৩৮ বছর। এখন সেই কামান খুঁজতে যাওয়া কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে নদী বা সমুদ্রগর্ভ থেকে দীর্ঘ সময় পর এ ধরনের ঐতিহাসিক বস্তু খুঁজে বের করা নতুন নয়। ২০২২ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কলম্বিয়ার উপকূলে ডুবে যাওয়া দুটি সামুদ্রিক জাহাজ খুঁজে বের করা হয়েছে। ডুবে যাওয়া বিখ্যাত জাহাজ সান হোসের ধ্বংসাবশেষের কাছে জাহাজ দুটির সন্ধান পাওয়া যায়। ১৭০৮ সালে স্প্যানিশ জাহাজ সান হোসেকে ডুবিয়ে দেয় ব্রিটিশরা।
ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা, এটা আমাদের অবনতির বিরাট বড় একটি কারণ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদপ্রত্নতাত্ত্বিকেরা বলছেন, এ ধরনের অনুসন্ধানগুলো মেরিটাইম আর্কিওলজির (সমুদ্র প্রত্নতত্ত্বের) আওতাধীন। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কালু ঝমঝমকে খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ১৯ মে প্রথম আলোকে বলেন, এটা তোলা সম্ভব। উন্নত দেশগুলো মেরিটাইম আর্কিওলজি প্রক্রিয়ায় সমুদ্র এবং নদীতলের প্রত্নসম্পদ উত্তোলন করে।
কালু ঝমঝম কামানটি খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা, এটা আমাদের অবনতির বিরাট বড় একটি কারণ।’