পাহাড়ি বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে নিজের ভূপ্রাকৃতিক স্বকীয়তা জানান দেয় কমলগঞ্জ। উপজেলার প্রধান জলাধার ধলাই নদীর দুই পারে কমলগঞ্জের দুটি অংশ। স্থানীয়দের ভাষ্য, এই অঞ্চলের প্রান্তিক জনপদের জীবনসত্তার ধারক লাঘাটা নদী, যা সময়ের সঙ্গে প্রায় অস্তিত্বহীন।
সম্প্রতি খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময়ের প্রাণসঞ্চারিণী এই লাঘাটা এখন একটি মুমূর্ষু মরা গাঙ মাত্র। গত কয়েক বছরের মধ্যে কোটি টাকা ব্যয়ে নদীটির খনন ও সংস্কার কাজ করেও লাভ হয়নি কিছুই। শুষ্ক মৌসুমের জীর্ণ লাঘাটা, বর্ষার পাহাড়ি ঢলের পানিতে হয়ে ওঠে সর্বগ্রাসী। দখল, দূষণ আর অপরিকল্পিত খনন কাজে অনিয়মের কারণে স্বাভাবিক গতিপথ ও প্রবাহ হারিয়ে এমন অবস্থা নদীটির।
স্থানীয়রা জানান, তীরে ভাঙন, বুকে নাব্য সংকটে  জর্জরিত লাঘাটা নদীটি পাহাড়ি ঢল ও বন্যার পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম। ঢলের পানির সঙ্গে আসা পলিতে নদী ভরাট হওয়ায় সেটি সংকুচিত হয়ে খালে পরিণত হয়। এর আগেও একই অবস্থা ছিল নদীটির।
বৃহত্তর সিলেটের এক সময়ের শস্যভান্ডারখ্যাত কমলগঞ্জে  কৃষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ লাঘাটা নদীর খনন কাজ শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাঘাটা নদীর খনন কাজ শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে নদীটির ২৪ কিলোমিটার পর্যন্ত খনন করার কথা ছিল। এতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
২০২২ সালের জুন মাসের বন্যায় কমলগঞ্জের পরিস্থিতি বিবেচনা করলেই বোঝা যায়, মাত্র বছর দেড়েকের কিছু বেশি সময় আগে করা কোটি টাকার খনন কাজে কতটা স্বাভাবিক গভীরতা ও  প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়েছিল নদীটির।
উপজেলার একাধিক স্থান ঘুরে দেখা যায়, লাঘাটার অনেক স্থান শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। গবাদি পশুর খাবার পানিটুকুও পাওয়া যাচ্ছে না। এটি কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর, আলীনগর, শমশেরনগর, পতনঊষার ও রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। এসব এলাকার সুনছড়া, কামারছড়াসহ অসংখ্য পাহাড়ি ছড়া ও খাল এসে পতিত হয়েছে লাঘাটা নদীতে। এই পানির সঙ্গে আসা পলিতে লাঘাটার বুকে নাব্য সংকট তীব্র হয়।
এই নদীকে কেন্দ্র করে প্রান্তিক জনপদের জীবনযাত্রা বিশেষ করে বোরো ও রবিশস্য উৎপাদন টিকে আছে। আদমপুর, আলীনগর, শমশেরনগর, পতনঊষার ও রাজনগর ইউনিয়নের হাজারো কৃষক নদী থেকে সেচ সুবিধা ভোগ করতেন। এখন নদীতে পানি না থাকায় অনেকেই গভীর নলকূপে ঝুঁকে পড়ছেন। ফলে পানির স্তর নিচে নামছে। বিভিন্ন গ্রামে সাধারণ নলকূপেও পানি উঠছে না।
সরেজমিন নদীর কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা যায়, ২০১৯ সালে খনন কাজের ফলে লাঘাটার নিম্নাঞ্চলে কিছুটা পানি পাওয়া যাচ্ছে। শমশেরনগর ইউনিয়নের অর্ধেক অংশ থেকে আলীনগর, আদমপুর ইউনিয়নের অনেক স্থানেই নদী শুকনো। গবাদি পশুর খাবার পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। নদীতে গোসল করা, বসতবাড়ির আসবাব ধৌত করাও ছিল অনেকের সুবিধাস্থল। নদীর তলদেশ ভরাট, সংকোচন, দখল, অবৈধভাবে পলিবালু উত্তোলন, বর্জ্য ফেলা, গাছ, বাঁশ ও ঝোপজঙ্গলে ভরপুর হয়ে ওঠায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে লাঘাটা। 
লাঘাটা পারের বাসিন্দা আক্তার মিয়া, কফিল মিয়া, রাজদেও কৈরী বলেন, এই নদী থেকে আগে অনেক সুবিধা পাওয়া যেত। বর্ষায় পানি কমলে মাছ ধরা, শুষ্ক মৌসুমে সেচ দিয়ে কৃষিক্ষেত করা, প্রবহমান নদীতে গোসল করা– কত কিছুই ছিল। বর্তমানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, শত শত শ্যালো মেশিনে সেচ দিয়ে পানি তুলে নেওয়া, কৃষিজমিতে গভীর নলকূপ, নদী ভরাট, এসব নানা কারণে মানুষ লাঘাটার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছে। নদীকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে। 
পরিবেশবিদ জিডিশস প্রধান সুচিয়ান বলেন, কিছু সংখ্যক মানুষের অপরিকল্পিত কার্যক্রম ও পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমের কারণে নদী, ছড়া, জলাশয় বিপন্ন হচ্ছে। এর বাইরে লাঘাটা নদীও নয়। এটিকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। 
লাঘাটার বর্তমান অবস্থা এবং এর সংকট উত্তরণের ব্যাপারে কথা বলতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া মেলেনি।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: নদ কমলগঞ জ উপজ ল র খনন ক জ নদ ট র র খনন

এছাড়াও পড়ুন:

অক্সিডেন্টাল টাকা নিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ পায়নি স্থানীয়রা

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ২৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ শনিবার। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে মাগুরছড়ার ফুলবাড়ী চা বাগানের সম্মুখভাগে অবস্থিত ১ নম্বর গ্যাস অনুসন্ধান কূপে খননকালে ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল আশপাশের এলাকা। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আগুনের লেলিহান শিখা ৬০০ ফুট উচ্চতায় উঠে যায়। পুড়ে কয়লা হয়ে যায় লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের আশপাশের গাছপালা, মারা যায় বহু পশুপাখি। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় চা বাগান, বিদ্যুৎ লাইন, রেলপথ, গ্যাস পাইপলাইন, গ্যাসকূপ, রিজার্ভ গ্যাস, পরিবেশ প্রতিবেশ ও ভূমিস্থ পানিসম্পদ। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য আজও ভাসে মৌলভীবাজার জেলাবাসীর মনে। অথচ সেই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কূপ খননকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টালের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি সরকার। উল্টো নিজেদের যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার বীমার টাকা তুলে ভেগেছে অক্সিডেন্টাল। 

১৯৯৫ সালে বৃহত্তর সিলেটের ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয় মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল অব বাংলাদেশ লিমিটেডের। অনুসন্ধান শুরুর পর তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ হবে এলাকা– এই ভেবে কমলগঞ্জ তথা মৌলভীবাজারের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়। তেল-গ্যাসের সন্ধানে ৩ হাজার ৭০০ মিটার কূপ খননের লক্ষ্য নিয়ে কাজও শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ৮৪০ মিটার খননের পরই ঘটে দুর্ঘটনা। টানা ১৫ দিন আগুন জ্বলার পর যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির বিশেষজ্ঞ রিচার্ড চাইল্ড রিসহ চার সদস্যের একটি দল আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে পুরো কূপের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস। 
বিভিন্ন সময় তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞরা মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করতে চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে  ভূগর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫ দশমিক ৮৬ বিসিএফ গ্যাস পুড়ে যায়; যার দাম ছিল প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষতি ছিল আরও ১১ হাজার কোটি টাকার। বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করলে মোট ক্ষতির পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অগ্নিকাণ্ডে মাগুরছড়া ও আশপাশের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় দেখা গেছে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণে ২৯টি চা বাগানের ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকার ক্ষতি হয়। লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৬৯ দশমিক ৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ৬৫০টি পূর্ণবয়স্ক গাছ পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতি হয় প্রায় ৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার। ওই ঘটনার সরকারি তদন্তে ক্ষতি বাবদ ধরা হয় ৫০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া বনাঞ্চলের সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে ৪০ হেক্টর ভূমি এবং ১৫ হাজার ৪৫০টি বৃক্ষ। ধারণা করা হয়, আগুনের কারণে ১০ বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৮৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ, বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিস্ফোরণের ফলে ২ হাজার ফুট রেলপথও ধ্বংস হয়। এতে রাজস্ব ছাড়া ক্ষতি হয়েছে ৮১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। সড়কপথের ক্ষতি ২১ কোটি টাকা। গ্যাস পাইপলাইনের ক্ষতি ১৩ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ১৮৬ টাকা। মাগুরছড়া খাসিয়া পানপুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজগুলোতে প্রতিদিন ৪৭ হাজার ৭৫০ টাকা হারে মোট ক্ষতি হয় ১২ লাখ টাকা।

১৯৯৭ সালের ১৪ জুন বিস্ফোরণের পর জ্বলতে থাকা কূপের উৎস মুখ বন্ধ করার কাজ সম্পন্ন হয় পরের বছর ৯ জানুয়ারি। তার আগেই ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া থেকে বিদায় নেয়। এতে দেশজুড়ে দেখা দেয় তীব্র প্রতিক্রিয়া।
মাগুরছড়া তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, মাগুরছড়া অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারি যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তারা এক মাসের মধ্যেই তাদের প্রতিবেদন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন বীমা কোম্পানিতে জমা দিয়ে সেই সময়ই অক্সিডেন্টাল তাদের বীমাকৃত যন্ত্রাংশ, রিগ ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেয়। অথচ যে অক্সিডেন্টালের কারণে এত বড় ক্ষতি হলো, তাদের কাছ থেকে সরকার বা এলাকাবাসী এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বনের ক্ষতি নিরূপণ করা হলেও এ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কখনও পুষিয়ে ওঠার নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
এদিকে মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ কমলগঞ্জে মানববন্ধন করবে পাহাড় রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি, কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও কমলগঞ্জের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবি জানিয়েছে তারা। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৫ আসামিকে বাদ দিতে হলফনামা, বাদী কৃষক দল নেতাকে শোকজ
  • মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৮তম বার্ষিকী পালিত
  • এবারের বাজেট ট্রাম্প ও আইএমএফএ’র দুই পায়ে দাঁড়ানো: আনু মুহাম্মদ
  • ২৮ বছরেও মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ পায়নি বাংলাদেশ
  • অক্সিডেন্টাল টাকা নিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ পায়নি স্থানীয়রা