জীবনের অস্তিত্বের অন্যতম উপাদান পানি। অথচ এই মৌলিক অধিকার থেকে কত মানুষ যে বঞ্চিত, তা শহরের জীবন থেকে অনুভব করা দুঃসাধ্য। এই একই পৃথিবীতে অগণিত মানুষ প্রতিদিন এক ফোঁটা সুপেয় পানির জন্য হাহাকার করছে– লবণাক্ত পানি পান করে আপ্রাণ চেষ্টা করছে বেঁচে থাকার! ঠিক এ রকমই একটি এলাকা সাতক্ষীরা, যেখানকার মানুষের কাছে বিশুদ্ধ পানির সহজলভ্যতা যেন এক অলীক স্বপ্ন। লবণাক্ততা, অনাবৃষ্টি, বন্যা আর জলাবদ্ধতা মিলে এই এলাকার পানি সংকট এতটাই তীব্র যে তা নারী-পুরুষ উভয়েরই স্বাস্থ্যঝুঁকি, শিশুদের অপুষ্টি এবং পানিবাহিত রোগের ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করেছে।


সাতক্ষীরা বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম সংকটাপন্ন একটি জেলা। লবণাক্ততা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলাবদ্ধতা ও বন্যার কারণে এখানে সুপেয় পানির চরম সংকট। ইউএনডিপির এক জরিপ বলছে, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষ দূষিত লবণাক্ত পানি পান করতে বাধ্য হন এবং প্রায় ৬৩ শতাংশ পরিবারের কাছে নেই পানির সহজলভ্যতা। এক সময়ের বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলো এখন দূষিত, লবণাক্ত কিংবা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে গেছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামের অধিবাসীদের পানির জন্য নিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। এখানে অনেক পরিবার এখনও টিকে আছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের চোখে ক্লান্তি আর শরীরজুড়ে পরিশ্রমের ছাপ। তাদের জীবনসংগ্রামের গল্প স্তম্ভিত করে দেবে যে কাউকে। গাবুরার এক মা যেমন বলেছেন, ‘আমরা সারাবছর বৃষ্টির পানি ধরে রাখি, কিন্তু তা কতদিনই বা চলে? তারপর দূরের পুকুর কিংবা মহাজনের কাছ থেকে চড়া দামে পানি কিনে খেতে হয়।’ বৃদ্ধ রহিম গাজী বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা বৃষ্টি হলে আনন্দ পায়, কিন্তু আমরা তখন জানি না, এই পানি কতদিন চলবে। আমাদের জীবন নির্ভর করে স্বল্প সময়ে বৃষ্টির পানির ওপর।’


গৃহবধূ মাসুমা বেগম জানিয়েছেন কীভাবে প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার পথ পেরিয়ে তিনি কলস ভরে আনেন যেন তাঁর পরিবার বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই এই সংগ্রাম। তার তিন বছরের ছেলেটি প্রায়ই পেটে ব্যথা আর চর্মরোগে ভুগে। কারণ? বিশুদ্ধ পানির অভাব।

সুপেয় পানির অভাব শুধু তৃষ্ণাই বাড়ায় না, মানুষের শরীরের ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। সাতক্ষীরার গ্রামে গ্রামে ঘুরে জানা যায়, সুপেয় পানির সংকট শুধু দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলছে না, ধীরে ধীরে মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে বিভিন্ন জটিল রোগের দিকে।


অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করার ফলে এ অঞ্চলে বহু মানুষ নিয়মিত কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু কিডনিই নয়, লবণাক্ত পানির সংস্পর্শে থাকার ফলে এখানকার শিশুদের ত্বকে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। চর্মরোগে আক্রান্ত শিশুগুলোকে দেখলে সত্যিই মায়া হয়। কারও শরীরে ঘা, কারও হাতে-পায়ে ফোসকা, আবার অনেকের ত্বক চিরদিনের জন্য খসখসে হয়ে গেছে। মা-বাবারা অনেক চেষ্টা করেও তাদের সুস্থ রাখতে পারছেন না, কারণ বিশুদ্ধ পানি ছাড়া তো সুস্থভাবে বাঁচা যায় না! 


সবচেয়ে করুণ অবস্থা এখানকার নারীদের। পরিষ্কার পানির তীব্র সংকটে মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নেওয়া তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে নানা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে, যা অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার সৃষ্টি করছে। অনেক নারীই এ সমস্যা নিয়ে মুখ খুলতে স্বস্তি বোধ করেন না, তাই দাঁতে দাঁত চেপে নীরবে কষ্ট সহ্য করেন। কিন্তু এই নীরব কষ্ট যেন ক্রমশ পরিণত হচ্ছে এক ভয়ংকর অভিশাপে। 


এই মানুষগুলোর জীবনের গল্প ও সংগ্রাম বারবার মনে করিয়ে দেয়, সুপেয় পানি কেবল জীবনধারণের জন্য নয়; এটি সুস্থ, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঠিক কতখানি অপরিহার্য। পানের জন্য পানি সংগ্রহ করাও যেন এক দুঃস্বপ্ন, বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য। দূরদূরান্ত থেকে কলস ভর্তি করে পানি বয়ে আনতে গিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় তাদের।                 


সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, যেমন– বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন, ওয়াটারএইড, কারিতাস ও আরও অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এ সংকট মোকাবিলায় কাজ করছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই সমস্যার সমাধান করতে বৃহত্তর পর্যায়ে সহযোগিতামূলক কার্যক্রম ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন সরকার, এনজিও ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে ‘প্রবাহ’ প্রকল্প এক অনন্যদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ প্রকল্পের অধীনে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালীগঞ্জে এখন পর্যন্ত ১০টি পানি পরিশোধন প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এসব কমিউনিটির মানুষদের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে, যা তাদের জীবনকে করছে সহজ।


পানি পরিশোধানাগার প্লান্টটি এই এলাকার মানুষের জীবনযাপনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। তবে এই পরিবর্তন যথেষ্ট নয়। এখনও এখানে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। সাতক্ষীরার অগণিত মানুষ এখনও একটু নিরাপদ পানির জন্য প্রতিদিন দূরবর্তী পানির প্লান্ট থেকে পানি সংগ্রহ করে। মাইলের পর মাইল হেঁটে কিংবা নৌকা চালিয়ে সেই পানি তারা ঘরে নিয়ে আসে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে চলছে এই সংগ্রাম। শিশুদের কষ্ট, মায়েদের দুশ্চিন্তা ও বৃদ্ধদের নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসে ভারী এখানকার বাতাস। এ মানুষগুলোর দুর্ভোগ নিরসনে সরকারের পাশাপাশি আরও প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগ নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে পানিপ্রাপ্তি তাদের মৌলিক অধিকার। 


কোনো একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা সংস্থার পক্ষে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়, বরং সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব গাবুরার মতো অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা, নারী স্বাস্থ্যের সুরক্ষা ব্যবস্থা করা এবং বয়স্কদের মুখে হাসি ফোটানো। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: লবণ ক ত প ন প ন র জন য র জন য প জন য প র দ র জন য র জ বন প ন কর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকা-৮ আসনে নির্বাচন করবেন মির্জা আব্বাস

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৩৭টি সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করেছে বিএনপি।

সোমবার (৩ নভেম্বর) সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই তালিকা প্রকাশ করেন।

আরো পড়ুন:

যে আসন থেকে লড়বেন তারেক রহমান

২৩৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা, ৩টি আসনে লড়বেন খালেদা জিয়া

এর আগে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে দলীয় প্রার্থীদের প্রাথমিক নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়।

এ সময় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভ্যাব্য প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।”

মির্জা ফখরুল বলেন, “দীর্ঘ ১৬ বছর পর আগামী ফেব্রুয়ারিতে আমরা গণতান্ত্রিক নির্বাচন পেতে যাচ্ছি। সেই নির্বাচন প্রায় ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা দেওয়া হচ্ছে। আর যেসব আসনে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করবে, সেটি বিএনপি সমন্বয় করে নেবে।”

বিএনপি মহাসচিব বলেন, “দিনাজপুর-৩ থেকে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বগুড়া-৭ ও ফেনী-১ আসন থেকেও লড়বেন তিনি।”

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিতি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আব্দুল মঈন খান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ