নোনাজলে সাতক্ষীরার মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম
Published: 21st, March 2025 GMT
জীবনের অস্তিত্বের অন্যতম উপাদান পানি। অথচ এই মৌলিক অধিকার থেকে কত মানুষ যে বঞ্চিত, তা শহরের জীবন থেকে অনুভব করা দুঃসাধ্য। এই একই পৃথিবীতে অগণিত মানুষ প্রতিদিন এক ফোঁটা সুপেয় পানির জন্য হাহাকার করছে– লবণাক্ত পানি পান করে আপ্রাণ চেষ্টা করছে বেঁচে থাকার! ঠিক এ রকমই একটি এলাকা সাতক্ষীরা, যেখানকার মানুষের কাছে বিশুদ্ধ পানির সহজলভ্যতা যেন এক অলীক স্বপ্ন। লবণাক্ততা, অনাবৃষ্টি, বন্যা আর জলাবদ্ধতা মিলে এই এলাকার পানি সংকট এতটাই তীব্র যে তা নারী-পুরুষ উভয়েরই স্বাস্থ্যঝুঁকি, শিশুদের অপুষ্টি এবং পানিবাহিত রোগের ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করেছে।
সাতক্ষীরা বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম সংকটাপন্ন একটি জেলা। লবণাক্ততা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলাবদ্ধতা ও বন্যার কারণে এখানে সুপেয় পানির চরম সংকট। ইউএনডিপির এক জরিপ বলছে, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষ দূষিত লবণাক্ত পানি পান করতে বাধ্য হন এবং প্রায় ৬৩ শতাংশ পরিবারের কাছে নেই পানির সহজলভ্যতা। এক সময়ের বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলো এখন দূষিত, লবণাক্ত কিংবা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে গেছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামের অধিবাসীদের পানির জন্য নিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। এখানে অনেক পরিবার এখনও টিকে আছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের চোখে ক্লান্তি আর শরীরজুড়ে পরিশ্রমের ছাপ। তাদের জীবনসংগ্রামের গল্প স্তম্ভিত করে দেবে যে কাউকে। গাবুরার এক মা যেমন বলেছেন, ‘আমরা সারাবছর বৃষ্টির পানি ধরে রাখি, কিন্তু তা কতদিনই বা চলে? তারপর দূরের পুকুর কিংবা মহাজনের কাছ থেকে চড়া দামে পানি কিনে খেতে হয়।’ বৃদ্ধ রহিম গাজী বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা বৃষ্টি হলে আনন্দ পায়, কিন্তু আমরা তখন জানি না, এই পানি কতদিন চলবে। আমাদের জীবন নির্ভর করে স্বল্প সময়ে বৃষ্টির পানির ওপর।’
গৃহবধূ মাসুমা বেগম জানিয়েছেন কীভাবে প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার পথ পেরিয়ে তিনি কলস ভরে আনেন যেন তাঁর পরিবার বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই এই সংগ্রাম। তার তিন বছরের ছেলেটি প্রায়ই পেটে ব্যথা আর চর্মরোগে ভুগে। কারণ? বিশুদ্ধ পানির অভাব।
সুপেয় পানির অভাব শুধু তৃষ্ণাই বাড়ায় না, মানুষের শরীরের ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। সাতক্ষীরার গ্রামে গ্রামে ঘুরে জানা যায়, সুপেয় পানির সংকট শুধু দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলছে না, ধীরে ধীরে মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে বিভিন্ন জটিল রোগের দিকে।
অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করার ফলে এ অঞ্চলে বহু মানুষ নিয়মিত কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু কিডনিই নয়, লবণাক্ত পানির সংস্পর্শে থাকার ফলে এখানকার শিশুদের ত্বকে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। চর্মরোগে আক্রান্ত শিশুগুলোকে দেখলে সত্যিই মায়া হয়। কারও শরীরে ঘা, কারও হাতে-পায়ে ফোসকা, আবার অনেকের ত্বক চিরদিনের জন্য খসখসে হয়ে গেছে। মা-বাবারা অনেক চেষ্টা করেও তাদের সুস্থ রাখতে পারছেন না, কারণ বিশুদ্ধ পানি ছাড়া তো সুস্থভাবে বাঁচা যায় না!
সবচেয়ে করুণ অবস্থা এখানকার নারীদের। পরিষ্কার পানির তীব্র সংকটে মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নেওয়া তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে নানা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে, যা অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার সৃষ্টি করছে। অনেক নারীই এ সমস্যা নিয়ে মুখ খুলতে স্বস্তি বোধ করেন না, তাই দাঁতে দাঁত চেপে নীরবে কষ্ট সহ্য করেন। কিন্তু এই নীরব কষ্ট যেন ক্রমশ পরিণত হচ্ছে এক ভয়ংকর অভিশাপে।
এই মানুষগুলোর জীবনের গল্প ও সংগ্রাম বারবার মনে করিয়ে দেয়, সুপেয় পানি কেবল জীবনধারণের জন্য নয়; এটি সুস্থ, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঠিক কতখানি অপরিহার্য। পানের জন্য পানি সংগ্রহ করাও যেন এক দুঃস্বপ্ন, বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য। দূরদূরান্ত থেকে কলস ভর্তি করে পানি বয়ে আনতে গিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় তাদের।
সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, যেমন– বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন, ওয়াটারএইড, কারিতাস ও আরও অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এ সংকট মোকাবিলায় কাজ করছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই সমস্যার সমাধান করতে বৃহত্তর পর্যায়ে সহযোগিতামূলক কার্যক্রম ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন সরকার, এনজিও ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে ‘প্রবাহ’ প্রকল্প এক অনন্যদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ প্রকল্পের অধীনে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালীগঞ্জে এখন পর্যন্ত ১০টি পানি পরিশোধন প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এসব কমিউনিটির মানুষদের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে, যা তাদের জীবনকে করছে সহজ।
পানি পরিশোধানাগার প্লান্টটি এই এলাকার মানুষের জীবনযাপনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। তবে এই পরিবর্তন যথেষ্ট নয়। এখনও এখানে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। সাতক্ষীরার অগণিত মানুষ এখনও একটু নিরাপদ পানির জন্য প্রতিদিন দূরবর্তী পানির প্লান্ট থেকে পানি সংগ্রহ করে। মাইলের পর মাইল হেঁটে কিংবা নৌকা চালিয়ে সেই পানি তারা ঘরে নিয়ে আসে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে চলছে এই সংগ্রাম। শিশুদের কষ্ট, মায়েদের দুশ্চিন্তা ও বৃদ্ধদের নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসে ভারী এখানকার বাতাস। এ মানুষগুলোর দুর্ভোগ নিরসনে সরকারের পাশাপাশি আরও প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগ নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে পানিপ্রাপ্তি তাদের মৌলিক অধিকার।
কোনো একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা সংস্থার পক্ষে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়, বরং সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব গাবুরার মতো অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা, নারী স্বাস্থ্যের সুরক্ষা ব্যবস্থা করা এবং বয়স্কদের মুখে হাসি ফোটানো।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: লবণ ক ত প ন প ন র জন য র জন য প জন য প র দ র জন য র জ বন প ন কর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ