Samakal:
2025-08-01@20:09:54 GMT

একদিন ডলু ছিল নৌবাণিজ্যের রুট

Published: 22nd, March 2025 GMT

একদিন ডলু ছিল নৌবাণিজ্যের রুট

একসময় দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ। কর্ণফুলী, সাঙ্গু ও ডলু ছিল প্রধান নৌরুট। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে ডলুই ছিল সাতকানিয়া, লোহাগাড়াবাসীর যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সাতকানিয়ার মানুষ ডলু নদী দিয়ে প্রতিদিন নৌকাযোগে চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াত করতেন, পণ্য পরিবহনও করতেন। এ নদীটি আন্তর্জাতিক নৌরুটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে পাকিস্তানের করাচি ও ভারতের কলকাতা থেকে সেলাই করা ও থান কাপড় নৌকাযোগে সাতকানিয়ায় আসত ডলু নদী হয়ে।
সাতকানিয়ার সেই আন্তর্জাতিক নৌরুট ডলু নদী এখন জৌলুস হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। নাব্য হারিয়ে যাওয়ায় নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন নদীতে জমেছে পলিমাটির স্তূপ। সেখানে চলছে ধান ও সবজি চাষ। খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষায় ঝুঁকিতে থাকে পৌর শহর রক্ষাবাঁধ। পাহাড়ি ঢলের পানি উপচে পড়ে আশপাশের গ্রাম প্লাবিত হয়, নষ্ট হয় ক্ষেতের ফসল। 
পার্বত্য জেলা বান্দরবান থেকে প্রবাহিত হয়ে ডলু নদী চট্টগ্রামের লোহাগাড়া হয়ে সাতকানিয়া উপজেলায় প্রবেশ করে সাঙ্গু নদীতে পড়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ৫৩ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ৪৬ মিটার। নদীর প্রকৃতি সর্পাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের ৬ নম্বর নদী।
সাতকানিয়া পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী রহমত আলীপাড়ার বাসিন্দা ৯০ বছর বয়সী আব্দুল মতলব বলেন, ‘ডলু নদী আন্তর্জাতিক নৌরুটের অন্তর্ভুক্ত থাকায় ব্রিটিশ আমল থেকে নদীতে বাঁধ ও বেড়া দেওয়া যাবে না–এমন একটি সরকারি নিয়ম প্রচলিত ছিল। সে সময় পাকিস্তানের করাচি ও ভারতের কলকাতা থেকে ডলু নদী হয়ে ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকাযোগে তৈরি পোশাক ও থান কাপড় সাতকানিয়ায় আনা হতো। পরে কাপড়গুলো বর্তমান লোহাগাড়া উপজেলার পুটিবিলা ইউনিয়নের এম চরহাট (ফকিরহাট) এবং কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো। পুটিবিলায় ছিল পোশাক তৈরির শিল্প। সেখানে এখনও জোলাপাড়া নামে একটি পাড়া আছে।’ 
তিনি আরও বলেন, ‘ডলু নদী খনন করে অতীত ব্যবসার গৌরব ফিরিয়ে আনা যায়। পাশাপাশি মানুষ নিরাপদে ও কম খরচে যাতায়াত করতে পারবেন। বন্যার প্রকোপও কমে যাবে।’
পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভোয়ালিয়াপাড়ার ৮০ বছর বয়সী আব্দুল হাকিম জানান, চট্টগ্রাম নগরীর চাক্তাই থেকে গদি নৌকাযোগে মনিহারি পণ্য ও মুদি দোকানের মালপত্র সাতকানিয়া থানা ঘাট এলাকায় আসত। পরে সড়কপথে তা চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা এবং কক্সবাজারের চকরিয়ার হারবাং ও টেকনাফের হ্নীলায় নিয়ে যাওয়া হতো। স্বাধীনতার আগে পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মুনার বাপের দোকান এলাকায় গদি নৌকাযোগে বড় জট বাঁধানো সুতার লট নিয়ে আসা হতো। এসব সুতা পৌরসভার ঘাটিয়াপাড়া এলাকায় জট খুলে নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কাপড় তৈরির জন্য নিয়ে যাওয়া হতো।
পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের রামপুর বনিকপাড়ার বাসিন্দা জীবন চন্দ্র ধর বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে মিয়ানমার ও ভারত থেকে মালভর্তি জাহাজ ডলু নদী হয়ে পৌরসভার বাদশা মিয়া ও কালু মিয়ার ঘাটে ভিড়ত। বণিকরা সেখান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয় করতেন। আমাদের বনিক পাড়ার লোকজন বিভিন্ন ব্যবসা করতেন। এ ঘাট দুটিতে আমরাও মালামাল আনতাম। পরে সড়কপথ উন্নত হওয়ায় নৌপথে চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।’
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ডলু নদীর দক্ষিণে সাতকানিয়া সদর ও সোনাকানিয়া ইউনিয়নের গারাংগিয়া সেতুর উত্তর পাশে হায়দারের টেক, দানুর মার ঘাট থেকে তিন খালের মুখ, পৌরসভা এলাকার নৌকা ঘাট, রামপুর বায়তুশ শরফের উত্তর পাশে ফয়েজ্জার ঘাটা এবং আমিলাইষ ইউনিয়নের হাঙ্গর মুখ পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় অসংখ্য ছোট-বড় মাটির স্তুপ রয়েছে।এখানে নদীর বুকে স্থানীয়রা সবজি চাষ করেছেন। আবার অনেকেই সবজির জন্য তৈরি করা মাচাংয়ে কাপড় শুকাচ্ছেন। ছমদরপাড়া ও হাঙ্গর মুখ এলাকায় মাটির স্তুপের পাশে আট থেকে ১০ হাত প্রস্থের সরু খাল দিয়ে চলাচল করছে পানি। ভোয়ালিয়াপাড়া এলাকায় দেখা গেছে, পৌর শহর রক্ষা বাঁধটি গত বর্ষায় বন্যার পানির তোড়ে ভেঙে গিয়ে অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের বর্জ্য, পৌরসভার কাঁচা বাজারের পচে যাওয়া মাছ ও সবজির ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয় নদীতে। ফলে নদীতে জোয়ার-ভাটার পানি প্রবাহ অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। 
মাছ বিক্রেতা জেলেপাড়ার বাসিন্দা বিনেন্দ্র জলদাস, সোনারাম জলদাস ও আমিলাইশ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের স্বপন জলদাস জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে ডলু নদীসহ বিভিন্ন জলাশয়ে মাছ ধরে তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন তারা। তবে ডলু এখন আর নদী নেই। ডলু নদীতে পানি না থাকায় মাছও পাওয়া যায় না।’ নৌকার মাঝি পশ্চিম ঢেমশার আবদুল মন্নান মাঝি, রামপুর ওয়ার্ডের রবিশ্বর জলদাস ও সাধন জলদাস বলেন, ‘একসময় ডলু নদীতে পানি থাকায় সারা বছর নৌকা চালিয়ে সংসার চালাতে পারতাম। এখন তারা অন্য কোন পেশায়ও যেতে পারছে না। যারা শারীরিকভাবে কিছুটা সবল তারা অন্য পেশায় চলে গেছেন।’
নদী তীরবর্তী পৌরসভার রামপুর ঘাটিয়াপাড়ার আবদুল শুক্কুর, সামিয়ার পাড়ার আবদুল হাকিম ও ভোয়ালিয়াপাড়ার বাসিন্দা আবদুল গণি জানান, ‘নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় প্রতিবছর বর্ষায় বন্যার পানি ঘরে প্রবেশ করে। পানির স্রোত বেশি থাকলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় ঘর-বাড়ি। তাই বন্যার সময় দুই পাড়ের মানুষ সব সময় আতঙ্কে থাকে, কখন  ঘরটি নদীতে বিলীন হয়ে যায়।’ সাতকানিয়া পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নওয়াব মিয়া ও নেচার আহমদ চৌধুরী জানান, নদী ভাঙন থেকে পৌরবাসীকে বাঁচাতে নদী খননে পানি উন্নয়ন বোর্ডে আবেদন করেছেন। তবে কোন কাজ হয়নি।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শেখ মো.

মহিউদ্দিন বলেন, ‘বন্যায় ডলু নদীর পানিতে প্রতিবছর পৌরসভা ও উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের হাজার হাজার বসতঘর প্লাবিত হয়, নষ্ট হয়ে যায় হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল। ভেসে যায় কোটি কোটি টাকার মাছ।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পটিয়া) উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আনিস হায়দার খান বলেন, ‘ডলু নদী ড্রেজিংয়ের বিষয়ে বৃহৎ পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। এর অংশ হিসেবে এবারের ডিসি সম্মেলনে ডলু নদী খননের প্রস্তাব হিসেবে পাঠানো হয়েছে।’
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও পৌরসভার প্রশাসক মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘ডলু নদীর খননের বিষয়ে জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়েছে। এবারের ডিসি সম্মেলনেও জেলা প্রশাসক ডলু নদী খননের বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী অবগত রয়েছেন। আশা করি প্রকল্পটি পাস হলে ডলু নদীর পানি প্রবাহ আগের মত ফিরে আসবে।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: নদ প রসভ র এল ক য় বন য র করত ন আবদ ল উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

শুল্ক কমেছে, বাংলাদেশে স্বস্তি

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশের ওপর দেশটির আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসের এক ঘোষণায় এ কথা বলা হয়। বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কহার কমে প্রতিযোগীদের কাছাকাছি অবস্থানে আসার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক।

২৯ জুলাই থেকে তিন দিনের আলোচনা ও দর-কষাকষির শেষ দিন ৩১ জুলাই এ ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭০টি দেশের ওপর ১০ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসে।

পাল্টা শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ নামিয়ে আনতে বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকেও বেশ কিছু সুবিধা দিতে হয়েছে। একদিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পান গত ২১ জানুয়ারি। এর দুই মাস পর গত ২ এপ্রিল হঠাৎ বিশ্বের ৭০ দেশের জন্য বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। অনেকেই ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে একধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলে সমালোচনা করেছেন।

প্রথমে গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা হয় ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক। মাঝখানে তিন মাস স্থগিত রাখার পর ৮ জুলাই তা কমিয়ে ট্রাম্প ৩৫ শতাংশ করেন। বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ করায় মোট শুল্কহার দাঁড়াবে এখন ৩৫ শতাংশে।

দর-কষাকষির মাধ্যমে ঘোষিত শুল্কহার কমিয়ে আনাকে ঐতিহাসিক চুক্তি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের আলোচকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য।’

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে আলোচনা করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন আলোচকদের মধ্যে আরও ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে বলেছে, অনেক বিষয় জড়িত থাকায় শুল্ক আলোচনার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয়টি শুধু শুল্ক কমানোর সঙ্গেই যুক্ত ছিল না; বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্যঘাটতি ও নিরাপত্তা–সংক্রান্ত মার্কিন উদ্বেগও ছিল এর সঙ্গে। সমাধানের বিষয়টি নির্ভর করছিল একটি দেশের সদিচ্ছার ওপরও।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা গতকাল প্রথম আলোকে জানান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকব এবং যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আমরা ২০ শতাংশের নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম।’

প্রতিযোগী দেশগুলোর শুল্কহার

যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।

বাংলাদেশের সমান ২০ শতাংশ ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কা এবং ১৯ শতাংশ হার নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কম রয়েছে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের হারও ১৯ শতাংশ। তাইওয়ানের ওপর ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ; জাপান, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৪১ শতাংশ শুল্কহার সিরিয়ার ওপর। বেশি হার আরোপ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে লাওস ও মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ; সুইজারল্যান্ডের ওপর ৩৯ শতাংশ; ইরাক ও সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ এবং লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিচ্ছে বাংলাদেশ

সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেশন পুরোপুরি মেনে চলারও অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে দেশটি থেকে দাম বেশি দিয়ে হলেও বছরে সাত লাখ টন করে গম কেনা হবে পাঁচ বছর ধরে। ইতিমধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি।

দেশটি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আগে থেকেই আমদানি করা হচ্ছে। তা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৯ থেকে ১১ জুলাই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সফল না হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে, সেসব পণ্যের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ১৭ থেকে ২৩ জুলাই সপ্তাহব্যাপী অনলাইনে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়েই তিনি বৈঠকগুলো করেন।

গত ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (প্রকাশ না করার চুক্তি) করার কারণে সরকারি প্রতিনিধিদলে অন্য কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ভেতরে-ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।

সরকারের আহ্বানে সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে। এসব সভায় তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেন তাঁরা। বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

ব্যবসায়ীদের সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ১৩ কোটি ডলারে ৩ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।

ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রায় ১০ কোটি ডলারের সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।

এ ছাড়া ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ১৯ হাজার টন তুলা আমদানির সমঝোতার চুক্তি করেছে বস্ত্র খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কার্গিল ইনকরপোরেটের কাছ থেকে এশিয়া কম্পোজিট ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে ৬ হাজার টন আমদানির এমওইউ করেছে। একই দরে একই পরিমাণ তুলা আমদানির এমওইউ করেছে সালমা গ্রুপও। এ ছাড়া মোশাররফ গ্রুপ মার্কিন লুইস ড্রেফাস গ্রুপ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ৭ হাজার টন তুলা আমদানির এমওইউ করেছে।

কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ২০ শতাংশ শুল্কহার ঠিক করতে পেরেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, এটাই হচ্ছে প্রধান কারণ।’

ট্রেড ইউনিয়ন, মজুরি, শ্রমিক নিপীড়ন, মামলা—এসব বিষয় আলোচনায় উঠেছিল কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে। শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখতে জোর দিয়েছে তারা। আমরা আইএলও কনভেনশন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ জন্য শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চলছে।’

‘অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা’

ওয়াশিংটনে দর-কষাকষিতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টা শুল্ক কমার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, তাতে বাংলাদেশ বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে রেহাই পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘সময়সীমার মধ্যেই জটিল আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। নইলে ৩৫ শতাংশের গুরুভার বহন করে যেতে হতো।’

খলিলুর রহমান আরও বলেন, প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান অথবা যত্সামান্য বেশি এবং ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য এখন প্রতিযোগিতামূলক থাকবে। তৈরি পোশাকশিল্প ও এর ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টার উদ্দেশে ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় তিনি (শেখ বশিরউদ্দীন) সমালোচকদের হতাশ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আল্লাহ তাঁকে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, যাতে তিনি দেশকে সেবা দিতে পারেন, হোক তা সরকারে বা বেসরকারি খাতে।’

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। তবে আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই, বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্যকৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।

অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির প্রথম আলোকে বলেন, একটি বিশ্বশক্তির চাপের মুখে এই সাফল্য অর্জনের জন্য সরকার ও আলোচক দলের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন। এটি সম্ভবত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে কঠিন লড়াইগুলোর একটি ছিল, যা পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন তাঁরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ