রাজনৈতিক দলের আর্থিক স্বচ্ছতা বাড়াতেই হবে
Published: 22nd, March 2025 GMT
রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন চাচ্ছে। দেশের মানুষ বিগত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। কারণ দেশে অঘোষিত একদলীয় ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট সেই শাসনের অবসান হয়েছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবেশের দিকে অগ্রসর হবে। সেটি হতে হলে নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দলকেও গণতান্ত্রিক হতে হবে।
এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, দলের ভেতরে নেতা নয়, সদস্যরা সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে থাকবেন। যখন সদস্যরা দলের নীতি, কর্মসূচি ও পরিকল্পনায় মতামত দিতে পারবেন, অংশগ্রহণ করতে পারবেন, তখন তারা দলের সঙ্গে নিজেদের বেশি সম্পৃক্ত ভাবতে পারবেন। এমনকি তখন নিজেরা দলকে চাঁদা দিতে উৎসাহিত হবেন এবং এলাকার জনগণের কাছ থেকে দলের জন্য চাঁদা ওঠাতেও সক্ষম হবেন। কিন্তু সেটি চাঁদাবাজি হবে না, যা এখন বিরাজমান।
অন্তর্বর্তী সরকার যখন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে তখন রাজনৈতিক দলেরও দায়িত্ব রয়েছে। তারা ভোটারদের সামনে তুলে ধরুক, কীভাবে নিজ দলে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করছে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি পরিপূর্ণভাবে লক্ষ্য করা যায় না।
যেমন– সম্প্রতি গঠিত এনসিপি কীভাবে তাদের জমকালো আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান করল কিংবা কোথা থেকে ফাইভ স্টার হোটেলে ইফতার পার্টির টাকা আসছে, সেগুলো নিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে পারছে না। শোনা যায়, ইফতার পার্টিতে আসনের বিনিময়ে অনুদান সংগ্রহ করা হয়েছে। এমনটা হয়ে থাকলে তা প্রকাশ করতে আপত্তি কোথায়? কারণ ‘ফান্ড রেইজিং ডিনার’ আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত।
সবাই মানবেন, রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড ‘হাওয়ার ওপর’ চলবে না; অর্থ দরকার রয়েছে। সেই অর্থ অন্যের কাছ থেকেই জোগাড় হয়ে থাকে। তাহলে অর্থ কীভাবে জোগাড় হলো, সেটি বলতে আপত্তি কোথায়? পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো বাসস্ট্যান্ড, টেম্পোস্ট্যান্ড, হাটবাজার থেকে চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করে। এটি সমর্থনযোগ্য নয়, আবার রাজনৈতিক দলগুলোর টাকাও লাগবে। তাহলে এর সমাধান কী?
একটা সহজ সমাধান হলো, দলের সদস্যদের চাঁদা ও সমর্থকদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ। বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের ৪০ শতাংশ ভোট আছে। তার মানে ৪ কোটি ভোটার। তারা দলের সদস্য হিসেবে নিবন্ধিত হলে এবং নিবন্ধন ফি ১ হাজার টাকা হলে দলের প্রাথমিক তহবিল হতে পারে ৪ হাজার কোটি টাকা। এরপর যদি সদস্যরা মাসে ১০০ টাকা করে চাঁদা দেয় তাহলে প্রতি মাসে ৪০০ কোটি টাকা চাঁদা সংগ্রহ হবে। এরপর অনুদান তো রয়েছেই। পার্টি ফান্ডে সংগৃহীত টাকা ফিক্সড ডিপোজিট বা বিনিয়োগ করা যেতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলো যখন আর্থিকভাবে স্বাধীন হবে তখন তাদের সক্ষমতা বাড়বে। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়বে। জনগণের মতামত প্রকাশেরও সুযোগ তৈরি হবে। তারা পুরো বছর বিভিন্নভাবে তাদের মতামত দেবে। এর মধ্য দিয়ে দলের সাধারণ সদস্য থেকে সব পর্যায়ের সদস্য নেতাকর্মী এবং জনগণ রাজনৈতিক দলটিকে নিজেদের বলে ভাবতে শুরু করবে।
প্রশ্ন হলো, চাঁদা আদায়ের স্বচ্ছতা কীভাবে প্রতিষ্ঠা হবে? এ জন্য ঘন ঘন দলের সভা-সমাবেশ করা যেতে পারে। গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত সমাবেশগুলোতে যারা দলকে নিয়মিত চাঁদা দেয়, তারা উপস্থিত হবে এবং তাদের সঙ্গে দলের নেতাকর্মীর যোগাযোগ তৈরি হবে। এর মধ্য দিয়ে দলের সদস্য ও কর্মী এবং নেতারা জনগণের মনোভাব বুঝতে পারবে।
এখন বাংলাদেশ একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনার প্রারম্ভিক পৃষ্ঠাতে রয়েছে। এই অবস্থায় আমাদের যতটা সম্ভব জনগণকে সম্পৃক্ত করে রাজনীতি গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভেতরে বোধ তৈরি হতে হবে যে এতদিন যা হয়েছে, তা ঠিক ছিল না বলেই শেখ হাসিনা গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন। তাঁকে ক্ষমতা থেকে নামাতে হাজার হাজার মানুষের রক্ত ঝরেছে।
রাজনৈতিক দলগুলো ঘিরে যে অস্বচ্ছতা দীর্ঘকাল ধরে গড়ে উঠেছে, সেটি ভেঙে ফেলার এখনই উপযুক্ত সময়। এখন রাজনৈতিক দলের নেতারা কতটা দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে জনগণের সঙ্গে নিজেদের কানেক্ট করতে পারবেন, সেটা তারাই ভালো বুঝতে পারবেন। তবে এর কোনো বিকল্প নেই। তারা যদি সুযোগ না নেন তাহলে যে দূরত্ব ছিল, সেই দূরত্ব আরও বাড়বে। জনগণ বোকা নয়।
জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো বোঝে। কিন্তু জনগণ চায় রাজনৈতিক দলের নেতারা জনগণের সামনে এসে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করুক এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করুক। এবার যদি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দলের গণতান্ত্রিক অবস্থান, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রমাণের সুযোগ নিতে না পারে তাহলে আর কখনোই তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
লুকোচুরি অপরাধের বিস্তার ঘটায়। দলকে অগণতান্ত্রিক, অস্বচ্ছ ও জবাবদিহিহীনের দিকে নিয়ে যায়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং কেন্দ্রীয় নেতারা বিশেষ করে ক্ষমতায় থাকা দলের বিভিন্ন পদের নেতা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন তথা নির্বাহী বিভাগকে নিজেদের মতো করে ব্যবহারের সুযোগ পান। এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হন এবং জনগণকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।
কোনো রাজনৈতিক দলের ভেতরে কোনো নেতার আনুকূল্য বা প্রশ্রয় তৈরি হওয়া কীভাবে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে তা আমরা অতীতে বহুবার বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে দেখেছি। সর্বশেষ শেখ হাসিনা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং কর্তৃত্ববাদী শাসকে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। পরিণতিতে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছে।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হবে এ দেশে ‘আরেকটি হাসিনা’ যাতে তৈরি না হতে পারে তা নিশ্চিত করা।
মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ন র জন ত ক দল র ন ত র সদস য জনগণ র প রব ন দল র স ক ষমত অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
শেষ পর্যন্ত খনিজ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন
কয়েক মাস আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে একরকম অপমান করেই হোয়াইট হাউস থেকে বের করে দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওই বৈঠকে তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে খনিজ চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। তবে উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে সেটি হয়নি। বুধবার শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন।
চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, রাশিয়ার সাথে শান্তি চুক্তি করার পর ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা এবং পুনর্গঠনে মার্কিন বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার জন্য এটি একটি অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্রদান করবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এই চুক্তি রাশিয়ার কাছে স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘমেয়াদে একটি মুক্ত, সার্বভৌম এবং সমৃদ্ধ ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে শান্তি প্রক্রিয়ার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
তিনি বলেছেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনের স্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতি উভয় পক্ষের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শনের জন্য আমেরিকান জনগণ এবং ইউক্রেনীয় জনগণের মধ্যে এই অংশীদারিত্বের কল্পনা করেছিলেন। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রকে অর্থায়ন বা সরবরাহকারী কোনো রাষ্ট্র বা ব্যক্তিকে ইউক্রেনের পুনর্গঠন থেকে উপকৃত হতে দেওয়া হবে না।”
ইউক্রেনের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী, ইউলিয়া সভিরিডেনকো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে নিশ্চিত করেছেন যে তিনি বুধবার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন।
তিনি বলেছেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একসাথে, আমরা এমন একটি তহবিল তৈরি করছি যা আমাদের দেশে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে।”
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা চুক্তির বিশদ বিবরণ প্রকাশ করেছেন। তারা চুক্তিটিকে ন্যায়সঙ্গত এবং ইউক্রেনকে তার প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার অনুমতি প্রদানকারী হিসাবে চিত্রিত করেছেন।
ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্যামিহাল জানিয়েছেন, তহবিলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের মধ্যে ৫০-৫০ ভাগে ভাগ করা হবে এবং প্রতিটি পক্ষকে সমান ভোটাধিকার দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ইউক্রেন “তার খনিজ সম্পদ, অবকাঠামো এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে” এবং শুধুমাত্র নতুন বিনিয়োগের সাথে সম্পর্কিত হবে, যার অর্থ এই চুক্তিতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কোনো ঋণের বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
বুধবার শ্যামিহাল এই চুক্তিকে “ইউক্রেনের উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধারে যৌথ বিনিয়োগের বিষয়ে সত্যিই একটি ভালো, সমান এবং উপকারী আন্তর্জাতিক চুক্তি” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
চুক্তির সমালোচকরা বলেছিলেন যে হোয়াইট হাউস যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির ভবিষ্যৎকে তার সম্পদ থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের সাথে যুক্ত করে ইউক্রেনের সুবিধা নিতে চাইছে। ফেব্রুয়ারিতে বেসেন্টের প্রস্তাবিত শর্তাবলীর তুলনায় চূড়ান্ত শর্তাবলী ইউক্রেনের জন্য অনেক কম কঠিন ছিল। সেখানে একটি ধারা অন্তর্ভুক্ত ছিল যে তহবিল থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের ১০০% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে।
ঢাকা/শাহেদ