কুড়িগ্রামের থেতরাই ইউনিয়নের খারিজা নাটশালা চরের বাসিন্দা তৈয়মুর শেখ (৮০)। এ বয়সে অন্তত ১১ বার তিস্তা নদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে তাঁর বাড়ি। তিনি বলছিলেন, ‘জীবনের ব্যাকটি (সময়) গ্যালো নদীর লগে যুদ্ধ করতে। অহনও চলছে যুদ্ধ। নদী বান্দি দিলে বাকি জীবনটা কষ্ট থাকি বাঁচনো হয়।’ এক সময়ের খরস্রোতা তিস্তা তৈয়মুরের মতো হাজারো মানুষের বসতবাড়ি গ্রাস করেছে।
তিস্তা আগে ১২ মাসই পানিতে থইথই করত। আশপাশের মানুষের জীবন-জীবিকা ও ব্যবসা-বাণিজ্য চলত এ নদী ঘিরে। সেই নদীতে এখন বছরের ছয় মাস পানি থাকে না। কিছু স্থান পরিণত হয় মরা খালে। বাকি অংশ ধুধু বালুচর। বর্ষা এলেই সর্বনাশা রূপ নেয় এ নদী। তখন ভাঙনে পারের হাজার হাজার বাড়িঘর, আবাদি জমি ও গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যায়। নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো মানুষ। এ অবস্থা থেকে মুক্তি ও স্বস্তি চান তারা।
তিস্তা সড়ক সেতু নির্মাণের পর ভয়াবহ ভাঙনে লাখ লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড.
তিস্তার এমন ভাঙা-গড়ায় বসতি স্থানান্তরে বাধ্য হয়েছে তিস্তাপারের হাজার হাজার পরিবার। হারিয়ে গেছে অনেক গ্রাম। বদলে গেছে এলাকার মানচিত্র। তবুও সরকার স্থায়ীভাবে নদী শাসনের উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ভাঙন দেখা দিলে আপৎকালীন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা কোনো কাজে আসে না। ফলে গত দুই যুগে উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অনেক এলাকা নদীতে চলে গেছে।
এ সময় গৃহহারা হয়েছে অন্তত আট হাজার পরিবার। অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে তিস্তাপারের মানুষের। রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাসহ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে লাখ কোটি টাকার। এখন দিশেহারা তিস্তাপারের মানুষ তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় জেগেছে। তাদের একটাই দাবি, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। সে লক্ষ্যে গত ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি তিস্তাপারে দুই দিনব্যাপী লাখো মানুষের সমাবেশ হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, এক সময়ের খরস্রোতা তিস্তা নদীতে পানি নেই। জেগে উঠেছে শত শত বালুচর। নৌকাও চলে না। মানুষ হেঁটে নদী পার হচ্ছে। তিস্তা পানিয়ালের ঘাটের ইজারাদার জাহাঙ্গীর আলমের ভাষ্য, নদীতে পানি না থাকায় নৌকা চলে না ছয় মাস ধরে। তাই বসে বসে লোকসান গুনতে হচ্ছে।
স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, গত ২৪ বছরে উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ১৯টি ওয়ার্ড, ২৮টি গ্রাম, ২৩ কিলোমিটার এলাকা, ৬৭ হাজার একর জমি, সাড়ে আট হাজার পরিবার, ২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছয়টি হাটবাজার ও ২২ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নদীতে বিলীন হয়েছে। এর মধ্যে বজরা ইউনিয়নের ছয়টি ওয়ার্ড, আটটি গ্রাম, তিন হাজার পরিবার, ৫০ হাজার একর জমি, ৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, একটি ক্লিনিক, দুটি স্লুইসগেট ও ১০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নদীতে চলে গেছে।
দলদলিয়া ইউনিয়নের আটটি ওয়ার্ড, ১০টি গ্রাম, ১ হাজার ৩০০ পরিবার, ১০ হাজার একর জমি, সাত কিলোমিটার এলাকা ও আট কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নাই হয়ে গেছে। থেতরাই ইউনিয়নে বিলীন হয়েছে সাতটি ওয়ার্ড, ১০টি গ্রাম, তিন হাজার পরিবার, চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এক হাজার একর কৃষিজমি, স্লুইসগেট একটি, ইউনিয়ন পরিষদ, পোস্ট অফিস, দুটি হাটবাজার ও পাঁচ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। গুনাই গাছ ইউনিয়নের দুটি ওয়ার্ড, পাঁচটি গ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চারটি, একটি বাজার ও দুই কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বিলীন হয়েছে।
স্থানীয় থেতরাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আতাউর রহমানের ভাষ্য, তাঁর ইউনিয়নের চার ভাগের তিন ভাগ নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন নদীতে পানি নেই। বর্ষা এলেই ভয়াবহ রূপ নেয়। দেখা দেয় বন্যা ও ভাঙন। তখন শুরু হয় মানুষের জীবন ও ঘরবাড়ি রক্ষার লড়াই। গৃহহারা মানুষের আর্তনাদ ও আহাজারিতে দিশেহারা নদীতীরের মানুষ। গৃহহারা ও ভূমিহীন তিন হাজার পরিবার অভাব-অনটনে দিশেহারা। এখানে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বর্ণনাতীত।
প্রতিবছর নদীভাঙনে কৃষিজমি বিলীন হয় জানিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোশারফ হোসেন বলেন, জমিতে পলি পড়ে আবাদি হয়। চরের জমির পরিমাণ প্রায় ৬০০ হেক্টর। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. ফিজানুর রহমানের ভাষ্য, এ পর্যন্ত তিস্তার ভাঙনে ৮-৯ হাজার পরিবার গৃহহারা হয়েছে। এসব পরিবারের জন্য আপৎকালীন সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনে কোনো কর্মসূচি নেওয়া হয়নি।
বজরা, গুনাইগাছ, থেতরাই ও দলদলিয়া ইউনিয়নে নদীভাঙনে লাখ লাখ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে বলে জানান কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান। তিনি বলেন, এ চার ইউনিয়নে ভাঙনকবলিত আটটি এলাকায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীতীর সংরক্ষণ কাজের টেন্ডার হয়েছে। শিগগিরই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিষয়টি সরকারের। তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: নদ ক ল ম ট র বন য হ জ র পর ব র ব ল ন হয় ছ হ জ র একর সরক র উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
খুলনায় ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ২ জনকে কুপিয়ে হত্যা
খুলনায় মাত্র আট ঘণ্টার ব্যবধানে দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
শুক্রবার (১ আগস্ট) রাতে খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকায় মনোয়ার হোসেন টগর নামে এক যুবক এবং শনিবার (২ আগস্ট) ভোরে দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুরে আল-আমিন সিকদার নামে এক ভ্যানচালক খুন হন।
দিঘলিয়ায় ভ্যানচালককে কুপিয়ে হত্যা
পুলিশ জানায়, শনিবার ভোর আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর নন্দনপ্রতাপ গ্রামে আল-আমিন সিকদার (৩৩) নামে এক ভ্যানচালককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত আল-আমিন ওই গ্রামের কাওসার শিকদারের ছেলে।
দিঘলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এইচ এম শাহীন বলেন, “আল-আমিনের স্ত্রীর সাবেক স্বামী মো. আসাদুল ঝিনাইদহ থেকে এসে অতর্কিতে তার ওপর হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যার পর আসাদুল পালিয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তার সাবেক স্ত্রীকে বিয়ে করার কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।”
ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
নগরীতে ছুরিকাঘাতে যুবক খুন
অপরদিকে, শুক্রবার রাত সোয়া ৯টার দিকে খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন সবুজবাগ এলাকায় নিজ বাড়িতে ছুরিকাঘাতে খুন হন মনোয়ার হোসেন টগর (২৫) নামে এক যুবক। তিনি ওই এলাকার বাসিন্দা জামাল হাওলাদারের ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, রাত সোয়া ৯টার দিকে কয়েকজন যুবক টগরের বাড়িতে প্রবেশ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা তাকে ছুরিকাঘাত করে। তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
সোনাডাঙ্গা মডেল থানার এসআই আবদুল হাই বলেন, “প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, হত্যাকারীরা টগরের পূর্ব পরিচিত। তাদের সবাইকে শনাক্ত করা হয়েছে এবং গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।”
ঢাকা/নুরুজ্জামান/ইভা