গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়েছিল পুলিশি ব্যবস্থা। নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে পড়তে হয় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে। এখনও পুরো স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ। আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে বাহিনীটিকে। এমন পরিস্থিতিতেও বন্ধ আছে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম। ওপেন হাউস ডে ও উঠান বৈঠকের মতো কার্যক্রম সেভাবে দৃশ্যমান নয়। ফলে পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বেড়েছে। জনগণ-পুলিশ ইতিবাচক সম্পৃক্ততার কর্মকাণ্ডে ভাটা দেখা দিয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জনগণের সঙ্গে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের সম্পর্ক আরও সহযোগিতামূলক ও বন্ধুত্বপূর্ণ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশিষ্টজন। তারা বিস্তৃত পরিসরে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি চালু করার কথা বলছেন। জনতার সঙ্গে পুলিশের ভঙ্গুর সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে এসব কার্যক্রম ভালো ফল আনতে পারে বলে মনে করছেন তারা। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও জনমুখী ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আইনি কাঠামোর কথাও বলা হয়েছে।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণেই হয়তো কমিউনিটি পুলিশিং কমিটিগুলো স্তিমিত হয়ে আছে। এগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এখন রাজনৈতিক নেতারা আগের মতো তৎপর নেই; ওয়ার্ড পর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধি নেই। তাই সামাজিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সমাজে যাদের মতামতের গুরুত্ব আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। এটি শুধু এখনকার জন্য নয়, সব সময়ের জন্যই দরকার। আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করার জন্য এটি জরুরি।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড.

তৌহিদুল হক বলেন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে পুলিশের সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং ও ওপেন হাউস ডে চালু করা হয়। পুলিশ এখন নৈতিক ও মনোবল সংকটের মধ্যে আছে, আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বিভিন্ন বাধা ও প্রশ্নের মুখে পড়ছে, শারীরিক ও মানসিক আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পুলিশের কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রম যত বাড়ানো যাবে, মানুষের সঙ্গে সংযোগ বা সম্পর্কের জায়গাটা তত বেশি আস্থা-বিশ্বাসের হবে। এলাকাভিত্তিক অপরাধীরা কোণঠাসা থাকবে। পুলিশ সম্পর্কে মানুষের যে ভুল ধারণা, তা দূর হবে।

পুলিশ সদরদপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর সমকালকে বলেন, কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের আগের যে কমিটিগুলো ছিল, সেগুলো এখন নেই। তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান। পুলিশ সদস্যরা ওপেন হাউস ডে, উঠান বৈঠক, গাড়িচালক ও হেলপারদের নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। ভবিষ্যতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আরও সংগঠিতভাবে পুলিশিংয়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমলসহ আবাসিক এলাকার নিরাপত্তায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে বেসরকারি কর্মীদের ‘অক্সিলারি ফোর্স’ হিসেবে নিয়োগের কথা জানায় ডিএমপি। তবে এই সিদ্ধান্ত খুব বেশি সাড়া ফেলেনি। আবার কিছুদিন ধরে সিটিজেন ফোরামের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত তৈরির চেষ্টা করছে পুলিশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের সমাজভিত্তিক কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক ভালো হলে কোনো বেআইনি কর্মকাণ্ডে জনগণই বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

জনমুখী ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবেও বেশ কিছু বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। এতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ধরন ও বিস্তৃতি কেমন হতে পারে, সে ব্যাপারে আছে কিছু পরামর্শ। বলা হয়েছে, জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করতে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের পরিসর বাড়ানো প্রয়োজন। একে কার্যকর করে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ ব্যবস্থা করে জবাবদিহি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা সারিয়ে তুলতে কমিউনিটি পুলিশিং টেকসই ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। সমাজের সৎ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

বিগত সরকারের দমনপীড়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠায় তাদের প্রতি ক্ষোভ রয়েছে মানুষের। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কমিউনিটিভিত্তিক বা জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্টজন। বর্তমানে সীমিত মাত্রায় ওপেন হাউস ডে ও উঠান বৈঠকের মতো কর্মসূচি চলমান থাকার কথা বলা হলেও সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকা মহানগরেই এসব কর্মকাণ্ড তেমন দৃশ্যমান নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মতো কর্মসূচি আবার চালু করলে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সেতুবন্ধন দৃঢ় হবে। এলাকাভিত্তিক অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া সহজ হবে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আরও স্বচ্ছন্দ হতে পারবে পুলিশ। তবে এটি করতে গিয়ে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কারও ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে। কাউকে অভিযুক্ত করার ভয় দেখিয়ে সুবিধা আদায় বা কোনো কিছু করতে বাধ্য করার ঘটনা অতীতে ঘটেছে। এ কারণে এই ব্যবস্থাকে যথাযথ নজরদারির আওতায় রাখতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষমতার পালাবদলের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতেই পুলিশের হিমশিম অবস্থা। তাই কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি পুনর্গঠন বা সক্রিয় করার দিকে মনোযোগ দেওয়া যায়নি। আগের কমিটিগুলো এখন কার্যকর নেই। নতুন করে কমিটি গঠনের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি। শোনা যাচ্ছে, আগের মতো না হয়ে কিছুটা নতুন আঙ্গিকে কমিটি হতে পারে। এখন সারাদেশে নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে পুলিশের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। আগামী পুলিশ সপ্তাহে নাগরিকদের নিয়ে একটি আয়োজন রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

জনসম্পৃক্ত পুলিশ গড়তে ১৯৯৩ সালে ময়মনসিংহে এবং পরের বছর ঢাকার দুটি থানায় কমিউনিটি পুলিশিং চালু হয়। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে এই কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে বিভিন্ন এলাকাকে ‘বিট’ হিসেবে ভাগ করে চালু হয় বিট পুলিশিং। প্রতিটি বিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেন। জনসচেতনতা বাড়াতে উঠান বৈঠকের মতো কর্মসূচি নিতেন। তাদের তদারক করতেন থানার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।

কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির বড় কর্মপরিধি ছিল ঢাকা মহানগরে। ৫০টি থানার পুলিশকে সহায়তা করতেন কমিউনিটি পুলিশিং সদস্যরা। এখন তাদের কার্যক্রম নেই। তবে ঢাকাসহ সারাদেশেই নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সমকালকে বলেন, ঢাকায় আমরা সিটিজেন ফোরাম বা নাগরিক কমিটি গঠন করেছি। তারা আমাদের নানা পরামর্শ ও তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তারা কমিটিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া সহায়ক পুলিশরাও অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখবেন।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, কমিউনিটি পুলিশিংকে আগে কেবল অপরাধ দমনের কৌশল হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখা হতো। তবে সুনির্দিষ্টভাবে ছাত্রদের সমন্বয়ে এ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অনেক দেশে ছাত্রদের মাধ্যমে কমিউনিটি পুলিশিং পদ্ধতি চালু আছে। এ ছাড়া দেশে বিভিন্ন অফিস ও বাড়িতে বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী আছেন। তাদের পদ্ধতিগত কাঠামোর মাধ্যমে জনসম্পৃক্ত কাজে যুক্ত করলে নিরাপত্তা সুসংহত হবে। দেশে গ্রাম আদালত ও চৌকিদারি ব্যবস্থা বিদ্যমান। স্থানীয় ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে অপরাধ দমন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থার জন্য বাজেট বরাদ্দেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বর্তমানে পুলিশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন নতুন মুখ। অনেক এলাকায় অপরাধের তথ্য পুলিশ সময়মতো পায় না। কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থা কার্যকর হলে দ্রুত নাগরিকদের কাছ থেকে অপরাধের তথ্য পাওয়া যাবে। আবার অনেক জায়গায় অপরাধীকে ধরতে গিয়ে ‘মব ভায়োলেন্সের’ মুখোমুখি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা আরও জোরদার হলে বেআইনি কর্মকাণ্ডে জনগণই বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কমিটিতে যাতে মাদক কারবারিসহ বিতর্কিত লোকজন যুক্ত না হতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলো সমাজে ভুল বার্তা যাবে।

সরেজমিন যা দেখা গেল
রাজধানীর কয়েকটি থানা ঘুরে কমিউনিটি পুলিশিং, ওপেন হাউস ডে ও উঠান বৈঠক নামে কোনো কার্যক্রম চলমান থাকার তথ্য মেলেনি। কিছু ক্ষেত্রে নতুন করে গঠিত হয়েছে সিটিজেন ফোরাম বা নাগরিক কমিটি। এর মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। তাদের নিয়ে মতবিনিময় সভা হচ্ছে। সেই সঙ্গে থানা এলাকার বিভিন্ন বিটে আলাদাভাবে বৈঠকের আয়োজন করা হচ্ছে। এর বাইরে মসজিদে গিয়ে, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জনগণের সঙ্গে কথা বলছেন, সহযোগিতা চাচ্ছেন।

সম্প্রতি হাতিরঝিল থানায় গিয়ে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের কক্ষের সামনে কয়েকজন নারী দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তারা বিরোধ-সংক্রান্ত একটি সমস্যা সমাধানে পুলিশের সহায়তা চাইতে এসেছেন। তারা জানান, পুলিশের সেবায় পরিবর্তন এসেছে। কেউ থানায় এলে পুলিশ তাঁর বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনছে; দ্রুত সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে।

হাতিরঝিল থানার ওসি মোহাম্মদ রাজু বলেন, মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে নানারকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এলাকার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে সিটিজেন ফোরাম গঠন করা হয়েছে। তাদের নিয়ে দুই মাস আগে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত প্রায় ৫০০ জনের মধ্যে ফুটপাতের ব্যবসায়ী, রিকশাচালকসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ ছিলেন। তাদের অভিযোগ, তাদের চাওয়া, তাদের সমস্যা আমরা গুরুত্বসহকারে শুনেছি এবং সে অনুযায়ী সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জনসম প ক ত ক কর মকর ত কম ট গ ল পর স থ ত ব যবস থ অপর ধ দ জনগণ র এল ক র ক ত কর র জন য সরক র বলছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ

চলতি অক্টোবর মাসে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশ এবং কারা হেফাজতে মৃত্যু সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। এ তথ্য তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির অক্টোবর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এমএসএফ বলেছে, এসব ঘটনায় জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ দুই ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।

এমএসএফ প্রতি মাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। আজ শুক্রবার অক্টোবর মাসের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে।

বেড়েছে অজ্ঞাতনামা লাশ

এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মোট ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়; বরং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) এর সংখ্যা ছিল ৫২। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দী ও রক্তাক্ত বা শরীরে আঘাতের চিহ্নসংবলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।

এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং তা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১টি শিশু, ১ কিশোর, ১১ জন নারী ও ৫৩ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ বছর বয়সী শিশু; ১৫ বছর বয়সী কিশোর; ২০ থেকে ৩০ বয়সী ১৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী; ৩১ থেকে ৪০ বয়সী ১৯ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী; ৪১ থেকে ৫০ বয়সী ১ নারী ও ৫ জন পুরুষ এবং ৫০ বছর বয়সের বেশি ১১ জন পুরুষ ও ১ নারী রয়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বয়স শনাক্ত করা যায়নি।

এমএসএফ বলেছে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।

কারা হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছেই

এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে কারা হেফাজতে মোট ১৩ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল মোট ৮। এ মাসে ছয়জন কয়েদি ও সাতজন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।

কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন কয়েদি ও দুজন হাজতি, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন কয়েদি ও শেরপুর জেলা কারাগারে একজন কয়েদি মারা যান। এ ছাড়া খুলনা জেলা কারাগারে, টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন করে হাজতি বন্দী মারা যান। সব বন্দীর মৃত্যু হয় কারাগারের বাইরে হাসপাতালে।

এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যু এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বৃদ্ধি মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা এবং সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্‌ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ। কিন্তু একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো কাজ নেই।

সাইদুর রহমান বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধি জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।

গণপিটুনিতে হত্যা চলছেই, বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা

অক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ২ জন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী–সমর্থক। সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনা ঘটেছিল।

সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকাণ্ড এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। আগের মাসে এ ঘটনা ঘটেছিল ৪৩টি। এ মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা ভিন্ন
  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ, নির্বাচন প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা
  • ‘আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ’ তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কঠিন: সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা
  • গণভোট নিয়ে উত্তাপ নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না: প্রেস সচিব
  • অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ
  • কথার আগে গুলি চালায় ‘কাকন বাহিনী’, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পদ্মার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল