‘যথাযথ সম্মান’ না পেয়ে ক্ষোভ, এরপর বাগ্বিতণ্ডা ও হাতাহাতি
Published: 23rd, March 2025 GMT
সিলেটে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ইফতার মাহফিলে হট্টগোল-হাতাহাতির ঘটনা মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেটের আহ্বায়ক। অবশ্য কয়েক ঘণ্টা পর তিনি জামিনে ছাড়া পান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একটি অংশের অভিযোগ, ইফতার মাহফিলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ও যুক্তদের যথাযথ সম্মান দেননি এনসিপির নেতা-কর্মীরা। এমনকি ইফতার মাহফিল-পূর্ব সভায় কাউকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে ছাত্রদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালে উভয় পক্ষের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়।
গতকাল শনিবার সিলেটের আরামবাগের একটি কনভেনশন হলে এনসিপির উদ্যোগে ওই ইফতার মাহফিল হয়। এতে নবগঠিত দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ইফতার-পূর্ব আলোচনা সভা চলাকালে হঠাৎ উভয় পক্ষের কয়েকজনকে তর্ক করতে দেখা যায়। এ সময় হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। এ দৃশ্য ভিডিও করলে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন আয়োজকদের কয়েকজন।
ঘটনার পর রাতে মাহবুবুর রহমান নামের এক শিক্ষার্থী সিলেট মহানগরের শাহপরান থানায় সাতজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। আজ রোববার ভোরে এ মামলার ৩ নম্বর আসামি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেটের আহ্বায়ক আকতার হোসেনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে দুপুরে তিনি জামিন পান।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দায়িত্বশীল কাউকে বক্তব্যের কোনো সুযোগ না দেওয়া, বিভিন্ন উপজেলাভিত্তিক ইফতারের টেবিল সংরক্ষিত থাকলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জন্য কোনো টেবিল সংরক্ষিত না রাখাসহ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে হট্টগোল হয়। এ থেকেই পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
যোগাযোগ করা হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিলেট মহানগরের আহ্বায়ক দিলোয়ার হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রদের হাত ধরেই এনসিপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অথচ ইফতার মাহফিলে সেই শিক্ষার্থীদেরই যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়নি। বরং তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে। এ কারণে বাগ্বিতণ্ডা ও ঝামেলা হয়।
এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল হুদা জুনেদ ইফতার মাহফিলের আয়োজনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুক্ত শিক্ষার্থী, আহত ও শহীদ পরিবারসহ সবাইকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী নাম নিয়ে কয়েকজন হাতেগোনা ব্যক্তি অযথাই উৎশৃঙ্খল আচরণ করেছেন।
‘নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব’
এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনসহ কিছু সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সিলেটে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়ান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা কয়েকজন। ধীরে ধীরে এ মতবিরোধ আরও বাড়ে। এরই জের ধরে এনসিপির ইফতার মাহফিলে হাতাহাতি ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের জুলাই ও আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নানা মতাদর্শের শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনের প্রতিনিধিরা যুক্ত হন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কিছুদিন পর থেকেই নানা মত-পথের এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। তবে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেট মহানগরের কমিটির গঠনের পরই মূলত তাঁদের মধ্যে বিভক্তি ও মতবিরোধ বাড়ে।
গত ৫ ডিসেম্বর জেলায় এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি মহানগরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি গঠিত হয়। এসব কমিটিতে অছাত্র, আন্দোলনে সম্পৃক্তহীন শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্তদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।
পরে ১৮ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী আসাদুল্লাহ আল গালিবকে সিলেটে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে।
কমিটি নিয়ে বিভক্তি দেখে দিলে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আসাদুল্লাহ আল গালিব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিলেট মহানগর কমিটি স্থগিত ঘোষণা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এতে তিনি জানান, কমিটিতে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অনেক ভুল এসেছে। সবকিছু সংশোধন করে পুনরায় কমিটি প্রকাশ করা হবে।
একাধিক সূত্র জানায়, সিলেটে মহানগর কমিটি ঘোষণার পরপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ আসাদুল্লাহ আল গালিবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন। এরপরই মূলত ভেতরে–ভেতরে শিক্ষার্থীদের মতবিরোধ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়ে। পরে ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ হওয়া রাজনৈতিক দল এনসিপিতে গালিব উত্তরাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠকের দায়িত্ব পান।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে আসাদুল্লাহ আল গালিবের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেট মহানগরের আহ্বায়ক দিলোয়ার হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্তর্দ্বন্দ্ব কিংবা মতবিরোধের কারণে ইফতার মাহফিলে হট্টগোল কিংবা বাগ্বিতণ্ডার ঘটনা ঘটেনি। যথাযথ সম্মান না পাওয়ার কারণেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ঘটনা এতটুকুই।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: মতব র ধ এনস প র র কম ট র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
কোরবানির গরু কেনার আড়াই লাখ টাকা ছিনিয়ে নিতে ব্যবসায়ী জাকিরকে হত্যা করা হয়
রাজধানীর সবুজবাগের প্লাস্টিক ব্যবসায়ী জাকির হোসেনের সঙ্গে থাকা আড়াই লাখ টাকা ছিনিয়ে নিতেই ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তাঁকে ছয় টুকরা করে লাশ বস্তায় ঢুকিয়ে কাছের একটি ঝোপের ভেতরে পুঁতে রাখা হয়। এর আগে আজহারুল ইসলাম (গ্রেপ্তার) মুঠোফোনে সবুজবাগের ভাইগদিয়ায় তাঁর ভাড়া বাসায় জাকিরকে (৫৫) ডেকে নেন।
গ্রেপ্তার আজহারুল ইসলাম (৩৯) আজ শুক্রবার আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ কথা বলেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। আদালত তাঁর জবানবন্দি নিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এ ছাড়া এ হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার শুক্কুর আলী (৪৪), মো. রাজীব (২৬) ও স্বপনকে (২৫) পাঁচ দিন করে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। গ্রেপ্তার শুক্কুর আলী পেশায় রাজমিস্ত্রি এবং বাকিরা রংমিস্ত্রি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সবুজবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সামছুল আমিন আজ প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার আজহারুল, শুক্কুর আলী, রাজীব ও স্বপন জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ায় দুপুরে তাঁদের ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাঠানো হয়। এর মধ্যে আজহারুল আদালত জবানবন্দি দেন। অপর তিনজন জবানবন্দি দিতে রাজি হননি। পরে তাঁদের সাত দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানানো হয়। শুনানি শেষে আদালত তাঁদের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আজহারুল আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, জাকির হোসেনের সঙ্গে তাঁদের চারজনের (আজহারুল, শুক্কুর আলী, রাজীব ও স্বপন) বন্ধুত্ব ছিল। তাঁরা একসঙ্গে আড্ডা দিতেন। মাঝেমধ্যে জাকিরের সঙ্গে তাঁর ভাইগদিয়ার ভাড়া বাসায় তাঁরা একসঙ্গে মদ্যপান করতেন। ৪ জুন রাতে জাকির নন্দীপাড়ায় শেখের বাজারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় ফিরছিলেন। তখন আজহারুল মুঠোফোনে জাকিরকে তাঁর বাসায় ডেকে নেন। ওই বাসায় আজহার একা থাকতেন। আগেই জাকির তাঁদের জানিয়েছিলেন, তাঁর কাছে কোরবানির গরু কেনার আড়াই লাখ টাকা আছে এবং ডেমরার আমুলিয়া পশুরহাট থেকে কোরবানির জন্য গরু কিনবেন। জাকির তাঁর বাসায় পৌঁছানোর পর ওই টাকার ওপর তাঁদের সবার লোভ জাগে। তাঁরা টাকা ছিনিয়ে নিতে গেলে জাকির বাধা দেন। তখন ইস্পাতের পাইপ দিয়ে জাকিরের মাথায় সজোরে আঘাত করেন আজহারুল। এতে জাকির অচেতন হয়ে যান। এ সময় তাঁর কাছ থেকে এক হাজার টাকার দুটি বান্ডিল ছিনিয়ে নিয়ে সেই টাকা শুক্কুর আলীর কাছে জমা রাখেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, আজহারুল আদালতকে জানান, জাকিরকে বাঁচিয়ে রাখা হলে তাঁরা সবাই ফেঁসে যাবেন—এমন আশঙ্কায় জাকিরকে হত্যা করে লাশ গুম করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জাকিরের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। এরপর শুক্কুর, রাজীব ও স্বপন তাঁর শরীর টুকরা টুকরা করেন। পরে লাশের ছয়টি টুকরা রঙের দুটি পাত্রে ভরে একটি অটোরিকশায় করে দক্ষিণ ভাইগদিয়ায় নিয়ে যান। শুক্কুর, রাজীব ও স্বপন অন্য পথ দিয়ে দক্ষিণ ভাইগদিয়ায় আসেন। তখন তাঁরা সবাই মিলে বালতিভর্তি লাশের টুকরাগুলো পাশের ঝোপে নিয়ে যান। এরপর সেখানে খুঁড়ে লাশের টুকরাগুলো পুঁতে রাখেন।
আজহারুল আদালতকে বলেন, জাকিরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া টাকা ভাগাভাগি করার আগেই তাঁরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
পুলিশ কর্মকর্তা সামছুল আমিন বলেন, আজহারুলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাহেরচরে। বাকি তিনজন ঢাকার সবুজবাগের ভাইগদিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা।
প্লাস্টিক ব্যবসায়ী জাকির হোসেন সপরিবার সবুজবাগ থানার ভাইগদিয়া এলাকায় থাকতেন। ৪ জুন জাকির হোসেন নিখোঁজ হন। এরপর স্বজনেরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তাঁর সন্ধান পাননি। পরদিন জাকির নিখোঁজ রয়েছেন বলে তাঁর স্ত্রী রেখা বেগম সবুজবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর মধ্যে জাকিরের খোঁজ না পাওয়ায় তিনি ১০ জুন আজহার আলীসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে সবুজবাগ থানায় একটি অপহরণের মামলা করেন।
পুলিশ কর্মকর্তা সামছুল আমিন বলেন, এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এলাকার ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত আজহারুলকে শনাক্ত করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে আজহারের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যায় জড়িত অভিযোগে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অপর তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল রাতে জাকির হোসেনকে ভাইগদিয়ায় দাফন করা হয়।
সবুজবাগ থানার ওসি ইয়াছিন আলী প্রথম আলোকে বলেন, জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে জাকিরকে হত্যা করা হয়েছে বলে তাঁর পরিবার অভিযোগ করলেও তদন্তে এখন পর্যন্ত এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। জাকির হত্যায় আরও একজন জড়িত। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।