প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে রাতের আঁধারে কাটা হচ্ছে ফসলি জমির মাটি। সেই মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। মাটি বাহী ভারি ট্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সড়ক, ধুলায় আচ্ছন্ন পরিবেশ। এমন পরিস্থিতি ঢাকার ধামরাই উপজেলায়। ইটভাটার এমন কষাঘাতে একদিকে বিপন্ন পরিবেশ, অন্য দিকে ঝুঁকিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন। এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চান এলাকাবাসী। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।

উপজেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, ধামরাইয়ে অন্তত দেড় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। যার সিংহভাগই অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ইটভাটার কাঁচামাল কৃষি জমির টপ সয়েল। কৃষকদের বাধ্য করা হচ্ছে মাটি বিক্রিতে। ফসলি জমি রাতারাতি পরিণত হচ্ছে পুকুর বা খালে। কমছে চাষের আবাদি জমি। এজন্য গেল দুই মাসে প্রায় ৩০টির বেশি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ভেঙে দেওয়া হয়েছে চিমনি, করা হয়েছে আর্থিক জরিমানা।

সম্প্রতি উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের ফসলি মাঠে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রাত নেমে আসার পরপরই ভাটার নিকটবর্তী এলাকাগুলোর ফসলি জমির পাশে ভিড়তে শুরু করে বড় বড় ট্রাকের বহর। আলো পড়ে গেলেই শুরু হয় মাটি কাটার ধুম। বছরের পর বছর জুড়ে বেআইনিভাবে এভাবেই ধামরাইয়ের বিভিন্ন এলাকার মাটি কেটে ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে। 

একদিকে ভাটায় জমছে মাটির পাহাড়, অপর দিকে প্রতিনিয়ত ছোট ছোট ডোবা-খালের অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে উপজেলাটি। এসব মাটি পরিবহনের ভারি ট্রাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সড়ক। এতে সৃষ্ট ধুলায় আচ্ছন্ন থাকছে আশপাশের পুরো এলাকা।

ইটভাটার মাটি পরিবহনে ব্যবহার করা ভারি ট্রাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয় সড়কগুলো। সড়কে চলাচলে ভোগান্তি পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এছাড়া এতে সৃষ্ট ধুলায় আচ্ছন্ন থাকছে আশপাশের ঘরবাড়ি। এতে বাড়ছে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ। এজন্য প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

ধামরাইয়ের বালিথা এলাকার কৃষক মো.

শামসুল হক বলেন, ‘‘একসময় সবই আবাদি জমি ছিল। ২-৩ বার ফসল ফলাতাম। এই ভাটা কোম্পানি এসে সব জমি নষ্ট করছে। সব মাটি ইটভাটায় গেছে। সব জমি এখন খাল হয়ে গেছে। আর এমনভাবে জমির মাটি কাটে যে, পাশের জমি মালিকও মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কারণ, অতিরিক্ত খাদ করায় পাশের জমি এমনিতেই ভেঙে পড়তে থাকে।’’

মো. লাল মিয়া নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘‘২-৩ ফসলি জমিগুলোর মাটি কেটে নিয়ে গেছে ইটভাটায়। ভাটায় মাটির পাহাড় কিন্তু কৃষি জমি খালে পরিণত হয়েছে। এদের কিছু করা যায় না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ধামরাই এক সময় খালে পরিণত হবে। এজন্য প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।’’

কুশুরা এলাকার বাসিন্দা মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের সড়কে বড় বড় মাটি বহনকারী, ইট বহনকারী ট্রাক চলায় চলাচলে খুব অসুবিধা হয়। মসজিদে যেতে পারি না, হাটবাজারে যাতায়াতে খুবই সমস্যা হয়। জনগণ খুব কষ্টে আছে। ঘরবাড়ি ক্ষতি হচ্ছে ধুলায়, টিন নষ্ট হচ্ছে, গাছগাছালি নষ্ট হচ্ছে। ফলন হয় না। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।’’

মো. আবুল হোসেন নামে এক ভ্যান চালক বলেন, ‘‘ধুলার কারণে সর্দি কাশি লেগেই থাকে। শাকসবজি টেকে না। বৃষ্টি হলে রাস্তা কাদায় ভর্তি থাকে। আবার শুকনার সময় ধুলা। জীবন একদম শেষ হয়ে গেছে। সবার বাড়িঘরে ধুলা। এই পরিণতি থেকে মুক্তি চাই।’’

এদিকে ইটভাটায় কৃষি জমি কমে যাওয়া, মাটি এবং ইট পরিবহনের কারণে সৃষ্ট ধুলায় প্রভাব পড়ছে পরিবেশেও। শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন আশপাশের বাসিন্দারা। এছাড়া ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আহমেদুল হক তিতাস বলেন, ‘‘ইটভাটার কালো ধোঁয়া স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ। এই কালো ধোঁয়া থেকে রোগীদের শ্বাসকষ্ট হয় ও নিউমোনিয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকিও থাকে। রাস্তাঘাটে প্রচুর ধুলাবালি, এখন শ্বাসকষ্ট, ময়লা থেকে সৃষ্ট আ্যালার্জির রোগী ও যাদের আগে হাঁপানি ছিল না নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে এমন প্রচুর রোগী পাচ্ছি। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি। আমি মনে করি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখা দরকার যেন কালো ধোঁয়া থেকে কারো ক্ষতি না হতে পারে।’’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জামাল উদ্দিন রুনু বলেন, ‘‘সাভার ধামরাই অঞ্চলে অনেক ইটভাটা রয়েছে। এই ইটভাটাগুলো আইনগত ভিত্তি না থাকার পরও পরিচালিত হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই পরিচালিত হয়, কারণ ইটের ব্যাপক চাহিদা আছে। ইটের বিকল্প না থাকায়, এটির চাহিদা বাজারে রয়েছে। কথা হচ্ছে, ইটের ভাটা কীভাবে পরিবেশ দূষিত করছে। প্রথমত, ইটের ভাটার চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ার সঙ্গে বাতাসে পরিবেশে কয়েকটি জিনিস ছড়াচ্ছে। সেটা কি? নক্স, নাইট্রো অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, এসপিএম অথবা পিএম ২.৫, পিএম ১০। এ কয়েকটি ছাড়াও ভলাটেল অর্গানিক মেটাল হিসেবে যেটা থাকে, ভক আর কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড তো আছেই।’’

তিনি বলেন, ‘‘এই ইটের ভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া অথবা দূষিত পদার্থসমূহ, বাতাসে মিশ্রিত হয়ে আশপাশের অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি যেমন তৈরি করছে, তেমন পরিবেশগত বিপর্যয়ও তৈরি হচ্ছে। পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিক থেকে ইকো সিস্টেমের যে গাছপালা বা প্রাণিকূল, অথবা ইনসেক্ট, যেগুলো পরাগায়ন করে, তাদের নানাভাবে বাধা প্রদান করছে। তাদের অবস্থানকে নাজুক করে দেয়। ফলে ইকো সিস্টেমের যে চেইন রয়েছে, সেটা নষ্ট হচ্ছে। আর স্বাস্থ্যগত যে ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে, সরাসরি ২.৫ ও পিএম ১০ ইনহেল করে মানুষ শ্বাস জনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়াও কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড অথবা নক্স সক্স এগুলো গ্রিন হাউস গ্যাস হিসেবে আমাদের শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে। ফলে মাইক্রো ক্লাইমেট যেমন পরিবর্তিত হচ্ছে, সামগ্রিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হচ্ছে।” 

তিনি আরো বলেন, “আমি মনে করি, এই ইটভাটাগুলো যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হই আইনের মধ্য দিয়ে, তাহলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটবে। এখনই উচিৎ ইটের বিকল্প পণ্য বাজারে ছাড়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা। প্রণোদনা দেওয়া ও ব্যবহারের আইনগত বাধ্যবাধকতা করা। তা না হলে আইন ও অনুশাসনকে ফাঁকি দিয়ে ইটভাটা এভাবেই চলতে থাকবে।’’

কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী গেল কয়েক মাসে প্রায় অর্ধশত অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অবৈধ ইটভাটা ধ্বংস করা হচ্ছে। এ ধরনের অভিযান চালিয়ে যাওয়া হবে বলে জানায় প্রশাসন।

ধামরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মামনুন আহমেদ অনীক বলেন, ‘‘ধামরাইয়ে প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে মাটি কাটার একটা হিড়িক পড়ে যায়। কারণ এখানে প্রচুর ইটভাটা রয়েছে, আর এখানকার মাটি ইট বানানোর যথোপযুক্তও। ফলে চাহিদা বেশি। এতে প্রচুর ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। আমরা গত দুই মাসে প্রায় ৩০টির বেশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছি। ভেকু জব্দ করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর কৃষি জমি রক্ষায় প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতনতাও গুরুত্বপূর্ণ।’’

প্রাণ প্রকৃতি রক্ষা ও ঢাকার নিকটবর্তী এলাকাটির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে ইটভাটার লাগাম টানা জরুরি। এজন্য প্রশাসন ও স্থানীয় পর্যায়ে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের।

ঢাকা/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর শ ব সকষ ট ইটভ ট র ক ন পর ব শ আশপ শ র ইটভ ট য় ব যবস থ পর চ ল ক বল ন ক র বন উপজ ল এজন য র ফসল

এছাড়াও পড়ুন:

পিডিবির ভুলে ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হলো বাংলাদেশকে

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) খামখেয়ালিজনিত এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশকে দুই কোটি মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে।

খামখেয়ালিটি হলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২০০০ সালে হওয়া ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে (বিরোধ নিষ্পত্তির আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা) একটি মামলায় পক্ষভুক্ত না হওয়া। পক্ষভুক্ত হতে গেলে বাংলাদেশকে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হতো। তা করেনি পিডিবি। ফলে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে একতরফা রায় হয়েছে। দুই যুগ পর এখন বাংলাদেশকে জরিমানা দিতে হয়েছে ৩৩৩ গুণ বেশি অর্থ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গত ১৯ মে পিডিবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, এ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ হিসেবে পিডিবিকে দেওয়া হবে, যা তারা দেবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডকে। হরিপুরে ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্পনসর (পৃষ্ঠপোষক) ছিল এই স্মিথ কো-জেনারেশন।

আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান

অবশ্য পিডিবি অর্থ বিভাগের ঋণ নেয়নি। সংস্থাটি নিজের তহবিল থেকে গত ২৩ মে ২৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কোম্পানিটি।

এই পাওনা টাকাকে কেন্দ্র করেই ২০২৪ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। জটিলতা এড়াতে তাঁরা দুজন পরে হোটেল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় (বাংলাদেশ হাউস) গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।’

ঘটনা শুরু যেভাবে

মূল ঘটনা ১৯৯৭ সালের অক্টোবরের। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার হরিপুরে বেসরকারি খাতে ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কো-জেনারেশন ইন্টারন্যাশনালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে দুটি চুক্তি করে বাংলাদেশ। কোম্পানিটির সঙ্গে পিডিবির একটি চুক্তি হয় ১৯৯৭ সালের ১৪ অক্টোবর। দুই দিন পর ১৬ অক্টোবর সরকারের সঙ্গে আরেকটি চুক্তি হয় বিদ্যুৎ কেনার (পিপিএ)।

চুক্তি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ১৯৯৮ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু কোম্পানিটি তা পারেনি। শর্ত ছিল নির্ধারিত দিন থেকে উৎপাদন করতে না পারলে দুই মাস মেয়াদ বাড়াবে সরকার, তবে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার মার্কিন ডলার করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কোম্পানিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তো দূরের কথা, কোনো নির্মাণকাজ করতে পারেনি; বরং আরও ৬ মাস ২০ দিন সময় চায়। সরকার তা না মেনে ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পিপিএ ও জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করে দেয়। শুধু তা–ই নয়, ব্যাংক নিশ্চয়তার (পিজি) ১৫ লাখ ডলারও নিয়ে নেয় পিডিবি।

সচিবালয়ে গত ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক থেকে মার্কিন কোম্পানিটিকে ২ কোটি ডলার দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। বিদ্যুৎসচিব ফারজানা মমতাজ এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এতে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কথা আসেনি। যদিও সম্প্রতি আলাদা এক চিঠিতে অর্থ বিভাগ এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।

বিদ্যুৎসচিবের সঙ্গে গত ১৫ মে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করে জানতে চাওয়া হয় যে যাঁদের কারণে বাংলাদেশকে এখন ২৪৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে, তাঁদের তিনি বাঁচিয়ে দিলেন কেন। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।

ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদবিষয়টি যেভাবে আদালতে গড়াল

অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে পাঠানো বিদ্যুৎসচিবের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটি ২০০০ সালে ঢাকার সাব জজ পঞ্চম আদালতে আরবিট্রেশন মিসকেইস (বিবিধ মামলা) এবং নারায়ণগঞ্জের সাব জজ প্রথম আদালতে আরেকটি আরবিট্রেশন বিবিধ মামলা করে। উভয় মামলাই আদালত খারিজ করে দেন। আদালতে মামলার পাশাপাশি কোম্পানিটি পরে পিপিএ বাতিল ও পিজি নগদায়নের বিরুদ্ধে আইসিসি আরবিট্রেশনে যেতে পিডিবিকে নোটিশ দেয়। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটিকে চিঠি দিয়ে জানায়, আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি হতে পারেন আরবিট্রেটর।

কিন্তু আইসিসি বিদেশে আরবিট্রেশন মামলায় অংশগ্রহণের জন্য ট্রাইব্যুনাল খরচ বাবদ নির্ধারণ করে ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা উভয় পক্ষকে সমানভাবে বহন করতে হবে। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার দিতে হবে অগ্রিম। অর্ধেক হিসেবে তখন পিডিবির খরচ করতে হতো অগ্রিমের ৬০ হাজার ডলার।

তখনকার পিডিবির পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ট্রাইব্যুনাল খরচের কোনো অর্থ দেবে না। পিডিবির তৎকালীন আইনজীবী প্যানেল একই পরামর্শ দেয়। আইনজীবীরা আরও মত দেন, দেশে আরবিট্রেশন আইন হয়েছে ২০০১ সালে। এর আগে আইসিসির আরবিট্রেশনের রায় বাংলাদেশের বাইরে কার্যকর হবে না। তাঁরা মামলায় পক্ষভুক্ত না হতে পিডিবিকে পরামর্শ দেন।

পরে একপক্ষীয় শুনানি শেষে আইসিসি আরবিট্রেশন আদালত ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর রায় দেন। রায়ে বলা হয়, পিডিবি বছরে ৪ শতাংশ সুদসহ মোট ১ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে।

রায় বাস্তবায়নের ছয় মামলা

আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়নে স্মিথ কো-জেনারেশন পরে ছয়টি মামলা করে। এগুলো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব অব কলাম্বিয়া, ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্ক, সুপ্রিম কোর্ট অব নিউইয়র্ক, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের কোর্ট অব সেশন, সুইজারল্যান্ডের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব বাডেন এবং ঢাকার আদালতে।

আইসিসির রায় বাস্তবায়নে ২০০৭ সালের ২০ জুলাই রায় দেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব কলাম্বিয়া। স্মিথ কো-জেনারেশন এ আদালতে বিষয়টি আবার উত্থাপন করে। এরপর ২০২৪ সালের ১৯ মে পিডিবির বিরুদ্ধে সংশোধিত চূড়ান্ত রায় দেন আদালত। এবারের রায়ে বলা হয়, পিডিবি ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার পরিশোধ করবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে। কোম্পানিটি তখন তার আইনি প্রতিষ্ঠান ডোয়ান মরিস এলএলপিকে বিষয়টি জানায়। কিন্তু রায় আর বাস্তবায়ন হচ্ছিল না।

বিষয়টি নিয়ে জানতে গত ২৮ মে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনিও কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর যে বিপদে পড়েছিলেন

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন যায় উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন একটি দল, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও ছিলেন। ২১-২৬ অক্টোবর (২০২৪) ছিল এ বার্ষিক সভা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপদেষ্টা ও গভর্নরের ওয়াশিংটন যাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে স্মিথ কো-জেনারেশন আরেকটি মামলা করে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায়। আদালত তখন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের জবানবন্দি নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু যেহেতু অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা আছে এবং তাঁরা পিডিবির সঙ্গে সম্পর্কিত নন, তাই তাঁরা জবানবন্দি দেননি।

স্মিথ কো-জেনারেশন তখন আবার আদালতে (যুক্তরাষ্ট্র) যায়। আদালত ২৫ অক্টোবর (২০২৪) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আহসান এইচ মনসুরকে আটক করে আদালতে নিয়ে আসতে ইউএস মার্শাল সার্ভিসকে নির্দেশ দেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা দুজন তখন আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সরকারি বাসভবনে। তাঁরা ছিলেন ওয়াশিংটন ডিসির ১০ নম্বর সড়কে অবস্থিত অ্যাম্বাসি স্টু হোটেলে। দূতাবাসের গাড়িতে করে তাঁরা ম্যারিল্যান্ডে রাষ্ট্রদূতের বাসায় চলে যান।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগ এলএলপিকে নিয়োগ দেয়। তারা আপিল করলে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা স্থগিত করেন এবং শুনানির দিন ধার্য করেন ২৮ অক্টোবর (২০২৪)। ফলি হোয়াগ এলএলপি বিষয়টি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতার আবেদন জানায় বিচারকের কাছে এবং বিচারক তা গ্রহণ করেন। এভাবেই অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর ওই যাত্রায় রক্ষা পান।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ৩০ জুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়।’

বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।নিষ্পত্তির পথ খুলল যেভাবে

মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায়কে ভিত্তি ধরে দেশে তখন গুরুত্বের সঙ্গে কাজ শুরু করেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর এ বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

এরপর স্মিথ কো-জেনারেশনের মধ্যস্থতাকারী, বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির কর্মকর্তা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান অনলাইনে ৫টি বৈঠক করেন। শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, জব্দ করা ব্যাংক নিশ্চয়তার ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হোক। বিপরীতে স্মিথ কো-জেনারেশন দাবি করে ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। আরও দাবি করে, মামলার খরচ বাবদ আরও ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার তাদের দিতে হবে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রস্তাবে কোম্পানিটিকে বলা হয়, ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান আইনের আওতায় বিদ্যুৎ খাতে তাদের বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। এতেও রাজি হয়নি স্মিথ কো–জেনারেশন। বাংলাদেশ পরে ১ কোটি ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়। স্মিথ কো-জেনারেশন তখন নতুন প্রস্তাব দেয়। সেটি হলো, এককালীন ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। অথবা ২ কোটি ৪০ লাখ ডলার ও দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে তারা মেনে নেবে।

বিষয়টি নিয়ে মধ্যস্ততায় থাকা বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে গত ২৬ মে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অবশ্য অর্থ বিভাগ ও পিডিবি সূত্র জানায়, পরে স্মিথ কো-জেনারেশন ২ কোটি ডলারে রাজি হয়। বাংলাদেশ সরকারও সিদ্ধান্ত নেয়, এই পরিমাণ অর্থ ওই কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে আগেই সম্মতি দিয়ে রেখেছিলেন (গত ১৮ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা। গত ২৮ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।

ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ‘দেশের বদনাম হলো’

১৯৯৬-৯৯ সময়ে পিডিবির চেয়ারম্যান ছিলেন নুরউদ্দিন মাহমুদ কামাল, তিনি ২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বর মারা যান। ১৯৯৯-০০ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক সচিব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক, যিনি মারা যান ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ২০০০-০২ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ মালেক, যিনি মারা যান ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।’

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ জীবিত থাকলে শাস্তি দিতে হবে। এমনকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবিরও শাস্তি পাওয়া উচিত। অর্থ বিভাগের পরামর্শ মেনে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত করা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ