রাজধানীর অন্যতম অভিজাত বুটিকের ব্র্যান্ড হাউস অব আহমেদ। সেখানে ছেলেদের পাঞ্জাবি বিক্রি হচ্ছে সাত হাজার থেকে চার লাখ টাকায়। দামি কাপড়ের ওপর জারদোসি ও এমব্রয়ডারির নিখুঁত কাজ করা চার লাখ টাকা দামের একটি পাঞ্জাবি তৈরিতে সময় লাগে দুই থেকে তিন মাস। তবে এই পাঞ্জাবি কিনতে একটু আগেভাগেই ক্রয়াদেশ দিতে হবে। বনানীর ১২ নম্বর সড়কের সিবিএল ডেলভিস্টা ভবনের ষষ্ঠ ও অষ্টম তলাজুড়ে এ ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্র।

হাউস অব আহমেদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ডিজাইনার আহমেদ তুহিন রেজা প্রথম আলোকে বলেন, আভিজাত্য ও রুচিশীল নকশার পাশাপাশি উন্নত মানের পোশাক তৈরির মাধ্যমে দেশের মানুষের রুচি পরিবর্তনের চেষ্টা হিসেবে এই ব্র্যান্ড গড়ে তুলেছেন। চার লাখ টাকা দামের একেকটি পাঞ্জাবি প্রশিক্ষিত ও দক্ষ কারিগর দিয়ে হাতে তৈরি করা হয়, এ জন্য খরচও বেশি। এই পাঞ্জাবির জন্য সুতা ও কাপড়ও বিদেশ থেকে আনা হয়।

কারা এই দামি পাঞ্জাবির ক্রেতা—জানতে চাইলে আহমেদ তুহিন জানান, জুলাই আন্দোলনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাসহ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা ছিলেন দামি পোশাকের অন্যতম ক্রেতা। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দামি পাঞ্জাবিসহ অন্যান্য পোশাকের ৯৫ শতাংশ ক্রেতা আর নেই। তাই পাঞ্জাবিসহ অন্যান্য দামি পোশাকের বিক্রি কমে গেছে। এর বদলে এখন ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকা দামের পোশাকের ক্রেতা বেশি। তিনি আরও জানান, তাঁর এই ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্রের ক্রেতাদের বড় অংশই ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা।

কোথায় কী পাওয়া যায়

হাউস অব আহমেদ ছাড়াও বনানী ১১ ও ১২ নম্বর সড়ক এবং এর আশপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি অভিজাত পোশাকের দোকান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জে কে ফরেন, ফ্ল্যাগশিপ ১৩৮, হাউস অব বিন্দু, জুরহেইম, কোরাল ক্লসেট, পুমা ও আমারা। বনানী ছাড়াও রাজধানীর অভিজাত এলাকাখ্যাত গুলশানের পিংক সিটিতেও রয়েছে নামীদামি পোশাকের দোকান। এসব দোকানে ভারত, পাকিস্তানসহ দেশে তৈরি নানা ধরনের পোশাক পাওয়া যায়। এর বাইরে গুলশানে রয়েছে ভিভা ক্রিয়েশনস ও ভাসাভির মতো দামি পোশাকের বিক্রয়কেন্দ্র। এসব দোকান ও বিক্রয়কেন্দ্রের বিক্রেতারা জানান, ঈদে বেশির ভাগ মানুষের চাহিদা থাকে ভারতীয় ও পাকিস্তানি পোশাকের। তাই ঈদকে সামনে রেখে তাঁরা ভারত ও পাকিস্তানের নানা ধরনের নামীদামি পোশাক সংগ্রহ করেছেন বিক্রির জন্য।

গত মঙ্গলবার মেয়েকে নিয়ে গুলশান পিংক সিটিতে ঈদের কেনাকাটা করতে আসেন তাসমিন নাহার। পেশায় তিনি শিক্ষিকা। নিজের ও মেয়ের জন্য ২৫ হাজার টাকা দিয়ে দুটি থ্রি–পিস কেনেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পিংক সিটিতে অনেক ধরনের পোশাক পাওয়া যায়। তাই পছন্দের পোশাকটি পাওয়া যায় সহজে। এ জন্য ঈদের কেনাকাটার জন্য এখানে এসেছেন। তিনি জানান, গত বছরের তুলনায় এবার পোশাকের দাম বাড়তি।

কোথায় দাম কত

বনানীর জে কে ফরেন নামের ব্র্যান্ডের দোকানে ছেলেদের পাঞ্জাবি বিক্রি হচ্ছে ৪ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। মেয়েদের থ্রি–পিসের দাম ৩ থেকে ৬০ হাজার টাকার মধ্যে। এ ছাড়া শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ৩৫ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকায়। জে কে ফরেন বিক্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘আমাদের বিক্রয়কেন্দ্রে বিভিন্ন দামের পোশাক পাওয়া গেলেও সবচেয়ে বেশি চাহিদা ৫ থেকে ২০ টাকার পোশাকের।’

এ ছাড়া একই এলাকার হাউস অব বিন্দুতে বেশি পাওয়া যায় মেয়েদের নানা ধরনের পোশাক। তবে আগে থেকে ক্রয়াদেশ দিলে ছেলেদের পোশাকও বানিয়ে দেয় তারা। এই বিক্রয়কেন্দ্রে মেয়েদের থ্রি–পিস বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায়। নানা ধরনের পার্টি পোশাক বিক্রি হচ্ছে ২২ থেকে ২৬ হাজার টাকায়। এই বিক্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মিতু মনি বলেন, দেশের ক্রেতাদের পাশাপাশি বিদেশেও তাঁদের ক্রেতা রয়েছে। আমেরিকা ও ফ্রান্সের কিছু ক্রেতা তাঁদের পোশাক কেনেন। কুরিয়ারের মাধ্যমে এসব ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দেন তাঁরা।

বনানীর আরেক ব্র্যান্ড কোরাল ক্লসেটে শাড়ি বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার থেকে এক লাখ টাকায়। এই বিক্রয়কেন্দ্রের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার রুপো শামস্ জানান, দামকে প্রাধান্য না দিয়ে তাঁরা ক্রেতাদের রুচিকে প্রাধান্য দিয়ে পোশাকের নকশা করেন।

এদিকে গুলশানের অভিজাত বিক্রয়কেন্দ্র ভাসাভিতে ছেলেদের পাঞ্জাবি বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকায়। আর মেয়েদের থ্রি–পিসের দাম ৬ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এসব পোশাক ভারত থেকে এনে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি।

অভিজাত এলাকায় ব্যবসায় ভাটা

গুলশানের ভিভা ক্রিয়েশনস নামের বিক্রয়কেন্দ্রে ছেলেদের একেকটি পাঞ্জাবির দাম ৪ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এ ছাড়া মেয়েদের শাড়ি বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার থেকে সোয়া চার লাখ টাকায়। কাতান, সিল্ক, কাঞ্জিভরম, শিফন, জর্জেট, সুতি ও মসলিনজাতীয় শাড়ি পাওয়া যায় বিক্রয়কেন্দ্রটিতে। এই বিক্রয়কেন্দ্রের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার বিক্রি ৬০ শতাংশ কম। বর্তমান পরিস্থিতিতে দামি পোশাকের বিক্রি বেশি কমেছে। এর বিপরীতে ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকার পোশাকের বিক্রি বেড়েছে। ঈদকে সামনে রেখে অন্যান্য বছরের তুলনায় উপহারের নানা পোশাক বিক্রিও কমেছে।

মঙ্গলবার ঈদের কেনাকাটার জন্য ভিভা ক্রিয়েশনসে আসেন মিরপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী শাহীনা আশরাফ। ভাইয়ের জন্য পাঞ্জাবি কিনতে আসেন তিনি এই বিক্রয়কেন্দ্রে। আলাপকালে তিনি বলেন, এখানে নানা ডিজাইনের রুচিশীল পোশাক পাওয়া যায়। এ কারণে খুব সহজেই পছন্দের পোশাক কেনা যায়। ভাইয়ের জন্য এবার ৩২ হাজার টাকা দামের একটি পাঞ্জাবি কিনেছেন তিনি।

গুলশান ও বনানীর নামীদামি পোশাকের বিক্রয়কেন্দ্রের মালিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অভিজাত এসব এলাকার ব্যবসায় কিছুটা ভাটা লেগেছে। ঈদকে কেন্দ্র করে বিগত বছরগুলোতে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদেরা যেসব উপহার কিনতেন, সেই বিক্রি এবার একেবারে কমে গেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে দামি পোশাকের বিক্রি।

ভাসাভির ফ্লোর ইনচার্জ ফরিদ আহমেদ বলেন, এখন উপহারের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে পোশাক বেশি খোঁজেন ক্রেতারা। আগে ঈদ মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ক্রেতা আসতেন। এ বছর তা কমে ৫০০–৬০০–তে নেমেছে। গত বছরের তুলনায় এবারের ঈদে তাঁদের বিক্রি কমেছে ৬০ শতাংশ। বিগত বছরগুলোতে ঈদকে কেন্দ্র করে যেখানে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ পাঞ্জাবি বিক্রি হতো, এবার সেই সংখ্যা কমে ৬০ থেকে ১০০টিতে নেমেছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ব ক রয়ক ন দ র ব ক রয়ক ন দ র র ধরন র প ব যবস য় র ব যবস গত বছর র জন ত বন ন র আহম দ

এছাড়াও পড়ুন:

পিডিবির ভুলে ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হলো বাংলাদেশকে

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) খামখেয়ালিজনিত এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশকে দুই কোটি মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে।

খামখেয়ালিটি হলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২০০০ সালে হওয়া ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে (বিরোধ নিষ্পত্তির আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা) একটি মামলায় পক্ষভুক্ত না হওয়া। পক্ষভুক্ত হতে গেলে বাংলাদেশকে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হতো। তা করেনি পিডিবি। ফলে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে একতরফা রায় হয়েছে। দুই যুগ পর এখন বাংলাদেশকে জরিমানা দিতে হয়েছে ৩৩৩ গুণ বেশি অর্থ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গত ১৯ মে পিডিবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, এ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ হিসেবে পিডিবিকে দেওয়া হবে, যা তারা দেবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডকে। হরিপুরে ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্পনসর (পৃষ্ঠপোষক) ছিল এই স্মিথ কো-জেনারেশন।

আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান

অবশ্য পিডিবি অর্থ বিভাগের ঋণ নেয়নি। সংস্থাটি নিজের তহবিল থেকে গত ২৩ মে ২৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কোম্পানিটি।

এই পাওনা টাকাকে কেন্দ্র করেই ২০২৪ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। জটিলতা এড়াতে তাঁরা দুজন পরে হোটেল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় (বাংলাদেশ হাউস) গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনজীবী ও পিডিবির তৎকালীন পর্ষদের খামখেয়ালির কারণে আজ এত বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হলো। আইসিসির আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করাটা ছিল মস্ত ভুল। ফলে একতরফা রায় হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে।’

ঘটনা শুরু যেভাবে

মূল ঘটনা ১৯৯৭ সালের অক্টোবরের। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার হরিপুরে বেসরকারি খাতে ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কো-জেনারেশন ইন্টারন্যাশনালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে দুটি চুক্তি করে বাংলাদেশ। কোম্পানিটির সঙ্গে পিডিবির একটি চুক্তি হয় ১৯৯৭ সালের ১৪ অক্টোবর। দুই দিন পর ১৬ অক্টোবর সরকারের সঙ্গে আরেকটি চুক্তি হয় বিদ্যুৎ কেনার (পিপিএ)।

চুক্তি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ১৯৯৮ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু কোম্পানিটি তা পারেনি। শর্ত ছিল নির্ধারিত দিন থেকে উৎপাদন করতে না পারলে দুই মাস মেয়াদ বাড়াবে সরকার, তবে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার মার্কিন ডলার করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কোম্পানিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তো দূরের কথা, কোনো নির্মাণকাজ করতে পারেনি; বরং আরও ৬ মাস ২০ দিন সময় চায়। সরকার তা না মেনে ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পিপিএ ও জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করে দেয়। শুধু তা–ই নয়, ব্যাংক নিশ্চয়তার (পিজি) ১৫ লাখ ডলারও নিয়ে নেয় পিডিবি।

সচিবালয়ে গত ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক থেকে মার্কিন কোম্পানিটিকে ২ কোটি ডলার দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। বিদ্যুৎসচিব ফারজানা মমতাজ এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এতে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কথা আসেনি। যদিও সম্প্রতি আলাদা এক চিঠিতে অর্থ বিভাগ এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।

বিদ্যুৎসচিবের সঙ্গে গত ১৫ মে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করে জানতে চাওয়া হয় যে যাঁদের কারণে বাংলাদেশকে এখন ২৪৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে, তাঁদের তিনি বাঁচিয়ে দিলেন কেন। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।

ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদবিষয়টি যেভাবে আদালতে গড়াল

অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে পাঠানো বিদ্যুৎসচিবের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটি ২০০০ সালে ঢাকার সাব জজ পঞ্চম আদালতে আরবিট্রেশন মিসকেইস (বিবিধ মামলা) এবং নারায়ণগঞ্জের সাব জজ প্রথম আদালতে আরেকটি আরবিট্রেশন বিবিধ মামলা করে। উভয় মামলাই আদালত খারিজ করে দেন। আদালতে মামলার পাশাপাশি কোম্পানিটি পরে পিপিএ বাতিল ও পিজি নগদায়নের বিরুদ্ধে আইসিসি আরবিট্রেশনে যেতে পিডিবিকে নোটিশ দেয়। নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিটিকে চিঠি দিয়ে জানায়, আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি হতে পারেন আরবিট্রেটর।

কিন্তু আইসিসি বিদেশে আরবিট্রেশন মামলায় অংশগ্রহণের জন্য ট্রাইব্যুনাল খরচ বাবদ নির্ধারণ করে ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা উভয় পক্ষকে সমানভাবে বহন করতে হবে। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার দিতে হবে অগ্রিম। অর্ধেক হিসেবে তখন পিডিবির খরচ করতে হতো অগ্রিমের ৬০ হাজার ডলার।

তখনকার পিডিবির পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ট্রাইব্যুনাল খরচের কোনো অর্থ দেবে না। পিডিবির তৎকালীন আইনজীবী প্যানেল একই পরামর্শ দেয়। আইনজীবীরা আরও মত দেন, দেশে আরবিট্রেশন আইন হয়েছে ২০০১ সালে। এর আগে আইসিসির আরবিট্রেশনের রায় বাংলাদেশের বাইরে কার্যকর হবে না। তাঁরা মামলায় পক্ষভুক্ত না হতে পিডিবিকে পরামর্শ দেন।

পরে একপক্ষীয় শুনানি শেষে আইসিসি আরবিট্রেশন আদালত ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর রায় দেন। রায়ে বলা হয়, পিডিবি বছরে ৪ শতাংশ সুদসহ মোট ১ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে।

রায় বাস্তবায়নের ছয় মামলা

আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়নে স্মিথ কো-জেনারেশন পরে ছয়টি মামলা করে। এগুলো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব অব কলাম্বিয়া, ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্ক, সুপ্রিম কোর্ট অব নিউইয়র্ক, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের কোর্ট অব সেশন, সুইজারল্যান্ডের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব বাডেন এবং ঢাকার আদালতে।

আইসিসির রায় বাস্তবায়নে ২০০৭ সালের ২০ জুলাই রায় দেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব কলাম্বিয়া। স্মিথ কো-জেনারেশন এ আদালতে বিষয়টি আবার উত্থাপন করে। এরপর ২০২৪ সালের ১৯ মে পিডিবির বিরুদ্ধে সংশোধিত চূড়ান্ত রায় দেন আদালত। এবারের রায়ে বলা হয়, পিডিবি ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার পরিশোধ করবে স্মিথ কো-জেনারেশনকে। কোম্পানিটি তখন তার আইনি প্রতিষ্ঠান ডোয়ান মরিস এলএলপিকে বিষয়টি জানায়। কিন্তু রায় আর বাস্তবায়ন হচ্ছিল না।

বিষয়টি নিয়ে জানতে গত ২৮ মে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনিও কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর যে বিপদে পড়েছিলেন

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন যায় উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন একটি দল, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও ছিলেন। ২১-২৬ অক্টোবর (২০২৪) ছিল এ বার্ষিক সভা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপদেষ্টা ও গভর্নরের ওয়াশিংটন যাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে স্মিথ কো-জেনারেশন আরেকটি মামলা করে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায়। আদালত তখন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের জবানবন্দি নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু যেহেতু অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা আছে এবং তাঁরা পিডিবির সঙ্গে সম্পর্কিত নন, তাই তাঁরা জবানবন্দি দেননি।

স্মিথ কো-জেনারেশন তখন আবার আদালতে (যুক্তরাষ্ট্র) যায়। আদালত ২৫ অক্টোবর (২০২৪) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আহসান এইচ মনসুরকে আটক করে আদালতে নিয়ে আসতে ইউএস মার্শাল সার্ভিসকে নির্দেশ দেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা দুজন তখন আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সরকারি বাসভবনে। তাঁরা ছিলেন ওয়াশিংটন ডিসির ১০ নম্বর সড়কে অবস্থিত অ্যাম্বাসি স্টু হোটেলে। দূতাবাসের গাড়িতে করে তাঁরা ম্যারিল্যান্ডে রাষ্ট্রদূতের বাসায় চলে যান।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগ এলএলপিকে নিয়োগ দেয়। তারা আপিল করলে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা স্থগিত করেন এবং শুনানির দিন ধার্য করেন ২৮ অক্টোবর (২০২৪)। ফলি হোয়াগ এলএলপি বিষয়টি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতার আবেদন জানায় বিচারকের কাছে এবং বিচারক তা গ্রহণ করেন। এভাবেই অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর ওই যাত্রায় রক্ষা পান।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ৩০ জুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটা শেষ হয়েছে। তবে পিডিবির ভুল ছিল অনেক বড়।’

বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।নিষ্পত্তির পথ খুলল যেভাবে

মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায়কে ভিত্তি ধরে দেশে তখন গুরুত্বের সঙ্গে কাজ শুরু করেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর এ বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

এরপর স্মিথ কো-জেনারেশনের মধ্যস্থতাকারী, বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির কর্মকর্তা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান অনলাইনে ৫টি বৈঠক করেন। শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, জব্দ করা ব্যাংক নিশ্চয়তার ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হোক। বিপরীতে স্মিথ কো-জেনারেশন দাবি করে ৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। আরও দাবি করে, মামলার খরচ বাবদ আরও ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার তাদের দিতে হবে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রস্তাবে কোম্পানিটিকে বলা হয়, ১৫ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান আইনের আওতায় বিদ্যুৎ খাতে তাদের বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। এতেও রাজি হয়নি স্মিথ কো–জেনারেশন। বাংলাদেশ পরে ১ কোটি ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়। স্মিথ কো-জেনারেশন তখন নতুন প্রস্তাব দেয়। সেটি হলো, এককালীন ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। অথবা ২ কোটি ৪০ লাখ ডলার ও দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে তারা মেনে নেবে।

বিষয়টি নিয়ে মধ্যস্ততায় থাকা বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে গত ২৬ মে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অবশ্য অর্থ বিভাগ ও পিডিবি সূত্র জানায়, পরে স্মিথ কো-জেনারেশন ২ কোটি ডলারে রাজি হয়। বাংলাদেশ সরকারও সিদ্ধান্ত নেয়, এই পরিমাণ অর্থ ওই কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে আগেই সম্মতি দিয়ে রেখেছিলেন (গত ১৮ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা। গত ২৮ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, ২ কোটি ডলারের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হোয়াগকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ডলার দিতে হয়েছে।

ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ‘দেশের বদনাম হলো’

১৯৯৬-৯৯ সময়ে পিডিবির চেয়ারম্যান ছিলেন নুরউদ্দিন মাহমুদ কামাল, তিনি ২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বর মারা যান। ১৯৯৯-০০ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক সচিব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক, যিনি মারা যান ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ২০০০-০২ সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ মালেক, যিনি মারা যান ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে আইসিসি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে অংশ নিলে বাংলাদেশেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি তারা (যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি) পারেনি। অথচ আজ বড় অঙ্কের জরিমানা তো গুনতে হচ্ছেই, মাঝখানে বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হলো এবং দেশের বদনাম হলো।’

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ জীবিত থাকলে শাস্তি দিতে হবে। এমনকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবিরও শাস্তি পাওয়া উচিত। অর্থ বিভাগের পরামর্শ মেনে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত করা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ