অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল বুধবার চার দিনের সফরে চীন গেছেন। এর আগে গত মঙ্গলবার তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যের কথা বলেছেন। আর এ লক্ষ্যে অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) সদস্য হিসেবে যোগদান করার বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহের কথাও জানিয়েছেন।

মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘এ বছরের শুরু থেকে মালয়েশিয়া আসিয়ানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাদের আবেদনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এবং আমাকে মালয়েশিয়া সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি।’

আসিয়ানের সদস্যদেশগুলোর কূটনীতিকেরা গত সপ্তাহে ঢাকায় আসেন। ২০ মার্চ তাঁরা পরিদর্শন করেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (আইসিসিবি) কার্যালয়। এ সময় বাংলাদেশকে আসিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব এগিয়ে নিতে তাঁদের অনুরোধ জানান আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান। আইসিসিবি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বাণিজ্য–ঘাটতি কমিয়ে আনতে আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার বিষয়েও তাগিদ অনুভব করে সংগঠনটি।

আসিয়ানের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মূলত আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২–২৩ অর্থবছরে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো থেকে মোট ১ হাজার ১৩৫ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে দেশগুলোয় পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ৭৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ২১১ কোটি ডলারে।

আসিয়ান কী, কবে গঠিত

আসিয়ান হচ্ছে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার জাতি সংস্থা, ইংরেজিতে যাকে অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) বলা হয়। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সবচেয়ে শক্তিশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা হিসেবে এটি বিবেচিত। ১৯৬৭ সালের ৮ আগস্ট থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর পরস্পরের স্বার্থ সংরক্ষণে এই সংস্থা গঠন করা হয়। তখন দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এবং শান্তি ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংস্থাটি গঠনের কথা বলা হয়। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় আসিয়ানের সদর দপ্তর।

আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন বছরে একবার ইংরেজি বর্ণমালা ক্রমানুসারে সদস্যরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হয়। তবে প্রতি তিন বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয় শীর্ষ সম্মেলন।

আসিয়ান গঠিত হওয়ার আগে ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড মিলে ১৯৬১ সালে গঠন করেছিল দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া অ্যাসোসিয়েশন (এএসএ)। আসিয়ানকে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেওয়া হয়।

আসিয়ানের সদস্য কারা

আসিয়ানের মোট সদস্য এখন ১০। যদিও শুরুতে এটি ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড—এই পাঁচ দেশ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। পরে আরও পাঁচ দেশ অর্থাৎ ব্রুনেই, ভিয়েতনাম, লাওস, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া আসিয়ানের সদস্য হয়।

ষষ্ঠ দেশ হিসেবে ব্রুনেই সদস্য হয় ১৯৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি। এরপর ১৯৯৫ সালের ২৮ জুলাই সপ্তম সদস্য হয় ভিয়েতনাম। লাওস ও মিয়ানমার সদস্য হয় ১৯৯৭ সালের ২৩ জুলাই। একই দিন কম্বোডিয়ারও সদস্য হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না থাকায় তা পিছিয়ে যায়। কম্বোডিয়া শেষ পর্যন্ত সদস্যপদ পায় ১৯৯৯ সালের ৩০ এপ্রিল। পূর্ব তিমুর আসিয়ানের সদস্য হতে ২০১১ সালের মার্চে আবেদন করে। দেশটিকে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দিয়েছে আসিয়ান।

চলতি পঞ্জিকা বছরে পূর্ব তিমুর সদস্যপদ পেতে পারে। একসময় পাপুয়া নিউগিনি বিশেষ পর্যবেক্ষক ছিল। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশ আসিয়ানে যুক্ত হওয়ার পথে রয়েছে বলে জানা গেছে।

আসিয়ানের অর্থনীতির আকার

আসিয়ানের সদস্যদেশগুলোর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ চার ট্রিলিয়ন বা চার লাখ কোটি মার্কিন ডলারের মতো। এক ট্রিলিয়ন সমান এক লাখ কোটি। বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৪৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।

আসিয়ানকে একক সত্তা ধরা হলে এটি হবে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। অন্য বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জার্মানি। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মিলিত ভূখণ্ড ৪৪ দশমিক ৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। এ আয়তন বিশ্বের মোট আয়তনের ৩ শতাংশ এবং দেশগুলোর মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি।

আসিয়ানের সঙ্গে ৫ দেশের চুক্তি

২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাণিজ্যে ৮ শতাংশ অবদান আসিয়ানের সদস্যদের। দেশগুলো বিশ্বের মোট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ১৭ শতাংশ আকর্ষণ করে। ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব (আরসিইপি) চুক্তি করে। ২০১২ সালে প্রথম এ চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তারপর আট বছর ধরে চীনের প্রবল উৎসাহ ও উদ্যোগে ২০২০ সালের নভেম্বরে এটি বাস্তবে রূপান্তরিত হয়।

এ চুক্তির ফলে ২০ বছরের মধ্যে জোটভুক্ত দেশগুলোকে একে একে অধিকাংশ আমদানি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নিতে হবে। বাংলাদেশ অবশ্য এ চুক্তির বাইরে এখনো। বাংলাদেশ আরসিইপিতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করলেও শেখ হাসিনা সরকার শেষমেশ তাতে যোগ দেয়নি। ইউনূস সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে নতুন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়েছে।

বাংলাদেশের কী লাভ হবে

বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই আসিয়ানের সদস্য হতে আগ্রহ জানিয়ে আসছে। ২০২৪ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত হেরু হরতান্তো সুবোলো প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, ইন্দোনেশিয়া আমাদের আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে সাহায্য করবে।’

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনের ফাঁকে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও এ বিষয়ে সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। ডাভোসের ওই বৈঠকের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বরাত দিয়ে তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছিলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ আসিয়ানের সদস্য হতে চায়। আসিয়ানের সদস্য হওয়া মানে, বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন হওয়া। এতে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়বে, বাজারও উন্মুক্ত হবে।’ প্রেস সচিব আরও বলেছিলেন, আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়া গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এর চেয়ে বড় সুখবর আর হতে পারে না।

অনেকে মনে করেন, আসিয়ানের সদস্য হতে পারলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশের ভারতনির্ভরতা কমবে। আসিয়ানের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যথাযথভাবে আবেদনই করতে পারেনি। এ ছাড়া বাংলাদেশের আসিয়ানে যুক্ত হওয়া নিয়ে মিয়ানমারের অপ্রকাশ্য বিরোধিতা রয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সদস যপদ প ইন দ ন শ য় সদস য হয় হওয় র ইউন স বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক

অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।

বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক। 

আরো পড়ুন:

রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী

‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত

সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের  প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।

জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে  বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।

লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ