বাংলাদেশের সম্পদ, বাংলাদেশের সম্ভাবনা
Published: 28th, March 2025 GMT
এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে একটি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার ভৌগোলিক আয়তন নয়, তার অর্থসম্পদ বা প্রাকৃতিক সম্পদ নয়; সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ—তাদের সৃষ্টিশীলতা, তাদের সৃজনশীলতা এবং তাদের কর্মকুশলতা।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্রম ও উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ সন্দেহ নেই; কিন্তু শুদ্ধ শ্রমশক্তি বা যেনতেন প্রকারের উদ্যোগ কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিময় করতে পারে না। তার জন্য দরকার সৃষ্টিশীল শ্রমশক্তি এবং উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন উদ্যোগ। অন্য কথায়, শুদ্ধ শ্রমশক্তিকে মানবসম্পদ হতে হবে এবং উদ্যোগকে হতে হবে সৃজনশীল। এ কথা বাংলাদেশের মতো একটি প্রাকৃতিক সম্পদ-অপ্রতুল ও জনবহুল দেশের ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রযোজ্য।
কী কী পন্থায় একটি দেশের মানবসম্পদ সে দেশের উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে পারে?
মূলত তিনটি উপায়ে—এক.
দুই. উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির প্রভাব ও অবদান অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। কিন্তু যথার্থ মানবসম্পদ অনুপস্থিত থাকলে দেয় প্রযুক্তিকে সেই প্রক্রিয়ায় যথাযথভাবে ব্যবহার করা যাবে না। বিষয়টি বর্তমান বিশ্বের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আজকের বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের ফলে সক্ষম ও প্রয়োজনীয় মানবসম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, যথাযথ মানবসম্পদের ঘাটতি থাকলে তথ্যপ্রযুক্তি-বিপ্লবের পুরো সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাবে না।
তিন. মানবসভ্যতার উত্তরণে মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি, সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। একটি দেশের শ্রমশক্তি যখন এসব গুণ অর্জন করে, তখন সেটি শক্তিশালী মানবসম্পদে রূপান্তরিত হয়।
একটি দেশের জাতীয় আয়ে শ্রমসম্পৃক্ত আয় ও পুঁজিসম্পৃক্ত আয়ের অংশ থাকে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় শ্রমসম্পৃক্ত আয়ের অংশ বেশি থাকে। কারণ, সেসব দেশের শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা বেশি। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে মোট জাতীয় আয়ে শ্রমশক্তিসম্পৃক্ত আয় ৬২ শতাংশ।
অন্যদিকে মেক্সিকোর মতো উন্নয়নশীল দেশে জাতীয় আয়ে শ্রম ৩৫ শতাংশ। এর কারণ, মেক্সিকোর মতো দেশে শ্রমের উৎপাদনশীলতা কম। অন্যদিক থেকে দেখলে, উন্নত বিশ্বে শ্রমশক্তি মানবসম্পদে পরিণত হয়েছে, কিন্তু অনুন্নত বিশ্বে শ্রমশক্তি এখনো পরিপূর্ণ মানবসম্পদ হয়ে উঠতে পারেনি। উন্নত বিশ্বে যেহেতু মানবসম্পদের সক্ষমতা বেশি, এ কারণে তাদের মানবসম্পদ দেয় প্রযুক্তিকে ঠিকভাবে ব্যবহার করে দেশের অগ্রগতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব কর্মজগৎকেও পরিবর্তিত করেছে। এর ফলে নতুনতর ও ভিন্নতর মানবসম্পদের প্রয়োজন পড়েছে। আজকের বৈশ্বিক বাণিজ্যে জ্ঞানসম্পৃক্ত পণ্য বাণিজ্যের অংশ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।
পুঁজিঘন বা শ্রমঘন পণ্যের বাণিজ্যের তুলনায় জ্ঞানসম্পৃক্ত বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধিহার ১ দশমিক ৩ গুণ বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে জ্ঞানসম্পৃক্ত পণ্য বাণিজ্য বিশ্বের মোট পণ্য বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ। সুতরাং যাদের আজকের প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার মতো সম্পদ ও দক্ষতা আছে, তারাই বর্তমান তথ্য ও সংখ্যাসম্পৃক্ত অর্থনীতিতে দ্রুত উন্নতি করছে।
বিশ্বে ২০২২ সাল নাগাদ স্বয়ংক্রিয়করণ এবং নতুন প্রযুক্তির কারণে সাত কোটি কর্মনিয়োজন হ্রাস পেয়েছে। অনুমিত হয়েছিল যে একই সময়ে উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন কাজের ক্ষেত্রে ১৩ কোটি নতুন কর্মনিয়োজন সৃষ্টি হয়েছিল। নতুন যেসব কাজের জন্য বেশি চাহিদা লক্ষ করা গেছে, তার মধ্যে আছে উপাত্তবিজ্ঞানী ও বিশ্লেষক; ই-বাণিজ্য ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষজ্ঞ; প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনী ব্যবস্থাপক; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ। সন্দেহ নেই যে আগামী পৃথিবীর কর্মজগতে নতুন এক প্রকৃতির মানবসম্পদ প্রয়োজন হবে।
এ পটভূমি সামনে রেখে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। পরিশীলিত করছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠ্যসূচি, শিক্ষণপদ্ধতি। জোর দিচ্ছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও চিকিৎসাবিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে, ইংরেজিতে যাকে বলা হচ্ছে ‘এসটিইএম’ (সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিন)।
চীনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাঁরা সনদ নিয়ে বের হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে এ বলয়ের স্নাতক ৪০ শতাংশ। ভারতে এই পরিমাণ ৩০ শতাংশ। আজকের দিনে মানবসম্পদ গড়ে তোলার ব্যাপারে পাঁচটি দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এগুলোকে পাঁচটি ‘সি’ বলা চলে—কগনিটিভ স্কিল, কানেকটিভিটি, কমিউনিকেশন, কোলাবোরেশন ও কো–অর্ডিনেশন।
বলা বাহুল্য, আগামী দিনের কর্মজগৎ ও তার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে এই চালচিত্র বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চালচিত্রটি কেমন?
গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ‘বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে’ (গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স) ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ছিল ১১৩তম। একই বছরে ‘বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে’ (গ্লোবাল ইনফরমেশন ইনডেক্স) ১৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ছিল ১০৬তম। মনে হয় না যে জ্ঞানভিত্তিক ও উদ্ভাবনকেন্দ্রিক আগামী বিশ্বের জন্য বাংলাদেশ নিজেকে তৈরি করছে।
বাংলাদেশে যে পাঁচটি দক্ষতার চাহিদা সবচেয়ে বেশি, সেগুলো হচ্ছে দলকর্ম ও নেতৃত্বের দক্ষতা (৯৩ শতাংশ), বিশ্লেষণী ক্ষমতা (৮৯ শতাংশ), প্রযুক্তিগত সাক্ষরতা (৮১ শতাংশ), মননশীল চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা (৭০ শতাংশ) এবং সৃষ্টিশীল চিন্তার সক্ষমতা (৬৩ শতাংশ)। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত জোগান কি এসব চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ?
আজকের বাংলাদেশে তরুণ শ্রমশক্তির পরিমাণ হচ্ছে ২ কোটি ৭০ লাখ, যা দেশের মোট শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশ। মোটামুটি ২০ লাখ তরুণ বেকার, যাঁরা দেশের মোট বেকারের ৭৯ শতাংশ। মোট ৮০ লাখ তরুণ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মনিয়োজন বলয়ের বাইরে স্থিত, যা দেশের সম্ভাবনার এক বিরাট ক্ষতি।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার বর্ধমান; ২০১৩ সালে তা ছিল ২ দশমিক ৫ লাখ। ২০২৩ সালে সে সংখ্যা তিন গুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ৯ লাখ। শিক্ষার স্তরের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি—১৩ শতাংশ।
ভবিষ্যৎ দিনগুলোয় বাংলাদেশের তরুণসমাজকে শুধু দেশে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করলে চলবে না, তাদের বিশ্বের অন্যান্য তরুণসমাজের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হবে। সে লক্ষ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন:
প্রথমত, বাংলাদেশে বর্তমানে কোথায় কোথায় দক্ষতা বিদ্যমান, তার প্রকৃতি কী এবং সেই সঙ্গে কোথায় কোথায় দক্ষতার ঘাটতি, সেগুলোর প্রকৃতি কী রকম—এসব পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা।
এই প্রতিবেদন তৈরির সময় দেশজ উদ্যোক্তাদের মানবসম্পদ চাহিদা কী রকম, তা মাথায় রাখা প্রয়োজন। এসব বিষয়কে সমন্বিত করে বাংলাদেশের জন্য একটি মানবসম্পদ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা দরকার। দেখতে হবে, এই পরিকল্পনা দেশের সার্বিক ও সামগ্রিক পরিকল্পনার সঙ্গে যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
দ্বিতীয়ত, দেশের বাইরের কাজের জগতে কী কী কাজের সুযোগ আগামী দিনগুলোয় তৈরি হতে পারে, তার একটি নিরীক্ষামূলক অবেক্ষণ প্রস্তুত করা। এ প্রসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের আপাতনকে মনে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সেসব কর্মসুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কী ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন হবে, তা চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, দেশের শিক্ষাকাঠামোর শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠ্যসূচি, শিখনপদ্ধতির একটি সমীক্ষা প্রস্তুত করা দরকার। সে সমীক্ষার লক্ষ্য হবে দেশের শিক্ষাকাঠামো উপরিউক্ত মানবসম্পদ পরিকল্পনার কোন কোন ক্ষেত্রে শ্রমচাহিদা মেটাতে অক্ষম, তা নির্ণয় করা। সে চালচিত্রের আলোকে পুরো শিক্ষাকাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে। সে কাঠামোয় তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পর্কিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হবে।
এটি প্রণয়নে একদিকে যেমন বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের দিকে নজর রাখতে হবে, তেমনি অন্যদিকে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা ও অর্জন সামনে রেখে সেখান থেকেও শিক্ষণীয় বিষয়গুলো শিক্ষাকাঠামোতে প্রবিষ্ট করাতে হবে।
চতুর্থত, মানবসম্পদ উন্নয়নকে কার্যকর করতে শিক্ষালব্ধ জ্ঞান ও দক্ষতাকে আধুনিক, সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিরন্তরভাবে করা প্রয়োজন। এ জাতীয় প্রশিক্ষণ দেশের শ্রমশক্তিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি সেটা দরকার শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদেরও। প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও পন্থা ও উপকরণ দ্রুত বদলাচ্ছে। তাই এ ক্ষেত্রেও বহির্বিশ্বের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
পঞ্চমত, দক্ষতা উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর মধ্যে থাকতে পারে শিল্প ও বিদ্যায়তনের সহযোগিতাকে পুষ্ট করা, চাকরিরত অবস্থায়ই পরামর্শকের সেবা, সংস্থার মধ্যেই ব্যয়সাধ্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, দক্ষতাভিত্তিক প্রণোদনা দান, ভাষা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা, সরকারি দক্ষতা উন্নয়নের নানা কর্মসূচির সুযোগ গ্রহণ করা, স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা ও প্রশিক্ষণদাতাদের সঙ্গে মিলিতভাবে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা ইত্যাদি।
ষষ্ঠত, মানবসম্পদ উন্নয়নের উপর্যুক্ত কাঠামোর নিয়মিত পরিবীক্ষণ, নিবিড় নিরীক্ষণ ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের প্রয়োজন। এই সবকিছুর ভিত্তিতে সময় থেকে সময়ান্তরে সেই মানবসম্পদ-কাঠামোর পর্যালোচনা করা দরকার। সে পর্যালোচনার আলোকে সেই কাঠামোর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিশীলন দরকার হতে পারে।
সপ্তমত, গত সিকি শতাব্দীতে বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেট জাতীয় আয়ের ২ শতাংশের নিচে ছিল এবং এ বছর তা এসে ঠেকেছে ১ দশমিক ৭ শতাংশে। একইভাবে দেশের স্বাস্থ্য বাজেট গত ২৫ বছরে জাতীয় আয়ের ১ শতাংশের কম ছিল। এর বিপরীতে ভারত তার জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে এবং ৪ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে। ভিয়েতনামে সংশ্লিষ্ট সংখ্যা দুটি যথাক্রমে ৪ ও ৫ শতাংশ। বাংলাদেশের উচিত তার জাতীয় আয়ের ৪ থেকে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা এবং স্বাস্থ্য খাতে এ ব্যয়ের অনুপাত হওয়া উচিত ৬ শতাংশ।
পৃথিবী বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে সমাজ ও মানুষ, তাদের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা। বদলে যাচ্ছে মানবসম্পদের চাহিদা ও জোগান। এই পরিবর্তিত সময়ে বাংলাদেশ যেন তার এক ও অনন্য সম্পদ মানবসম্পদের যথার্থ ব্যবহার করতে পারে। এটি আমাদের উন্নতি ও অগ্রযাত্রার অন্যতম চাবিকাঠি।
সেলিম জাহান জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের ভূতপূর্ব পরিচালক।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর জ ত য় আয় র শ রমশক ত ব যবস থ পর প র র জন য আজক র র উৎপ সবচ য় দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে
দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।
বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’
কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি।
এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’।
বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে।
দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়।
মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন।
বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।
শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ
রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে।
প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে।