‘আমি প্রত্যহই পুণ্যবান/ অভিনয়ের সে-সূর্য ঝলকে—/ এই বৃদ্ধ বয়সের শ্রদ্ধাই/ ভরে রাখছি কবিতার স্তবকে.../ আমার কাছে অভিনেতাই আজ/ সাক্ষাৎ ঈশ্বর—/ বাংলাদেশের মাটিতে রেখে দিলাম/ মোশাররফের জন্য আমার প্রণাম দিয়ে গড়া/ ছোট্ট চালাঘর!’ মোশাররফ করিমের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে কবিতায় এই নিবেদন কবি জয় গোস্বামীর।  
না, নায়কোচিত চেহারা, নির্দিষ্ট শারীরিক গঠনের মতো বাহ্যিক যে তকমাগুলো দিয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গন মুখর, তা অনেকের নেই, থাকে না। তারপরও তকমাগুলোকে থোড়াই কেয়ার করে শুধু অভিনয় দক্ষতা দিয়েই চলচ্চিত্র শিল্পে ফুল ফুটিয়েছেন এমন অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। মোশাররফ করিমও তাঁদের একজন। নিজের দারুণ অভিনয়নৈপুণ্য দিয়েই তিনি হাসিল করেছেন অজস্র দর্শকের প্রিয় অভিনেতার আসন; সেরার খেতাব। সে হোক মহল্লার বড় ভাই, বন্ধুর ভাই, পকেটমার, আদর্শ প্রেমিক কিংবা বাসে চড়ে লোক ঠকানো বাটপারের চরিত্র, প্রতিটি চরিত্রেই সফল অভিনয় করেছেন তিনি। চরিত্রের সঙ্গে মিশে গেছেন ওতপ্রোতভাবে। মোশাররফ করিম হাস্যরসাত্মক চরিত্রে বৃষ্টির মতো যেমন সহজ হয়েছেন। তেমনি মুখভার করে গম্ভীর চরিত্রে হয়েছেন বিদ্যুতের ঝলকানির মতো কঠিন।    
‘অতিথি’ নাটকের মধ্য দিয়ে টেলিভিশনে অভিষেক হয় মোশাররফ করিমের। তারপর ধাপে ধাপে নাটক থেকে টেলিফিল্ম, সিনেমা আলো ছড়িয়ে চলেছেন এই অভিনেতা। ‘হাড়কিপটে’ ধারাবাহিকের গোল্লা, ‘ভবের হাট’-এর ভাসান খাঁ, ‘সাকিন সারিসুরি’র রুইতনের মতো চরিত্রগুলোতে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

বড় পর্দায় ‘জয়যাত্রা’ সিনেমা দিয়ে তাঁর অভিষেক হয়। ২০০৪ সালে। সিনেমাটি পরিচালনা করেন তৌকীর আহমেদ। তারপর ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘প্রজাপতি’, ‘টেলিভিশন’,  ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘হালদা’সহ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। বড় পর্দার পাশাপাশি ওটিটিতেও তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে ওসি হারুন চরিত্রে অভিনয় করে পৌঁছে গেছেন দর্শকের মণিকোঠায়। ‘আধুনিক বাংলা হোটেলে’ও তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শক।

‘চক্কর ৩০২’ সিনেমার পোস্টারে মোশাররফ করিম.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে

সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।

এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’

আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ