অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ব্যাংককে শুক্রবার অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটিকে আমরা ইতিবাচক বলিয়া মনে করি। বিশেষত দক্ষিণ এশীয় ভ্রাতৃত্ববোধ গড়িয়া তুলিবার ক্ষেত্রে ইহা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বিবেচিত হইতে পারে। প্রথমত, বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহের জোট বিমসটেকের ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে এই বৈঠক এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হইল, যখন বিশেষ কিছু কারণে–যাহার জন্য কোনো দেশই এককভাবে দায়ী নহে–দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্ক প্রায় তলানিতে ঠেকিয়াছিল। অথচ দুই দেশেরই শীর্ষ নেতারা মনে করিয়া থাকেন, ভারত ও বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবে নহে, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনেও আবদ্ধ। অতএব, শুক্রবারের বৈঠক দুই দেশের সম্পর্কে জমাটবদ্ধ বরফ গলাইতে সহযোগিতা করিতে পারে। দ্বিতীয়ত, বহু বৎসর যাবৎ ধরিয়া দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতা চ্যালেঞ্জের মুখে রহিয়াছে। বিশেষ করিয়া ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ অনেক সম্ভাবনা লইয়া গঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট–সার্ক কার্যত নিষ্ক্রিয় হইয়া রহিয়াছে। ড.

ইউনূস সম্প্রতি সার্ককে সক্রিয় করিবার প্রয়াস শুরু করিয়াছেন, যেই ক্ষেত্রে শুক্রবারের বৈঠকটি অবদান রাখিতে পারে। ইতোমধ্যে আমরা জানিয়াছি, বাংলাদেশের পক্ষ হইতে জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, গঙ্গা চুক্তির নবায়ন, তিস্তাসহ আন্তঃসীমান্ত নদীসমূহের পানি ন্যায়সংগতভাবে বণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলি ভারতের শীর্ষ নেতার সমক্ষে উপস্থাপন করা হইয়াছে। অন্যদিকে ভারতের পক্ষ হইতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক উত্তরণ, সংখ্যালঘু নির্যাতনের যথাযথ তদন্ত ও বিচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করা হইয়াছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হইতে পারে, পরস্পরের নিকট স্বীয় ফর্দ তুলিয়া ধরিবার মধ্য দিয়াই বৈঠকটি সমাপ্ত হইয়াছে। তবে ইহাকে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনার সূত্রপাত হিসেবেও বর্ণনা করা যায়। স্মরণে রাখিতে হইবে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এই প্রথম ড. ইউনূসের সহিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক হইল। উভয় পক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকিলে এই সম্পর্ক আগামী দিনসমূহে আরও গভীর হইবে।

জন্মলগ্ন হইতে বাংলাদেশ সকলের সহিত বন্ধুত্ব কাহারও সহিত শত্রুতা নহে– এই পররাষ্ট্রনীতি লইয়া চলিয়াছে। আমরা দেখিয়াছি, রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হইলেও বাংলাদেশের বিগত প্রায় সকল সরকারই এই নীতি মানিয়া চলিয়াছে। সম্ভবত বাংলাদেশের এই নীতির কারণে সার্কের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ঢাকাকে বাছিয়া লওয়া হইয়াছিল। এই নীতির সুফল হিসেবে ইতোপূর্বে বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সহিত দীর্ঘদিন ধরিয়া বিরাজমান সমুদ্রসীমা, ভৌগোলিক সীমারেখার ন্যায় একাধিক জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভবপর হইয়াছে। আমরা বিশ্বাস করি, মিয়ানমারের সহিত রোহিঙ্গা সমস্যা এবং ভারতের সহিত আন্তঃনদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যাসহ যেই সকল সমস্যা রহিয়া গিয়াছে সেইগুলিও ওই একই প্রক্রিয়ায় নিরসণ করা যাইবে। তবে ইহা সত্য, এই অঞ্চলের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আচরণ প্রায়শই প্রতিবেশীদের জন্য অস্বস্তির কারণ হইয়া দাঁড়ায়, যাহা হইতে দেশটিকে বাহির হইতে হইবে। সেই বহুলশ্রুত প্রবাদ বাক্যটি কে না জানে যে, এক হাতে যদ্রূপ তালি বাজে না, তদ্রূপ বন্ধুত্বও একতরফা হয় না। উভয়ের আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা এই ক্ষেত্রে জরুরি। বাংলাদেশ বা ভারত কেহই ইচ্ছা করিলে পরস্পরকে প্রতিবেশীর তালিকা হইতে বাদ দিতে পারিবে না। জাতীয় নিরাপত্তার সুরক্ষা নিশ্চিত করিবার জন্য উভয়ের নিকট উভয়ে অপরিহার্য। তদুপরি, ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারত যদ্রূপ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অমিত সম্ভাবনা উন্মোচিত করিতে পারে তদ্রূপ অন্তত তার উত্তর-পূর্ব অঞ্চল তথা সাত বোন বলিয়া খ্যাত রাজ্যসমূহের উন্নয়নে বাংলাদেশ অতুলনীয় ভূমিকা পালন করিতে পারে। বৈশ্বিক কূটনীতিতেও দুই দেশের মিত্রতা উভয়কে বিশেষ সুবিধা দিতে পারে।  
এই সকল বিষয় বিবেচনায় রাখিয়া দ্বিপক্ষীয় আস্থার ভিত্তি নির্মাণে উভয় দেশের নেতৃত্ব সচেষ্ট থাকিবে বলিয়া আমরা প্রত্যাশা করি।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য র সহ ত সমস য হইয় ছ

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।

সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।

জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’

ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।

জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।

জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ