দ্বিপক্ষীয় আস্থা পুনর্নির্মাণের সূচনা
Published: 5th, April 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ব্যাংককে শুক্রবার অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটিকে আমরা ইতিবাচক বলিয়া মনে করি। বিশেষত দক্ষিণ এশীয় ভ্রাতৃত্ববোধ গড়িয়া তুলিবার ক্ষেত্রে ইহা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বিবেচিত হইতে পারে। প্রথমত, বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহের জোট বিমসটেকের ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে এই বৈঠক এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হইল, যখন বিশেষ কিছু কারণে–যাহার জন্য কোনো দেশই এককভাবে দায়ী নহে–দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্ক প্রায় তলানিতে ঠেকিয়াছিল। অথচ দুই দেশেরই শীর্ষ নেতারা মনে করিয়া থাকেন, ভারত ও বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবে নহে, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনেও আবদ্ধ। অতএব, শুক্রবারের বৈঠক দুই দেশের সম্পর্কে জমাটবদ্ধ বরফ গলাইতে সহযোগিতা করিতে পারে। দ্বিতীয়ত, বহু বৎসর যাবৎ ধরিয়া দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতা চ্যালেঞ্জের মুখে রহিয়াছে। বিশেষ করিয়া ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ অনেক সম্ভাবনা লইয়া গঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট–সার্ক কার্যত নিষ্ক্রিয় হইয়া রহিয়াছে। ড.
জন্মলগ্ন হইতে বাংলাদেশ সকলের সহিত বন্ধুত্ব কাহারও সহিত শত্রুতা নহে– এই পররাষ্ট্রনীতি লইয়া চলিয়াছে। আমরা দেখিয়াছি, রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হইলেও বাংলাদেশের বিগত প্রায় সকল সরকারই এই নীতি মানিয়া চলিয়াছে। সম্ভবত বাংলাদেশের এই নীতির কারণে সার্কের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ঢাকাকে বাছিয়া লওয়া হইয়াছিল। এই নীতির সুফল হিসেবে ইতোপূর্বে বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সহিত দীর্ঘদিন ধরিয়া বিরাজমান সমুদ্রসীমা, ভৌগোলিক সীমারেখার ন্যায় একাধিক জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভবপর হইয়াছে। আমরা বিশ্বাস করি, মিয়ানমারের সহিত রোহিঙ্গা সমস্যা এবং ভারতের সহিত আন্তঃনদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যাসহ যেই সকল সমস্যা রহিয়া গিয়াছে সেইগুলিও ওই একই প্রক্রিয়ায় নিরসণ করা যাইবে। তবে ইহা সত্য, এই অঞ্চলের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আচরণ প্রায়শই প্রতিবেশীদের জন্য অস্বস্তির কারণ হইয়া দাঁড়ায়, যাহা হইতে দেশটিকে বাহির হইতে হইবে। সেই বহুলশ্রুত প্রবাদ বাক্যটি কে না জানে যে, এক হাতে যদ্রূপ তালি বাজে না, তদ্রূপ বন্ধুত্বও একতরফা হয় না। উভয়ের আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা এই ক্ষেত্রে জরুরি। বাংলাদেশ বা ভারত কেহই ইচ্ছা করিলে পরস্পরকে প্রতিবেশীর তালিকা হইতে বাদ দিতে পারিবে না। জাতীয় নিরাপত্তার সুরক্ষা নিশ্চিত করিবার জন্য উভয়ের নিকট উভয়ে অপরিহার্য। তদুপরি, ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারত যদ্রূপ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অমিত সম্ভাবনা উন্মোচিত করিতে পারে তদ্রূপ অন্তত তার উত্তর-পূর্ব অঞ্চল তথা সাত বোন বলিয়া খ্যাত রাজ্যসমূহের উন্নয়নে বাংলাদেশ অতুলনীয় ভূমিকা পালন করিতে পারে। বৈশ্বিক কূটনীতিতেও দুই দেশের মিত্রতা উভয়কে বিশেষ সুবিধা দিতে পারে।
এই সকল বিষয় বিবেচনায় রাখিয়া দ্বিপক্ষীয় আস্থার ভিত্তি নির্মাণে উভয় দেশের নেতৃত্ব সচেষ্ট থাকিবে বলিয়া আমরা প্রত্যাশা করি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য র সহ ত সমস য হইয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।