Samakal:
2025-04-30@22:53:45 GMT

কুমির-বাঘে ভয় নেই যত ভয় ডাকাতে

Published: 5th, April 2025 GMT

কুমির-বাঘে ভয় নেই যত ভয় ডাকাতে

‘চাকে মধু নেই। যা হয় দুই-এট্টা পাচ্ছি, তাতেও মধু কম। শেষ পর্যন্ত এভাবে গিলি এবার চালান তোলা মুসিবত হয়ে দাঁড়াবে।’ জহুর আলীর কণ্ঠে চরম হতাশা ঝরে পড়ে। ৯ সদস্যের মৌয়াল দলের নেতা সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ডুমুরিয়া গ্রামের এই বাসিন্দা। তিনিসহ অন্য মৌয়ালের সামনে চলতি মৌসুমে দুটি সংকট। প্রথমটি বনদস্যু এবং দ্বিতীয়টি মাছ-কাঁকড়া শিকারের নাম করে বনে যাওয়া ব্যক্তিদের আগেই চাক কেটে ফেলা।
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য গত ১ এপ্রিল থেকে অনুমতি দেওয়া শুরু করেছে বন বিভাগ। কিন্তু এ মৌসুমে মৌয়ালদের মধ্যে আগ্রহ কমেছে। তাই গতকাল শনিবার পর্যন্ত শুরুতে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫৮টি। অথচ গত বছর এই দুই রেঞ্জ থেকে ৫২০টি অনুমতিপত্র নেন মৌয়ালরা। তাদের ভাষ্য, সুন্দরবনে নতুন করে দস্যুবৃত্তি শুরু হওয়ায় এমন পরিস্থিতি। কয়েকটি দস্যুদল বনজীবীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করছে। ওই টাকা দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত 
হচ্ছেন মৌয়ালরা। তাই মধু সংগ্রহের আগ্রহ হারিয়েছেন তারা।
জহুর আলী বলছিলেন, ‘কম-বেশি তিরিশ বছর ধরে সুন্দরবনে মধু কাটতিছি, এ রকম অবস্থা আগে কখনও দেখিনি। মহাজনের চালান তুলতি না পারলি এলাকা ছেড়ে পালানো ছাড়া পথ থাকবে না।’ তাঁর ৯ সদস্যের দল একটি পাসের বিপরীতে দুই দফায় সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করবে। সেই অনুযায়ী প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ করে চালান সাজানো হয়েছে। ইতোমধ্যে বনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের নোটাবেকী টহল ফাঁড়ির আওতাধীন ইলশেমারী, খেজুরদানা ও আগুনজ্বালা এলাকায় ছাটা (মাছি তাড়িয়ে মৌচাক পরীক্ষা করা) দিয়েছেন তারা। কিন্তু চার দিনে মাত্র ৫০ কেজির বেশি মধু পেয়েছেন। 
শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের দৃষ্টিনন্দন এলাকার হাকিম গাজী সহযোগীদের নিয়ে বনে যান গত ২ এপ্রিল। গতকাল শনিবার দুপুর পর্যন্ত পুষ্পকাটি এলাকার জলঘাটা, আশাশুনি ও হেতালবুনিয়া অংশ ঘুরে ৪০ কেজির মতো মধু পেয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, আগে থেকেই চাক কেটে রাখা হয়েছে। যে কারণে প্রত্যাশামতো মধু মিলছে না।
হাকিমকে মৌয়ালের মাথাপিছু সাড়ে ৮ হাজার টাকা হারে মোট ৬৮ হাজার টাকা দিতে হয়েছে জলদস্যুদের। নৌকা মেরামতসহ সাঁজালি থেকে শুরু করে খোরাকি ও পাস মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। কাঙ্ক্ষিত মধু না মেলায় এ দলের সবাই হতাশ। 
এ দু’জনের মতোই হতাশার কথা জানান গাবুরা, নীলডুমুর, দাতিনাখালী, মুন্সিগঞ্জ, টেংরাখালী ও কালিঞ্চিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মধু কাটতে যাওয়া মৌয়ালরা। তাদের ভাষ্য, সুন্দরবনে যাওয়ার আগেই দয়াল বাহিনীর জন্য মৌয়ালপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে। এ ছাড়া দুলাভাই বাহিনীকে দিতে হচ্ছে জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা। আবার বনে ঢুকে আগের মতো চাকের দেখাও মিলছে না। কিছু চাক পাওয়া গেলেও কিছুদিন আগেই কেটে 
রাখায় পর্যাপ্ত মধু থাকছে না। মহাজনের কাছ 
থেকে নেওয়া দাদনের টাকা পরিশোধ কীভাবে করবেন, সংসার খরচই তুলবেন কীভাবে– তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। 
খুলনার কয়রা উপজেলার গুড়িয়াবাড়ী গ্রামের মৌয়াল সোহরাব হোসেন বলেন, ‘বাপ-দাদার পেশা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করে আসতিছি। প্রত্যেক বছর মৌসুমের অপেক্ষায় থাকি। বনের সাপ, কুমির ও বাঘের ভয়ে কখনও পিছুপা হইনি। তবে এবার ডাকাতির ভয়ে পিছু হটতি হয়েছে। নতুন ডাকাত দলের চাহিদা অনেক।’ তাদের চাহিদামাফিক টাকা না দিলে অনেক নির্যাতনের তথ্য শোনে এবার আর বাদায় (বন) না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
একই উপজেলার মহেশ্বরীপুর গ্রামের মৌয়াল আব্দুল হাকিমের ভাষ্য, ‘বেশ কয়েক বছর বনে ডাকাতির চাপ ছিল না। নির্বিঘ্নে মোম-মধু কাইটে আনতি পারতাম। এবার শুনতিছি ডাকাতির অনেক চাপ। আবার বনে তেমন মৌচাকও নেই।’ তাই এবার তিনিও বনে যাননি। 
পেশাদার মৌয়ালরা জানিয়েছেন, মৌসুমের শুরুতেই সুন্দরবনে পাওয়া যায় খলিশা ফুলের মধু। এর ২০-২৫ দিন পর মেলে গরান ফুলের মধু। শেষে আসে কেওড়া ও ছইলা ফুলের মধু। এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় ফুল ঝরে গেছে। মৌসুম শুরুর আগেই মাছ শিকারের পাস নিয়ে ছদ্মবেশে মৌচাকে হানা দিয়েছে কিছু দৃর্বৃত্ত। যে কারণে এবার প্রত্যাশামতো মধু পাওয়া নিয়েও শঙ্কিত তারা। 
সম্প্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা জেলে-বাওয়ালিদের দেওয়া তথ্যমতে, এখন সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আসাবুর বাহিনী, শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী, মামা-ভাগনে বাহিনী নামের কয়েকটি বনদস্যু বাহিনী। গত ৫ আগস্টের পর জেল ভেঙে পালিয়ে আসা কয়েদি ও চিহ্নিত আসামিরাও বনে দস্যুতায় নেমেছে। তারা জেলেদের কাছ থেকে মাছ, টাকা, মোবাইল ফোনসহ সব কেড়ে নিচ্ছে। এমনকি বনে ঢুকলে বিপুল অঙ্কের চাঁদাও দাবি করছে, না দিলেই অপহরণের পর ব্যাপক নির্যাতন চালাচ্ছে বনজীবীদের ওপর।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে মৌয়ালদের মধ্যে বনে যেতে আগ্রহ কমেছে। বন বিভাগের তথ্যমতে, মঙ্গলবার মৌসুম শুরুর প্রথম দিন খুলনা রেঞ্জের নলিয়ান ফরেস্ট স্টেশন থেকে ৩টি, বানিয়াখালী স্টেশন থেকে ৯টি, কাশিয়াবাদ স্টেশন থেকে ১৮টি, কোবাদক স্টেশন থেকে ৭টি ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের স্টেশনগুলো থেকে ২১টি অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। শতাধিক মৌয়াল অনুমতিপত্র নিয়ে ঝুঁকি জেনেও 
মধু সংগ্রহে গেছেন বনে। যদিও গতবার মৌসুমের প্রথম দিনেই খুলনা রেঞ্জে ১৬০টি ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশন থেকে ৩৬৪টি অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছিল।
সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দীন এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, এসব কারণেই সুন্দরবনের পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। ফলে রাজস্ব আয় কমছে। বিপরীতে চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। সুন্দরবনের সার্বিক নিরাপত্তা না বাড়ানো হলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মশিউর রহমানের দাবি, মৌসুমের আগেই বন থেকে মধু সংগ্রহ বন্ধে তাদের একাধিক দল তৎপর ছিল। স্বল্প জনবল নিয়ে শুধু বন বিভাগের পক্ষে জলদস্যুদের মোকাবিলা সম্ভব নয়। চলতি মৌসুমে তাদের মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৫০০ কুইন্টাল। এর পরও এই লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে না।
এবার মৌয়ালের সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয় নিশ্চিত করে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, বনদস্যু দমনে তাদের পাশাপাশি কোস্টগার্ড ও পুলিশ সতর্ক রয়েছে। কয়েকটি অভিযানে বনদস্যু গ্রেপ্তার করাও হয়েছে। মৌয়ালদের সুরক্ষায় বন বিভাগ এবার বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ন দরবন স ন দরবন বন ব ভ গ বনদস য

এছাড়াও পড়ুন:

কড়া নজরদারি সুন্দরবন সীমান্তে

দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন জলসীমানা প্রায় দেড়শো কিলোমিটার। ভারতীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এ সীমানা দিয়ে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাড়তি তৎপরতা নেওয়া হচ্ছে। খবর আনন্দবাজারের।

খবরে বলা হয়েছে, নদী ও বনভূমি এলাকায় সীমান্ত বরাবর বিএসএফ মোতায়েন আছে। ভাসমান বর্ডার আউটপোস্ট, বঙ্গোপসাগর অংশে কোস্ট গার্ডের নজরদারি চলছে। ড্রোন, সেন্সর ও ক্যামেরা, কিছু জায়গায় নাইট ভিশন ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি, পুলিশের তরফেও উপকূল এলাকায় দিনরাত নজরদারি চলছে।

উপকূল থানাগুলোর পক্ষ থেকে নদীপথে নিয়মিত টহল দেওয়া হচ্ছে। রাতেও উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে নজর রাখা হচ্ছে। নদীপথে কোনো জলযান দেখলেই তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। মৎস্যজীবীদের পরিচয়পত্রও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নদী বা সমুদ্রে এখন মাছ ধরার উপরে নিষেধাজ্ঞা চলছে। মৎস্যজীবীদের জলযান চলাচল করার কথা নয়। তাই জলযান দেখলেই তল্লাশি চলছে। বাংলাদেশি জাহাজগুলোতেও পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে।

সুন্দরবন পুলিশ জেলার সুপার কোটেশ্বর রাও নালাভাট বলেন, আগেও উপকূলবর্তী এলাকায় পুলিশের নজরদারি চলত। এখন বাড়তি জোর দেওয়া হচ্ছে। দু’বেলা নদী ও স্থলপথে পুলিশের টহল বৃদ্ধি পেয়েছে। নাকা চেকিং হচ্ছে। চলছে তল্লাশিও।

উত্তর ২৪ পরগনাতেও উপকূল এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা বেড়েছে জল ও স্থলসীমান্তে। জল, ভূমি ও আকাশে অত্যাধুনিক ইজ়রাইল রাডারের মাধ্যমে নজরদারি চালাচ্ছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

ইতোমধ্যে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতর জানিয়েছে, বাংলাদেশের আকাশ ব্যবহার করে ভারতকে আক্রমণ করতে পারে সশস্ত্র সংগঠনগুলো। ফলে সুরক্ষা বাড়াতে বিএসএফের তৎপরতা শুরু হয়েছে। বসিরহাট মহকুমার স্বরূপনগর থেকে হিঙ্গলগঞ্জের হেমনগর কোস্টাল থানা পর্যন্ত ৯৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। তার মধ্যে ৫০ কিলোমিটার জলসীমান্ত। স্থলসীমান্ত ৪৪ কিলোমিটার। সীমান্ত সুরক্ষায় অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবনের মধুসহ ২৪ পণ্য পেল জিআই সনদ
  • সুন্দরবনে হরিণ শিকারে যাওয়া ব্যক্তির লাশ উদ্ধার, মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা
  • ‘তোর সময় শেষ’ লেখা চিঠির সঙ্গে কাফনের কাপড় পাঠিয়ে সাংবাদিককে হুমকি
  • কড়া নজরদারি সুন্দরবন সীমান্তে
  • সৌন্দর্যের সন্ধানে সুন্দরবনের গহীনে : দ্বিতীয় পর্ব
  • সুন্দরবনে অস্ত্রসহ বনদস্যু আটক
  • উপকূল রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ধস, প্লাবনের আশঙ্কা সুন্দরবন তীরবর্তী জনপদে