বাঘ নিয়ে কত কথাই না বলা যায়! কত কথাই না মনে আসে! যেমন এত বড় প্রাণীটির জন্ম কোথায়, কোথায় বাস করে, কী খায়, কত দিন বাঁচে, কত প্রজাতি, কোন দেশের বাঘ বেশি হিংস্র, কেনই–বা বাঘকে বাংলাদেশের জাতীয় প্রাণী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় ইত্যাদি।

বাঙালির ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ঐতিহ্যের ধারায় বেঙ্গল টাইগার এমন একটি প্রাণী, যা অহংকার, গর্ব, আনন্দ, ভয় আর সম্মানের প্রতীক। বিশাল আকৃতি, শক্তি, হিংস্রতা, রাজকীয় চলাফেরা আর দাম্ভিক আচার-আচরণের কারণে সারা বিশ্বে এই বাঘের আলাদা খ্যাতি রয়েছে।

বলা হয়, সুন্দরবন রক্ষায় সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত বনরক্ষক থাকলেও এ বনের প্রকৃত পাহারাদার বেঙ্গল টাইগার। জানা যায়, লন্ডনের রয়েল পরিবারের একজন দক্ষ শিকারি সুন্দরবনের বাঘ শিকারে বীরত্বের পরিচয় দেন। সেই থেকেই বাংলার বাঘের ঘাড়ে ‘রয়েল’ শব্দটি চেপে বসে।

বাঘ হলো বিড়াল গোত্রের সবচেয়ে বড় প্রাণী। বাংলাদেশের জাতীয় পশু বাঘ শুধু একটি প্রাণী নয়; বরং শক্তি, সাহস ও সম্মানের প্রতীক। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ ও লেজেন্ডে বাঘের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সুন্দরবনের স্থানীয় জনগণ ও শিকারিরা বাঘকে ‘মামা’ বা ‘বড় মামা’ বলে সম্বোধন করেন। এটা সবার জানা যে মামা-ভাগনের সম্পর্ক সবচেয়ে মধুর, তাই বাঘকে মামা বলে সম্বোধন করলে সে আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না, এই বিশ্বাস ও ভয় পাওয়ার কারণেই মামা বলে ডাকা হয়।

দেশে বীরত্ব ও শক্তির প্রতীক হিসেবে বাঘকে দেখা হয়। এ দেশে কেউ কোনো সাহসী ভূমিকা রাখলে তাকে বাঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়। যেমন বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলকে শক্তি, সাহস, উৎসাহ প্রদানের জন্য ‘টাইগার বাহিনী’ নামে ডাকা হয়। আবার দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের লোগো ‘বেঙ্গল টাইগার’।

এ ছাড়া ক্রিকেটকে নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেওয়া ও লেখা হয়। যেমন ‘বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব’, ‘বাঘের গর্জন দেখবে বিশ্ব’, ‘গর্জে ওঠো বিশ্ব’, ‘গর্জনে থাক বিজয়ী অর্জন’, ‘বাঘ দেখে দৌড়ো’ ইত্যাদি।
দেশের বিভিন্ন স্থানের নামে বাঘের প্রভাব চোখে পড়ে। যেমন বাঘমারা, বাঘা বিল, বাঘমারী, বাঘা বাজার, বাঘাবাড়ী, টাইগার পয়েন্ট, রয়্যাল চত্বর ইত্যাদি।

আমাদের সুন্দরবনের অত্যন্ত সমৃদ্ধ প্রাণী বাঘ নিয়ে অনেক গান, কবিতা, প্রবাদ রচিত হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। যেমন প্রভাত কুমারীর কবিতা ‘হালুম হালুম হুম! ভেঙেছে মোর ঘুম। বলো তো কী চাই? হরিণছানা চাই’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা ‘মেঘলা দিনে দুপুরবেলা যেই পড়েছে মনে, চিরকালীন ভালোবাসার বাঘ বেরুলো বনে।’

আবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঘ নিয়ে বেশ কয়েকটি গান ও কবিতা লিখেছেন। এ ছাড়া তিনি শৈশবে তাঁর দাদার সঙ্গে বাঘ শিকারে গিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। জানা যায়, মোগল আমলে বাঘ শিকার করা ছিল আভিজাত্য ও জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সে সময়ে মোগল সম্রাট আকবর শুধু তির-ধনুক নিয়ে শিকারে বের হতেন। তাঁর ছেলে জাহাঙ্গীর সাধারণত হেঁটে শিকারে যেতেন। এ ছাড়া মোগল সম্রাটদের তলোয়ার ও কামানে বাঘের প্রতিরূপ খোদাই লক্ষ করা যায়।

বাংলাদেশ ও ভারতীয় চলচ্চিত্রেও নামকরণে বাঘের প্রভাব চোখে পড়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ‘বাঘের বাচ্চা’, ‘বাংলার বাঘ’, ‘বাঘের থাবা’, ‘বাঘের হুংকার’, ‘বাঘ সিংহের লড়াই’, ‘বাঘবন্দী খেলা’, ‘বাঘে মহিষে লড়াই’, ‘টাইগার: দ্য বস’। এ ছাড়া ‘অপারেশন সুন্দরবন’ সিনেমার প্রচারের জন্য পাপেট বাঘ ব্যবহার করা হয়েছে।

হিন্দি সিনেমা রয়েছে ‘এক থা টাইগার’, ‘দ্য টাইগার’, ‘টাইগার নাম্বার ওয়ান’ ইত্যাদি। বাংলা নাটকের নামেও বাঘের প্রভাব লক্ষণীয়। যেমন ‘বাঘ’, ‘বাইরে বাঘ ঘরে বিড়াল’, ‘বাঘ যখন বিড়াল’, ‘দিনে বাঘ রাতে বিড়াল’, ‘বাঘ বন্দি বিড়াল’, ‘নীল কমলের বাঘ’, ‘বাঘের শিন্নি’, ‘নিজের এলাকায় সবাই বাঘ’, ‘বাঘ না বাঘিনী’ ইত্যাদি।

অনেক প্রবাদ–প্রবচনে বাঘের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যেমন ‘বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা’, ‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’, ‘কাল হয়েছে অকাল, ছাগলে চাটে বাঘের গাল’, ‘আগে গেলে বাঘে খায়/ পরে গেলে সোনা পায়’, ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়’, ‘যে বনে যায়, সেই বাঘ হয়’, ‘যে বনে বাঘ নেই সে বনে শিয়ালই রাজা!’ ইত্যাদি।

এ ছাড়া বিভিন্ন সিনেমায় বাঘের সঙ্গে তুলনা করে গানের উপস্থিতি চোখে পড়ে। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত সিনেমা ‘হীরক রাজার দেশে’ ‘পায়ে পড়ি বাঘ মামা’ গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। আবার ‘দস্যু বনহুর’ সিনেমায় ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’ গানটির শিল্পী হলেন আজাদ রহমান। জনপ্রিয় গানটিতে সুরও করেছেন তিনি। ‘আমীর ফকির’ সিনেমার গান ‘বাঘ শিকার যাইমু/বন্দুক লইয়া রেডি হইলাম আমি আর মামু! মামু আমার বেজায় রসিক কেন করে খামু খামু’ একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল।

এদিকে ‘গ্রেপ্তার’ ছবির গান ‘আগে গেলে বাঘে খাবে’, ‘হাবিলদার’ সিনেমায় কুমার বিশ্বজিৎ গেয়েছেন ‘তুমি বাঘের মুখে পড়েছ, ছাড়া পাবে না, ও তুমি মরেছ!’ এ ছাড়া ‘বাংলার বাঘ তুমি, বাংলার অহংকার, তোমাতে গর্জন, তোমাতে হুংকার’ গানটি মূলত মাশরাফি বিন মুর্তজাকে উৎসর্গ করে লেখা। পাশাপাশি জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী নকুল বিশ্বাসের ‘আমি বাঘ তুই হরিণের পোলা’ গানটি পৃথিবীর সব সংখ্যালঘু, নির্যাতিত, দুর্বল মানুষের জন্য লেখা।

অনেক প্রবাদ–প্রবচনে বাঘের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যেমন ‘বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা’, ‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’, ‘কাল হয়েছে অকাল, ছাগলে চাটে বাঘের গাল’, ‘আগে গেলে বাঘে খায়/ পরে গেলে সোনা পায়’, ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়’, ‘যে বনে যায়, সেই বাঘ হয়’, ‘যে বনে বাঘ নেই সে বনে শিয়ালই রাজা!’ ইত্যাদি।

আবার মানুষও তার সাহসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাঘ হয়ে উঠতে পারে। যেমন বাঘের মতো সাহসী ও সুঠামদেহী সুপুরুষ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে বলা হতো বাংলার বাঘ। আবার বাঘা যতীন ছিলেন বাংলার প্রধান বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর দলের প্রধান নেতা। খেলাধুলায় বাঘের উপস্থিতি দেখা যায়। যেমন গ্রামীণ জীবনে বাঘবন্দী খেলা, বাঘ-ছাগল খেলা চোখে পড়ে।

পরিবেশবিদদের মতে, বাঘ সারা বিশ্বে একটি বিপন্ন প্রাণী। তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বের ১৩টি দেশে ৩ হাজার ৮৪০টি বাঘ রয়েছে। এদের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশের সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির বাঘের আবাসভূমি। বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ক্রমে কমছে বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি।

জানা যায়, ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। এরপর ১৯৮২ সালের জরিপে ৪২৫টি এবং ১৯৮৪ সালে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানা যায়। ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে দাঁড়ায় ১০৬টিতে। হঠাৎ সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৪০০ থেকে ১০৬টিতে এসে দাঁড়ালে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। ২০১৮ সালের সর্বশেষ বাঘশুমারিতে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ পাওয়া গিয়েছিল। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ সালের জরিপে পাওয়া গেছে ১২৫টি।

বাংলাদেশের সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির বাঘের আবাসভূমি। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, বিশালতা, নদ-নদীর পর্যাপ্ততা, বনের গভীরতা, শিকারের সহজলভ্যতা বাঘ বসবাসের জন্য খুবই উপযোগী। সে কারণে একক বন হিসেবে সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাঘ বাস করে। আগে এ বনে বাঘের সংখ্যা অত্যধিক ছিল। বর্তমানে এর সংখ্যা কমে আসছে।

ইউএনডিপির হিসাবমতে, সুন্দরবন থেকে বছরে অন্তত ২০টি করে বাঘ কমে যাচ্ছে। অন্য এক হিসাবমতে, প্রতিবছর গড়ে ৮-১০টি বাঘ বিভিন্ন কারণে মারা যায়। বন বিভাগ ও বিশেষজ্ঞরা বাঘের মৃত্যুর জন্য ৮টি কারণকে চিহ্নিত করেছেন। যথা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা-লবণাক্ততা, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত বনের ঘনত্ব কমে যাওয়া, খাদ্যসংকট, বার্ধক্যজনিত, পুরুষ বাঘ কর্তৃক বাচ্চা খেয়ে ফেলা, ফাঁদ পেতে ও খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা, লোকালয়ে প্রবেশের পর গ্রামবাসী কর্তৃক পিটিয়ে হত্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাঘের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। এক জরিপে দেখা যায়, গণপিটুনি, রোগে ভুগে এবং বিভিন্ন কারণে গত দুই যুগে ৬০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে।

আর ১৯৮৩-২০০৩ সময়ে সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বিভিন্ন কারণে ৫৫টি বাঘ মারা যায়। তবে বন বিভাগের তথ্যমতে, ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সুন্দরবন এবং তৎসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিভিন্ন কারণে ১৬টি বাঘ মারা গেছে।

বাঘ সুন্দরবনের প্রতিবেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর সুরক্ষা বনের প্রতিবেশকে সুরক্ষিত করে। দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা হ্রাস পেলে স্বাভাবিকভাবেই হরিণসহ অন্য প্রাণীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাবে। ফলে বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে। বাঘকে সুন্দরবনের বনজ সম্পদসহ অন্যান্য প্রাণীকুলকে সংরক্ষণের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। বনের অভিভাবক হিসেবে বাঘের সংরক্ষণ প্রয়োজন, যা পরিবেশ, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও মানবজীবনযাত্রাকে রক্ষা করবে। তাহলে বাঁচবে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ তথা দেশ।

খ ম রেজাউল করিম সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন দরবন র ব র স ন দরবন র উপস থ ত বন র প র জনপ র য পর ব শ স রক ষ র জন য সবচ য

এছাড়াও পড়ুন:

এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে 

দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।

সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।

বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় 

২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।

জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’

‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।

বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।

জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।

২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।

কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন

২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।

জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।

কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।

কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাঘ রক্ষায় সুন্দরবনের চারপাশে হবে সুরক্ষাবলয়: পরিবেশ উপদেষ্টা
  • চোরা শিকারিদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগের আহ্বান উপদেষ্টার 
  • বাঘ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে
  • পাচারকারীসহ আরও কিছু কারণে হুমকির মুখে সুন্দরবনের বাঘ
  • এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে 
  • সুন্দরবনে অভিযান দেখে পালালেন জেলেরা, পড়ে রইল কাঁকড়াবোঝাই ট্রলার