খ্রিষ্টানদের সঙ্গে মহানবীর (সা.) শান্তিচুক্তি
Published: 6th, April 2025 GMT
ইসলামের আবির্ভাবের সময় যারা এই নতুন ধর্মের বিরোধিতা করেছে, তাদের অধিকাংশ নিজেদের স্বার্থ এবং প্রভাব হারানোর ভয়ে ইসলামকে বিপদ মনে করেছিল। অধিকাংশ মানুষের অবস্থান ছিল নিরপেক্ষ, তারা ‘দেখি কী হয়’ ধরনের মনোভাব পোষণ করেছিল। ইসলামের আগমনের পূর্বে, আরবের সব উপজাতির মধ্যে কুরাইশ ছিল সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ ও শক্তিশালী। তারপর কুরাইশ গোত্রীয়রা ইসলাম এবং নবীজির (সা.
নাজরানের কূটনৈতিক মিশন
নবী মুহাম্মদ (সা.) তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর, তিনি তার নিকটতম সঙ্গী আবু বকরকে হজ পরিচালনার জন্য এবং তার চাচাতো ভাই আলীকে মক্কায় ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য পাঠান, যাতে মক্কায় কেউ পুরনো জাহেলিয়াতের রীতি অনুযায়ী হজ পালন করতে না পারে। তখনই সমস্ত আরব উপজাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলামি রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা আর কারও নেই। এর পর তারা তাদের অবস্থান পর্যালোচনা করতে শুরু করে।
বিভিন্ন উপজাতির প্রতিনিধিরা মদিনায় আসে, কেউ ইসলামের মৌলিক দিক জানার জন্য, আবার কেউ তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য। তাদের মধ্যে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদল এসেছিল নাজরান থেকে।
আরও পড়ুনআবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ছিলেন বিজ্ঞ ও সাহসী সাহাবি১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪নাজরান, যা তখন আরবের দক্ষিণে একটি খ্রিষ্টান উপত্যকা, সেখানে আবু হারিতাহ ইবন আল্কামা নামে একজন বিশপ ছিলেন যিনি বাইজেন্টাইন সম্রাটদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং সেখানে বেশ কিছু চার্চ নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন।
নবী মুহাম্মদ (সা.) তাদের ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে একটি পত্র পাঠান এবং তার প্রতি উত্তরে নাজরান থেকে ৬০ জনের একটি প্রতিনিধিদল মদিনায় আসে। মদিনায় এসে তারা নবীজির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। তাদের সান্ধ্যকালীন প্রার্থনার সময় হয়ে এলে তবে নবীজি (সা.) তাঁর সাহাবিদের নির্দেশ দেন, তারা যেন নাজরানীদের প্রার্থনা করতে দেয়।
শান্তিচুক্তি
নাজরানীরা নবীজিকে (সা.)-এর কাছে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি ঈসাকে (আ.) কীভাবে দেখেন? আমরা খ্রিষ্টান, আমাদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।’ নবীজি বললেন, ‘আজ আপনাদের জন্য কিছু বলব না, কাল জানাতে পারব, ইনশাআল্লাহ।’
পরদিন, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি লাভ করেন, যেখানে বলা হয়, ঈসাকে (আ.) আদমের মতোই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে আল্লাহ কর্তৃক দেওয়া ‘হও’ বলার মাধ্যমে অস্তিত্বে আনা হয়। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৫৯-৬১)।
নবীজি (সা.) নাজরানীদেরকে নতুন এই তথ্য জানালে তারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর নবীজি তাদের একটি চ্যালেঞ্জ দেন—যা কোরআনেও উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ, যারা সত্য তারা ছাড়া অন্য দলটি যেন ধ্বংস হয়ে যায়, উভয় পক্ষ একটি স্থানে দাঁড়িয়ে সেই প্রার্থনা করবে। এটা ছিল তাদের জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ, কারণ এর মাধ্যমে তাদের আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
পরের দিন, শুরাহবিল নামের একজন প্রতিনিধি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে শান্তি চুক্তি করার প্রস্তাব দেন। তিনি একদিনের মধ্যে শর্তাবলি জানাতে বলেন এবং তারা যেকোনো শর্ত মেনে নেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
আরও পড়ুনআবু মুসা (রা.) ছিলেন জ্ঞানী সাহাবি০১ ডিসেম্বর ২০২৪চুক্তির শর্তাবলি
মহানবীর (সা.) সঙ্গে তাদের শান্তি চুক্তির শর্তাবলি ছিল এমন:
১. আল্লাহর রাসুল হিসেবে নাজরানবাসীর ওপর নবীজির (সা.) কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
২. প্রতি বছর তারা ২,০০০ হুল্লা প্রদান করবে—১,০০০ রজব মাসে এবং ১,০০০ সফর মাসে। প্রতিটি হুল্লা একটি আউন্সের সমান, যা ৪ দিরহাম সমান।
৩. নবীজির (সা.) বার্তাবাহকদের তারা ২০ দিনের জন্য থাকার ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় খরচের ব্যবস্থা করবে। তবে কোনো বার্তাবাহক নাজরানে এক মাসের বেশি থাকবে না। তাদের ৩০টি ঢাল, ৩০টি ঘোড়া এবং ৩০টি উট ঋণ হিসেবে দিতে হবে, যাতে ইয়েমেনে কোনো বিশৃঙ্খলা বা বিশ্বাসঘাতকতা ঘটলে তা কাজে লাগানো যায়। যদি এই ঢাল, ঘোড়া বা উট কিছু হারিয়ে যায়, তবে তা নবীজির (সা.) বার্তাবাহকের দায়ে থাকবে, যতক্ষণ না তা ফেরত দেওয়া হয়।
৪. আল্লাহ ও মুহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষে নাজরানবাসীদের জীবন, ধর্ম, জমি, সম্পত্তি, উপস্থিত ও অনুপস্থিত সদস্যদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হলো। তাদের কোনো পুরোনো রীতি পরিবর্তন করতে হবে না। তাদের ধর্মীয় অধিকার বা বিশ্বাসে কোনো পরিবর্তন আনা হবে না।
৫. তাদের পুরোহিত, যাজক বা চার্চ রক্ষককে তার পদ থেকে সরানো হবে না।
৬. যতটুকু কিছু তাদের আছে, তা তাদেরই থাকবে, বড় হোক বা ছোট। তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হবে না এবং তারা কোনো প্রতিশোধমূলক হত্যার শিকার হবে না। তাদেরকে বাহিনী গঠন করতে বাধ্য করা হবে না এবং কোনো সেনাবাহিনী তাদের ভূমিতে প্রবেশ করতে পারবে না।
৭. যদি তাদের কেউ তার কোনো অধিকার দাবি করে, তবে তার জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। যে ব্যক্তি পূর্ববর্তী ঋণের ওপর সুদ নেয়, সে এই সুরক্ষার আওতায় থাকবে না। নাজরানে কোনো ব্যক্তি অন্যের করা অন্যায়ের জন্য দায়ী হবে না।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩,১২০)
সূত্র: অ্যাবাউট ইসলাম ডট কম
আরও পড়ুনসাহসী সাহাবি হজরত যুবাইর (রা.)০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম হ ম মদ ইসল ম র আল ল হ র জন য উপজ ত
এছাড়াও পড়ুন:
প্রথম আলোর সাংবাদিককে বৈষম্যবিরোধী নেতার হুমকি, থানায় জিডি
প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেনকে ফেসবুকে হুমকি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মুখ্য সংগঠক মোত্তাসিন বিশ্বাস। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এক ফেসবুক পোস্টে এ হুমকি দেন তিনি।
এ ঘটনায় গতকাল রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন আনোয়ার হোসেন।
ফেসবুক পোস্টে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনের দুটি ছবি লাল দাগ দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেন মোত্তাসিন। ক্যাপশনে তিনি আনোয়ার হোসেনের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘....সত্য লিখুন, না হলে আপনিও ছাড় পাবেন না। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
মোত্তাসিন বিশ্বাসের পোস্টের পর মন্তব্যের ঘরে আনোয়ার হোসেনকে একাধিক আইডি থেকে মারধরের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তবে আজ বুধবার বেলা ৩টা ১৬ মিনিটে মোত্তাসিনের আইডি থেকে পোস্টটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘণ্টাখানেক পর পোস্টটি তাঁর ওয়ালে আবার দেখা যায়। এ হুমকির প্রতিবাদ জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ’।
ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে জানতে চাইলে মোত্তাসিন বিশ্বাস আজ বেলা সাড়ে তিনটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুক পোস্টে হলুদ কথাটা লেখা ঠিক হয়নি। এটি গত শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের শহীদ সাটু অডিটরিয়ামে জেলা পুলিশ আয়োজিত সুধী সমাবেশে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বক্তব্য দেওয়ার সময় বাধা দিয়ে থামিয়ে দেন জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য। এ নিয়ে প্রথম আলোয় ‘পুলিশের সুধীসমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ খবরের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েই এমন পোস্ট করেছেন বলে জানিয়েছেন মোত্তাসিন।
তাৎক্ষণিকভাবে লিখে ফেলেছিলেন, পরে মুছে দিয়েছেন। আনোয়ার হোসেনের করা কোন সংবাদটির বিষয়ে পোস্ট করেছেন, জানতে চাইলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাকে বাধা দেওয়ার সংবাদটির কথা জানান।
মোত্তাসিন বিশ্বাস আরও বলেন, প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন চব্বিশের আন্দোলনে তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু সংবাদটি এভাবে কেন লিখেছেন, তা জানার জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি তাঁদের এড়িয়ে গেছেন। সে জন্যই তিনি ফেসবুকে লিখেছেন।
আনোয়ার হোসেন জিডিতে উল্লেখ করেছেন, স্ট্যাটাসে তাঁর দুটি ছবি ক্রস চিহ্ন দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। ওই পোস্টে মোত্তাসিনের অনুসারীসহ আরও অনেকে খারাপ মন্তব্য করে তাঁকে হুমকি দিয়েছেন। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ায় জিডি করার কথা জানান তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন। এটি একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক আবদুর রাহিম বলেন, এই পোস্ট দেওয়ার পর রাতে তাঁরা এটি নিয়ে সভা করেছেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পোস্টটি ডিলিট করা হবে।
আরও পড়ুনপুলিশের সুধীসমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা২৭ এপ্রিল ২০২৫সাংবাদিক সমাজের নিন্দা-প্রতিবাদআনোয়ার হোসেনকে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় জরুরি সভা করে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ। বিষয়টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের লিখিতভাবে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গতকাল মঙ্গলবারের সভায়। অবহিত করার পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যাবতীয় সংবাদ বর্জন করা হবে বলেও সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (সিটিজেএ) সভাপতি রফিকুল আলম। উপস্থিত ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রেসক্লাব, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রেসক্লাব, সিটি প্রেসক্লাব, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিটিজেএর নেতা ও সদস্যরা।
সভার পর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পরিবর্তিত বাংলাদেশে একজন পেশাদার সাংবাদিককে নিয়ে আপত্তিজনক ও হুমকিস্বরূপ বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেসব অধিকারের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান হয়, তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বাক্স্বাধীনতার অধিকার। একজন পেশাদার সাংবাদিককে নিয়ে ফেসবুকে এমন পোস্ট সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর হস্তক্ষেপ, যা আমাদের উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত করেছে।’ অবিলম্বে মোত্তাসিন বিশ্বাস তাঁর দেওয়া পোস্টটি প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ না করলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ সম্মিলিতভাবে কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে।