উপকূলের গ্রামে গ্রামে ঘুরে চার যুগ ধরে নৌকা বানান জামশেদ
Published: 6th, April 2025 GMT
ভয়াল শিবসা নদীর বুক জোয়ারের পানিতে ফুলে উঠতে শুরু করেছে। মাথার ওপর চৈত্রের প্রখর রোদ। নদীর পাড়ে কাঠফাটা সেই রোদে বসে কাঠের গায়ে বাটালি-হাতুড়ি দিয়ে খাঁজ কাটছেন জামশেদ গাজী। হাতে-মুখে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শিবসা থেকে থেমে থেমে ভেসে আসা লোনা হাওয়া তাতে কিছুটা স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। ঠুকঠাক শব্দে এগিয়ে চলছে জামশেদের কাজ। এই শব্দ নৌকা তৈরির।
খুলনার দাকোপ উপজেলার দক্ষিণের শেষ জনপদ শিবসা তীরের কালাবগী ঝুলন্তপাড়া এলাকায় নৌকা তৈরি করছিলেন জামশেদ। ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর ঝুলন্তপাড়ায় বসতি গড়ে ওঠে। নদীর চরে গাদাগাদি গড়ে ওঠা অসংখ্য ঝুলন্ত ঘরের কারণে এ রকম নামকরণ হয়। বছর কয়েক আগেও এখানে পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষের বাস ছিল। ঝুলন্তপাড়ায় পরিধি এখন কমে এসেছে। জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে নানান জায়গায় ঠাঁই নিয়েছে এখানকার মানুষ। প্রমত্ত শিবসা আর সুতারখালী নদীর সংযোগস্থলের অব্যাহত ভাঙনের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় সিডর-আইলা-আম্পানের আঘাত সয়ে সুন্দরবন–সংলগ্ন এই পাড়ায় কোনোমতে টিকে আছে শ খানেক পরিবার।
এসব পরিবার এখনো রয়ে গেছে জীবিকার তাগিদে। শিবসা আর সুতারখালীর বুকে গলদা-বাগদার রেণু আহরণ করাই তাদের জীবিকা। এই কাজে জালের পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো নৌকা।
জামশেদ গাজী (৬৫) উপকূলের বিভিন্ন গ্রামে নৌকা তৈরি করছেন প্রায় চার যুগ ধরে। কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, রামপাল, মোংলা—সব জায়গায় কাজ করেন। নদী–সংলগ্ন এলাকায় নৌকার কাজের চাহিদা বেশি। কালাবগীর নদীতে অসংখ্য নৌকা দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘এখানকার কম করে ২০০ নৌকা আমার হাতে বানানো।’
জামশেদ গাজীর সহকারী এখন তাঁর ছেলে সালাউদ্দীন গাজী। বাপ-ছেলে মিলেই করেন নৌকার কাজ। সপ্তাহের পাঁচ দিন কাজের জন্য কালাবগীতেই থাকেন। বৃহস্পতিবার বাড়িতে গিয়ে আবার ফেরেন শনিবার।
জামশেদ গাজীর বাড়ি সুতারখালী বাইনপাড়া গ্রামে। কবে থেকে নৌকা তৈরি করছেন জানতে চাইলে জামশেদ বলেন, ‘অট্টাশির আরও আট-নয় বছর আগে থেকে। অট্টাশির কয়েক বছর আগে থেকেই আমি হেড মিস্ত্রি।’
জামশেদের মতো উপকূলের মানুষের অনেকে কোনো কিছু মনে রাখেন বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে। জামশেদও আটাশি দিয়ে জীবনের অনেক কিছুর হিসাব রেখেছেন। ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে কালাবগী অঞ্চলের বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এর প্রভাবে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের কারণে সুতারখালী ইউনিয়ন অনেক দিন ধরে ডুবে ছিল। দাকোপে ঘটে যাওয়া সেই প্রথম বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা এখনো ভোলেনি মানুষ।
আলাপে আলাপে জানা গেল, নৌকা তৈরির জন্য একজন ‘হেড মিস্ত্রি’ থাকে। আর থাকে সহকারী মিস্ত্রি। নৌকার নকশা, কাঠামো থেকে শুরু করে নৌকাটা কেমন হবে, তা নির্ভর করে প্রধান মিস্ত্রির ওপর।
জামশেদ গাজী বলেন, ‘আগে সংসারে খুব অভাব ছিল। বাবা নলিয়া নদীতে মাছ ধরে কোনোমতে সংসার চালাতেন। হেড মিস্ত্রি হওয়ার আগে মানুষের বাড়িতে মাস চুক্তিতে শ্রমিকের কাজ করতেন। লেখাপড়া শিখতি পারেননি। মামা মিস্ত্রি ছিলেন, তাঁর কাছে কাজ শিখেছি।’ এরপর দুই-তিনজনের অধীনে সহকারীর কাজ করেছেন।
নৌকা তৈরি করছেন জামশেদ গাজী আর সহকারী হিসেবে আছেন তাঁর ছেলে সালাউদ্দিন গাজী.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সহক র
এছাড়াও পড়ুন:
চলন্ত অবস্থায় বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করতে সক্ষম সড়ক চালু ফ্রান্সে
জ্বালানিসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ছে। তবে এসব গাড়ি বাসা বা নির্দিষ্ট স্থানেই শুধু চার্জ করা যায়। ফলে দূরে ভ্রমণের সময় গাড়ির চার্জ শেষ হয়ে গেলে বিপদে পড়েন অনেকেই। এ সমস্যা সমাধানে তারের সংযোগ ছাড়াই বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করতে সক্ষম ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ওয়্যারলেস চার্জিং সড়ক’ চালু করেছে ফ্রান্স। প্যারিসের উপকণ্ঠে চালু হওয়া সড়কটিতে চলাচলের সময় বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিক গাড়ি, বাস ও ভারী ট্রাকের ব্যাটারি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ হয়ে যাবে।
বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করার জন্য সড়কটিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে ২০০ কিলোওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। প্রয়োজনে সেটি ৩০০ কিলোওয়াট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, যা টেসলার ভি থ্রি সুপারচার্জারের মতো বিশ্বের দ্রুততম চার্জারগুলোর সমান শক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম। এই সড়কের নিচে স্থাপন করা হয়েছে অসংখ্য তামার কুণ্ডলী। এসব কুণ্ডলী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে, যা বিশেষ রিসিভারযুক্ত বৈদ্যুতিক গাড়িতে শক্তি স্থানান্তর করে। পদ্ধতিটি অনেকটা ওয়্যারলেস চার্জিং প্রযুক্তির মতো, যেখানে পাওয়ার ব্যাংক বা চার্জিং প্যাডে মোবাইল ফোন রেখে চার্জ নেওয়া হয়। চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ স্থানান্তর হওয়ায় ভারী বৃষ্টি, বরফ বা তুষারপাতেও চার্জিং প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। দ্রুত চার্জিং সুবিধার ফলে গাড়ি ও ট্রাক এখন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারবে, মাঝপথে চার্জ নিতে থামার প্রয়োজন হবে না। ফলে গাড়িতে বড় ও ভারী ব্যাটারি বহনের প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে যাবে।
এরেনা ইভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই স্বয়ংক্রিয় চার্জিং সড়কে মাত্র কয়েক মিনিট চললেই বৈদ্যুতিক গাড়ির রেঞ্জ বা চলার সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। ফলে বৈদ্যুতিক গাড়ির দীর্ঘ যাত্রায় চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সমাধানে প্রযুক্তিটি নতুন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। প্রযুক্তিটি যদি ব্যাপকভাবে চালু করা যায়, তবে তুলনামূলকভাবে হালকা, সাশ্রয়ী এবং কম ব্যাটারিসমৃদ্ধ বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করা সম্ভব হবে। এতে গাড়ির উৎপাদন খরচও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রিওনের তৈরি সড়কটির নকশাতেও রয়েছে বাড়তি সুবিধা। বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করার প্রযুক্তি রাস্তার ভেতরের অংশে থাকায় ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কম। ফ্রান্সের পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশজুড়ে প্রায় ৯ হাজার কিলোমিটার ওয়্যারলেস চার্জিং সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে বৈদ্যুতিক যানবাহন চলাচল আরও সহজ, কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠে।
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস