আমরা কি ব্যর্থ সমাজের দিকে এগিয়ে চলেছি?
Published: 8th, April 2025 GMT
আমরা প্রায়ই ব্যর্থ রাষ্ট্রের কথা বলি; শুনিও। কিন্তু কখনও ব্যর্থ সমাজের কথা বলি না। আসলে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয় না; ব্যর্থ হয় সমাজ। সমাজ ব্যর্থ হলেই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা অনিবার্য হয়ে ওঠে। কারণ, রাষ্ট্র হলো ব্যবস্থাপনা কাঠামো মাত্র, যার মূল নিহিত সমাজের মাঝেই। আজকের পৃথিবীতে যেসব রাষ্ট্রকে আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করি, সেগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, ওসব দেশে সমাজের ব্যর্থতার পথ ধরেই রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, সমাজ কখন ব্যর্থ হয়? তার লক্ষণগুলোই বা কী? শত বছরেরও বেশি আগে জগদ্বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক আন্তন চেখভ ব্যর্থ সমাজের প্রকৃতি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ব্যর্থ সমাজে মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে জেগে ওঠে না। সে জেগে ওঠে স্লোগানে। এখানে পাঠাগার কম থাকে। উপাসনালয় বেশি থাকে। যেউপাসনালয়গুলো আবার সপ্তাহের ছয় দিনই খালি পড়ে থাকে। ব্যর্থ সমাজে প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষের বিপরীতে হাজার হাজার বোকা থাকে এবং প্রতিটি সচেতন শব্দের বিপরীতে থাকে হাজার হাজার পচনশীল শব্দ। তারা সমস্যার ওপরে ভেসে বেড়ায়; গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হয় সর্বদা নির্বোধ। সমাজের অতি তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে মানুষ আলোচনায় মেতে থাকে। মূল বিষয়গুলো হারিয়ে যায়। সমস্যা সমাধানের চেয়ে একে অন্যের ওপর প্রতিনিয়ত দোষ চাপাতে থাকে।’
চেখভের কথাগুলোকে কেউ যদি আজকের বাংলাদেশের সমাজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে শিউরে ওঠেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ দেশে জ্ঞানের চর্চা এখন বোকাদের বিষয়; সস্তা জনতোষণবাদী স্লোগানে মুখরিত চারদিক; সমস্যার গভীরে যেতে অনীহা– সবই মিলে যায়। তাহলে আসলেই কি আমরা একটি ব্যর্থ সমাজের দিকে এগিয়ে চলেছি?
২.
আমরা যা জানি, তার চেয়ে অনেক বেশি জানি না। ধর্ম, ইতিহাস, রাজনীতি– সর্বক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। এই না-জানা কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু এটি যখন অজ্ঞতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখনই তা হয়ে ওঠে ভয়ংকর। আমরা প্রায়ই বলে থাকি, জ্ঞানই শক্তি। কিন্তু জ্ঞানহীনতা বা অজ্ঞতারও যে শক্তি আছে, তা আমরা কখনও অনুধাবন করতে পারি না। হতে পারে তা নেতিবাচক শক্তি। কিন্তু এই শক্তি ক্রমে আমাদের সমাজকে দখল করে নিচ্ছে; ক্যান্সার যেমন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি। আমরা টের পাচ্ছি না।
না-জানা আমাদের জানতে আগ্রহী করে তোলে; অজ্ঞতা জানার সব আগ্রহকে টুঁটি চেপে যুক্তির দরজা রুদ্ধ করে দেয়। পরিবর্তে জন্ম দেয় অন্ধবিশ্বাস। বিপরীত বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা যায়; অন্ধবিশ্বাসকে তা করা যায় না। এই অন্ধবিশ্বাসের কারণে মানুষ মানুষকে মারতে পারে, নিজেও মরতে পারে। আসলে অজ্ঞতা মানুষের চিন্তন প্রক্রিয়াকেই মেরে ফেলে। ফলে সে নতুন কোনো চিন্তা করতে পারে না; প্রশ্নও করতে পারে না। অথচ জ্ঞানের প্রথম শর্ত হলো প্রশ্ন করতে শেখা। জ্ঞানহীনতায় আচ্ছন্ন একজন মানুষ কিছু একটা জানার আগেই বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে। বিশ্বাসের কাছে নিজেকে নিঃশর্ত সঁপে দেওয়া মানুষ নতুন কিছু গ্রহণ করতে পারে না। বরং বিরুদ্ধ বিশ্বাসের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার মতো। এমনই ঘটে চলেছে আমাদের সমাজে।
৩.
আমাদের দেশে ধর্ম থেকে শুরু করে রাজনীতি, ইতিহাস– সর্বক্ষেত্রে এখন অন্ধবিশ্বাসের রাজত্ব। যুক্তির কথা বললেই তেড়ে আসে সবাই। মানুষ ধার্মিক হচ্ছে; কিন্তু ধর্মগ্রন্থ পড়ে না, ধর্মের ইতিহাসও পড়ে না। পরিবর্তে ফেসবুক, ইউটিউব আর মাহফিলের ওয়াজ শুনে ধর্মকে জানে। ইতিহাসের ক্ষেত্রেও তাই। আজকাল কেউ ইতিহাসের বই পড়ে না। নেতাদের চটকদার বক্তৃতা ও ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকেই ইতিহাসকে জানে। এখন তো আর যাত্রাপালা হয় না। যখন হতো, তখন যাত্রাপালার কাহিনিকে ইতিহাস হিসেবে মেনে নিত এ দেশের মানুষ। এভাবে সর্বব্যাপী অজ্ঞতা আমাদের গ্রাস করছে আর দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে সেই কঠিন প্রশ্নের মুখে, আমরা কি ক্রমেই ব্যর্থ সমাজের দিকে এগিয়ে চলেছি?
৪.
স্বাধীনতা পেয়েছি ৫৪ বছর হয়ে গেছে। এই সময়ে বেশ ক’বার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটেছে। ক্ষমতা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার ক্ষমতা নিয়েই অনেক বিষয়ে সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। এসব নিয়ে মাঝেমধ্যে আলাপ-আলোচনাও হচ্ছে। কিন্তু যেসব বিষয়ের সঙ্গে সমাজের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক; যেসব বিষয়কে ভিত্তি করে সমাজ এগিয়ে যায়, সেসব নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। ফলে চেখভের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমাজ থেকে ক্রমেই আমরা এক জ্ঞানহীনতা তথা অজ্ঞতার সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছি।
পাকিস্তানের ২৪ বছর পশ্চিমা শাসকরা এ দেশে অজ্ঞতার চাষ করেছে। তবে সেটা বেশি হয়েছে রাষ্ট্রিক পর্যায়ে; সমাজের নিচের দিকে তা সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি; যদিও ব্রিটিশ শাসনের আদলে তারা এই দেশে একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। মনে করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর সেই চাষ বন্ধ হবে। কিন্তু তা হয়নি। চাষের দায়িত্ব দক্ষ কৃষকের হাতে পড়েনি; পড়েছে পুঁজির মালিক বুর্জোয়াদের হাতে। পাকিস্তানিদের চেয়েও দ্বিগুণ উৎসাহে এরা অজ্ঞতার চাষ করেছে। ফলে গত ৫৪ বছর এ দেশে জ্ঞানের পরিবর্তে অজ্ঞতার চাষই হয়েছে বেশি, যার ফসল এখন সর্বত্রই দৃশ্যমান। চাকচিক্যময় অন্ধকারে ঢেকে গেছে দেশ, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়ছে শিক্ষার ক্ষেত্রে।
গত কয়েক দশকে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক শ্রেণির মানুষের সন্তান লাখ লাখ টাকা খরচ করে ওইসব বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করছে। কিন্তু যে দেশের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের বেশি গ্রামে বাস করে, সে দেশের গ্রামীণ শিক্ষার অবস্থা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হয় না। ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে জেনেছি, আমার জেলায় গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গত কয়েক বছরে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র। অন্যদিকে গ্রামে থেকেও যারা কিছু লেখাপড়া শিখেছেন, তাদের প্রায় সবাই জেলা শহর কিংবা নিদেন পক্ষে উপজেলা শহরে এসে আস্তানা গাড়ছেন। ফলে ৮০ শতাংশ জনসংখ্যা অধ্যুষিত গ্রামগুলোর শক্তিকাঠামো পুরোপুরি চলে গেছে বা চলে যাচ্ছে শিক্ষাহীন অন্ধবিশ্বাসীদের হাতে। ফলে ক্রমেই অজ্ঞতার মেঘ ঢেকে দিচ্ছে যুক্তির আকাশ।
চারদিকে আজ নৈতিক মূল্যবোধের সংকট। ধর্ষণ, খুন, মব-সন্ত্রাস সমাজকে গ্রাস করে রেখেছে। নির্মল আনন্দ আর বিনোদনও অজ্ঞতার শিকার। এই তো সম্প্রতি কাপাসিয়ায় নাটক বন্ধ করে দেওয়া
হয়েছিল; সমাজ নষ্ট হয়ে যাওয়ার অজুহাতে। এর আগে গত নভেম্বরে ঠুনকো অজুহাতে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
ঠিক এমনটিই ঘটেছে আফগানিস্তানে। ২০২১ সালে দেশটিতে তালেবানরা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার তিন সপ্তাহের মাঝে সব ধরনের বিনোদন, এমনকি সংগীতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্তত দু’জন শিল্পীকে পিটিয়ে খুন করেছে। আমরাও কি তবে সে পথেই হাঁটছি? যদি তা-ই হয়; ব্যাধিটা সমাজ থেকে রাষ্ট্রে ছড়াতে বেশি সময় লাগবে না।
মোশতাক আহমেদ: কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, জাতিসংঘ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
শুল্ক কমেছে, বাংলাদেশে স্বস্তি
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশের ওপর দেশটির আরোপ করা পাল্টা শুল্কের হার শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। গতকাল শুক্রবার হোয়াইট হাউসের এক ঘোষণায় এ কথা বলা হয়। বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কহার কমে প্রতিযোগীদের কাছাকাছি অবস্থানে আসার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক।
২৯ জুলাই থেকে তিন দিনের আলোচনা ও দর-কষাকষির শেষ দিন ৩১ জুলাই এ ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭০টি দেশের ওপর ১০ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসে।
পাল্টা শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ নামিয়ে আনতে বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকেও বেশ কিছু সুবিধা দিতে হয়েছে। একদিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পান গত ২১ জানুয়ারি। এর দুই মাস পর গত ২ এপ্রিল হঠাৎ বিশ্বের ৭০ দেশের জন্য বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। অনেকেই ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে একধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলে সমালোচনা করেছেন।
প্রথমে গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা হয় ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক। মাঝখানে তিন মাস স্থগিত রাখার পর ৮ জুলাই তা কমিয়ে ট্রাম্প ৩৫ শতাংশ করেন। বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ করায় মোট শুল্কহার দাঁড়াবে এখন ৩৫ শতাংশে।
দর-কষাকষির মাধ্যমে ঘোষিত শুল্কহার কমিয়ে আনাকে ঐতিহাসিক চুক্তি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের আলোচকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে আলোচনা করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন আলোচকদের মধ্যে আরও ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে বলেছে, অনেক বিষয় জড়িত থাকায় শুল্ক আলোচনার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয়টি শুধু শুল্ক কমানোর সঙ্গেই যুক্ত ছিল না; বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্যঘাটতি ও নিরাপত্তা–সংক্রান্ত মার্কিন উদ্বেগও ছিল এর সঙ্গে। সমাধানের বিষয়টি নির্ভর করছিল একটি দেশের সদিচ্ছার ওপরও।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা গতকাল প্রথম আলোকে জানান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকব এবং যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আমরা ২০ শতাংশের নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম।’
প্রতিযোগী দেশগুলোর শুল্কহারযুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
বাংলাদেশের সমান ২০ শতাংশ ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কা এবং ১৯ শতাংশ হার নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য কম রয়েছে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের হারও ১৯ শতাংশ। তাইওয়ানের ওপর ২০ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ; জাপান, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৪১ শতাংশ শুল্কহার সিরিয়ার ওপর। বেশি হার আরোপ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে লাওস ও মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ; সুইজারল্যান্ডের ওপর ৩৯ শতাংশ; ইরাক ও সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ এবং লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিচ্ছে বাংলাদেশসরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেশন পুরোপুরি মেনে চলারও অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে দেশটি থেকে দাম বেশি দিয়ে হলেও বছরে সাত লাখ টন করে গম কেনা হবে পাঁচ বছর ধরে। ইতিমধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি।
দেশটি থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আগে থেকেই আমদানি করা হচ্ছে। তা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৯ থেকে ১১ জুলাই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সফল না হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য বেশি আমদানি করে, সেসব পণ্যের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ১৭ থেকে ২৩ জুলাই সপ্তাহব্যাপী অনলাইনে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়েই তিনি বৈঠকগুলো করেন।
গত ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (প্রকাশ না করার চুক্তি) করার কারণে সরকারি প্রতিনিধিদলে অন্য কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ভেতরে-ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
সরকারের আহ্বানে সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে। এসব সভায় তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেন তাঁরা। বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ হয়েছে। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ১৩ কোটি ডলারে ৩ লাখ টন সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রায় ১০ কোটি ডলারের সয়াবিনবীজ আমদানির এমওইউ করেছেন।
এ ছাড়া ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ১৯ হাজার টন তুলা আমদানির সমঝোতার চুক্তি করেছে বস্ত্র খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কার্গিল ইনকরপোরেটের কাছ থেকে এশিয়া কম্পোজিট ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে ৬ হাজার টন আমদানির এমওইউ করেছে। একই দরে একই পরিমাণ তুলা আমদানির এমওইউ করেছে সালমা গ্রুপও। এ ছাড়া মোশাররফ গ্রুপ মার্কিন লুইস ড্রেফাস গ্রুপ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ৭ হাজার টন তুলা আমদানির এমওইউ করেছে।
কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ২০ শতাংশ শুল্কহার ঠিক করতে পেরেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, এটাই হচ্ছে প্রধান কারণ।’
ট্রেড ইউনিয়ন, মজুরি, শ্রমিক নিপীড়ন, মামলা—এসব বিষয় আলোচনায় উঠেছিল কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে। শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখতে জোর দিয়েছে তারা। আমরা আইএলও কনভেনশন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ জন্য শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চলছে।’
‘অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা’ওয়াশিংটনে দর-কষাকষিতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টা শুল্ক কমার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, তাতে বাংলাদেশ বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে রেহাই পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘সময়সীমার মধ্যেই জটিল আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। নইলে ৩৫ শতাংশের গুরুভার বহন করে যেতে হতো।’
খলিলুর রহমান আরও বলেন, প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান অথবা যত্সামান্য বেশি এবং ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য এখন প্রতিযোগিতামূলক থাকবে। তৈরি পোশাকশিল্প ও এর ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত স্বস্তিকর ঘটনা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টার উদ্দেশে ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় তিনি (শেখ বশিরউদ্দীন) সমালোচকদের হতাশ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আল্লাহ তাঁকে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, যাতে তিনি দেশকে সেবা দিতে পারেন, হোক তা সরকারে বা বেসরকারি খাতে।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। তবে আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই, বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্যকৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির প্রথম আলোকে বলেন, একটি বিশ্বশক্তির চাপের মুখে এই সাফল্য অর্জনের জন্য সরকার ও আলোচক দলের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন। এটি সম্ভবত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে কঠিন লড়াইগুলোর একটি ছিল, যা পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন তাঁরা।