আমরা কি ব্যর্থ সমাজের দিকে এগিয়ে চলেছি?
Published: 8th, April 2025 GMT
আমরা প্রায়ই ব্যর্থ রাষ্ট্রের কথা বলি; শুনিও। কিন্তু কখনও ব্যর্থ সমাজের কথা বলি না। আসলে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয় না; ব্যর্থ হয় সমাজ। সমাজ ব্যর্থ হলেই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা অনিবার্য হয়ে ওঠে। কারণ, রাষ্ট্র হলো ব্যবস্থাপনা কাঠামো মাত্র, যার মূল নিহিত সমাজের মাঝেই। আজকের পৃথিবীতে যেসব রাষ্ট্রকে আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করি, সেগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, ওসব দেশে সমাজের ব্যর্থতার পথ ধরেই রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, সমাজ কখন ব্যর্থ হয়? তার লক্ষণগুলোই বা কী? শত বছরেরও বেশি আগে জগদ্বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক আন্তন চেখভ ব্যর্থ সমাজের প্রকৃতি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ব্যর্থ সমাজে মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে জেগে ওঠে না। সে জেগে ওঠে স্লোগানে। এখানে পাঠাগার কম থাকে। উপাসনালয় বেশি থাকে। যেউপাসনালয়গুলো আবার সপ্তাহের ছয় দিনই খালি পড়ে থাকে। ব্যর্থ সমাজে প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষের বিপরীতে হাজার হাজার বোকা থাকে এবং প্রতিটি সচেতন শব্দের বিপরীতে থাকে হাজার হাজার পচনশীল শব্দ। তারা সমস্যার ওপরে ভেসে বেড়ায়; গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হয় সর্বদা নির্বোধ। সমাজের অতি তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে মানুষ আলোচনায় মেতে থাকে। মূল বিষয়গুলো হারিয়ে যায়। সমস্যা সমাধানের চেয়ে একে অন্যের ওপর প্রতিনিয়ত দোষ চাপাতে থাকে।’
চেখভের কথাগুলোকে কেউ যদি আজকের বাংলাদেশের সমাজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে শিউরে ওঠেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ দেশে জ্ঞানের চর্চা এখন বোকাদের বিষয়; সস্তা জনতোষণবাদী স্লোগানে মুখরিত চারদিক; সমস্যার গভীরে যেতে অনীহা– সবই মিলে যায়। তাহলে আসলেই কি আমরা একটি ব্যর্থ সমাজের দিকে এগিয়ে চলেছি?
২.
আমরা যা জানি, তার চেয়ে অনেক বেশি জানি না। ধর্ম, ইতিহাস, রাজনীতি– সর্বক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। এই না-জানা কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু এটি যখন অজ্ঞতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখনই তা হয়ে ওঠে ভয়ংকর। আমরা প্রায়ই বলে থাকি, জ্ঞানই শক্তি। কিন্তু জ্ঞানহীনতা বা অজ্ঞতারও যে শক্তি আছে, তা আমরা কখনও অনুধাবন করতে পারি না। হতে পারে তা নেতিবাচক শক্তি। কিন্তু এই শক্তি ক্রমে আমাদের সমাজকে দখল করে নিচ্ছে; ক্যান্সার যেমন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি। আমরা টের পাচ্ছি না।
না-জানা আমাদের জানতে আগ্রহী করে তোলে; অজ্ঞতা জানার সব আগ্রহকে টুঁটি চেপে যুক্তির দরজা রুদ্ধ করে দেয়। পরিবর্তে জন্ম দেয় অন্ধবিশ্বাস। বিপরীত বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা যায়; অন্ধবিশ্বাসকে তা করা যায় না। এই অন্ধবিশ্বাসের কারণে মানুষ মানুষকে মারতে পারে, নিজেও মরতে পারে। আসলে অজ্ঞতা মানুষের চিন্তন প্রক্রিয়াকেই মেরে ফেলে। ফলে সে নতুন কোনো চিন্তা করতে পারে না; প্রশ্নও করতে পারে না। অথচ জ্ঞানের প্রথম শর্ত হলো প্রশ্ন করতে শেখা। জ্ঞানহীনতায় আচ্ছন্ন একজন মানুষ কিছু একটা জানার আগেই বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে। বিশ্বাসের কাছে নিজেকে নিঃশর্ত সঁপে দেওয়া মানুষ নতুন কিছু গ্রহণ করতে পারে না। বরং বিরুদ্ধ বিশ্বাসের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার মতো। এমনই ঘটে চলেছে আমাদের সমাজে।
৩.
আমাদের দেশে ধর্ম থেকে শুরু করে রাজনীতি, ইতিহাস– সর্বক্ষেত্রে এখন অন্ধবিশ্বাসের রাজত্ব। যুক্তির কথা বললেই তেড়ে আসে সবাই। মানুষ ধার্মিক হচ্ছে; কিন্তু ধর্মগ্রন্থ পড়ে না, ধর্মের ইতিহাসও পড়ে না। পরিবর্তে ফেসবুক, ইউটিউব আর মাহফিলের ওয়াজ শুনে ধর্মকে জানে। ইতিহাসের ক্ষেত্রেও তাই। আজকাল কেউ ইতিহাসের বই পড়ে না। নেতাদের চটকদার বক্তৃতা ও ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকেই ইতিহাসকে জানে। এখন তো আর যাত্রাপালা হয় না। যখন হতো, তখন যাত্রাপালার কাহিনিকে ইতিহাস হিসেবে মেনে নিত এ দেশের মানুষ। এভাবে সর্বব্যাপী অজ্ঞতা আমাদের গ্রাস করছে আর দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে সেই কঠিন প্রশ্নের মুখে, আমরা কি ক্রমেই ব্যর্থ সমাজের দিকে এগিয়ে চলেছি?
৪.
স্বাধীনতা পেয়েছি ৫৪ বছর হয়ে গেছে। এই সময়ে বেশ ক’বার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটেছে। ক্ষমতা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার ক্ষমতা নিয়েই অনেক বিষয়ে সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। এসব নিয়ে মাঝেমধ্যে আলাপ-আলোচনাও হচ্ছে। কিন্তু যেসব বিষয়ের সঙ্গে সমাজের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক; যেসব বিষয়কে ভিত্তি করে সমাজ এগিয়ে যায়, সেসব নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। ফলে চেখভের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমাজ থেকে ক্রমেই আমরা এক জ্ঞানহীনতা তথা অজ্ঞতার সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছি।
পাকিস্তানের ২৪ বছর পশ্চিমা শাসকরা এ দেশে অজ্ঞতার চাষ করেছে। তবে সেটা বেশি হয়েছে রাষ্ট্রিক পর্যায়ে; সমাজের নিচের দিকে তা সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি; যদিও ব্রিটিশ শাসনের আদলে তারা এই দেশে একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। মনে করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর সেই চাষ বন্ধ হবে। কিন্তু তা হয়নি। চাষের দায়িত্ব দক্ষ কৃষকের হাতে পড়েনি; পড়েছে পুঁজির মালিক বুর্জোয়াদের হাতে। পাকিস্তানিদের চেয়েও দ্বিগুণ উৎসাহে এরা অজ্ঞতার চাষ করেছে। ফলে গত ৫৪ বছর এ দেশে জ্ঞানের পরিবর্তে অজ্ঞতার চাষই হয়েছে বেশি, যার ফসল এখন সর্বত্রই দৃশ্যমান। চাকচিক্যময় অন্ধকারে ঢেকে গেছে দেশ, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়ছে শিক্ষার ক্ষেত্রে।
গত কয়েক দশকে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক শ্রেণির মানুষের সন্তান লাখ লাখ টাকা খরচ করে ওইসব বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করছে। কিন্তু যে দেশের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের বেশি গ্রামে বাস করে, সে দেশের গ্রামীণ শিক্ষার অবস্থা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হয় না। ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে জেনেছি, আমার জেলায় গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গত কয়েক বছরে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র। অন্যদিকে গ্রামে থেকেও যারা কিছু লেখাপড়া শিখেছেন, তাদের প্রায় সবাই জেলা শহর কিংবা নিদেন পক্ষে উপজেলা শহরে এসে আস্তানা গাড়ছেন। ফলে ৮০ শতাংশ জনসংখ্যা অধ্যুষিত গ্রামগুলোর শক্তিকাঠামো পুরোপুরি চলে গেছে বা চলে যাচ্ছে শিক্ষাহীন অন্ধবিশ্বাসীদের হাতে। ফলে ক্রমেই অজ্ঞতার মেঘ ঢেকে দিচ্ছে যুক্তির আকাশ।
চারদিকে আজ নৈতিক মূল্যবোধের সংকট। ধর্ষণ, খুন, মব-সন্ত্রাস সমাজকে গ্রাস করে রেখেছে। নির্মল আনন্দ আর বিনোদনও অজ্ঞতার শিকার। এই তো সম্প্রতি কাপাসিয়ায় নাটক বন্ধ করে দেওয়া
হয়েছিল; সমাজ নষ্ট হয়ে যাওয়ার অজুহাতে। এর আগে গত নভেম্বরে ঠুনকো অজুহাতে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
ঠিক এমনটিই ঘটেছে আফগানিস্তানে। ২০২১ সালে দেশটিতে তালেবানরা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার তিন সপ্তাহের মাঝে সব ধরনের বিনোদন, এমনকি সংগীতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্তত দু’জন শিল্পীকে পিটিয়ে খুন করেছে। আমরাও কি তবে সে পথেই হাঁটছি? যদি তা-ই হয়; ব্যাধিটা সমাজ থেকে রাষ্ট্রে ছড়াতে বেশি সময় লাগবে না।
মোশতাক আহমেদ: কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, জাতিসংঘ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
চুম্বন দৃশ্যের অভিজ্ঞতা ভয়ংকর ছিল: মধু
বলিউড অভিনেত্রী মধু শাহ। নব্বই দশকের জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী মধু নামেই পরিচিত। মনি রত্নম নির্মিত ‘রোজা’ সিনেমায় অভিনয় করে প্রশংসা কুড়ান। নব্বই দশকে একটি সিনেমায় চুম্বন দৃশ্যে অভিনয় করেন মধু, যা ভীষণ তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।
কয়েক দিন আগে নিউজ১৮-কে সাক্ষাৎকার দেন মধু। এ আলাপচারিতা তিনি বলেন, “আজকাল সিনেমায় যে ধরনের চুম্বন দৃশ্য দেখা যায় এটি তেমন ছিল না। এটি ঠোঁটে খোঁচা দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা ছিল। সত্যি এটি আমার খারাপ লেগেছিল।”
চুম্বন দৃশ্যের অভিজ্ঞতা ভয়ংকর ছিল। তা জানিয়ে মধু বলেন, “শুটিং শুরু করার আগে আমাকে চুমু খেতে বলা হয়। কিন্তু তার আগে এ বিষয়ে আমাকে জানানো হয়নি। এ নিয়ে যখন প্রশ্ন করি, তখন তারা আমাকে পাশে নিয়ে গিয়ে কথা বলে। তারা আমাকে ব্যাখ্যা করে, এই দৃশ্যটি কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই কারণেই আমি চুম্বন দৃশ্যে অভিনয় করি। কিন্তু এটা ছিল আমার করা সবচেয়ে ভয়ংকর কাজ।”
চুম্বন দৃশ্যে যখন অভিনয় করেন, তখন মধুর বয়স ছিল ২২ বছর। তা স্মরণ করে এই অভিনেত্রী বলেন, “সিনেমায় চুম্বন দৃশ্যটির কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। সিনেমায় দৃশ্যটি অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য পরিচালকের সঙ্গে কোনো কথাও হয়নি। আমি এটি এড়িয়ে গিয়েছিলাম। কেবল বয়সের দিক দিয়ে নয়, আমি সবদিক থেকেই তখন খুব ছোট ছিলাম। এখনকার ২২-২৪ বছর বয়সি ছেলে-মেয়েরা ভীষণ চালাক। কিন্তু ২২ বছর বয়সে আমি খুব বোকা ছিলাম।”
১৯৯৬ সালে দীপা মেহতা নির্মাণ করেন ‘ফায়ার’ সিনেমা। এতে শাবানা আজমি, নন্দিতা দাস সমকামী চরিত্রে অভিনয় করেন। এ সিনেমা পর্দার ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে মধুর ধারণা বদলে দিতে শুরু করে। এ তথ্য উল্লেখ করে মধু বলেন, “আমি বলছি না, পর্দায় চুম্বন করা খারাপ। ‘ফায়ার’ সিনেমায় যখন শাবানাজির মতো অভিনেত্রীর অভিনয় দেখি, তখন আমার মনে হয়েছিল সত্যি তারা তাদের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে ফেলেছেন, যা আমি তখন করতে পারিনি। আমি সেই সব শিল্পীদের প্রশংসা করি, যারা মাথা ন্যাড়া করতে পারেন বা সিনেমায় সমকামীর ভূমিকায় অভিনয় করতে পারেন।”
১৯৯১ সালে তামিল ভাষার সিনেমার মাধ্যমে রুপালি জগতে পা রাখেন মধু। একই বছর ‘ফুল আউর কাঁটা’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন এই অভিনেত্রী। হিন্দি সিনেমায় পা রেখেই নজর কাড়েন। ৫৬ বছরের মধু অভিনয়ে এখন খুব একটা সরব নন। তবে প্রতি বছরে দুই একটা সিনেমায় দেখা যায় তাকে।
ঢাকা/শান্ত