যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ আরও সংকটের দিকে মোড় নিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করেছে বেইজিং। যুক্তরাষ্ট্রের দফায় দফায় শুল্ক বৃদ্ধির মুখে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কড়া ভাষায় জানিয়েছে, শেষ অবধি লড়াই করে যাবে তারা।

বিশ্ববাণিজ্যে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে কোণঠাসা করতে তৎপর ট্রাম্প। অন্য দেশগুলোর ওপর আরোপ করা পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করলেও চীনের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। হোয়াইট হাউস গতকাল বৃহস্পতিবার চীনা প্রায় সব পণ্যে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা জানায়। এরপর আজ শুক্রবার চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, মার্কিন প্রশাসনের ওই পদক্ষেপের পাল্টা হিসেবে দেশটির পণ্যের ওপর শুল্ক ৮৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তারই অংশ হিসেবে আজ দেশটিতে হলিউড চলচ্চিত্র আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৮টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে চীনের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) নালিশ করেছে বেইজিং।

এরই মধ্যে আজ বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের মুখে নিজেদের বাণিজ্য সামাল দিতে আগামী সপ্তাহে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফরের পরিকল্পনা রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্টের। আজ স্পেনের প্রধানমন্ত্রীকে সি চিন পিং বলেন, এই বাণিজ্যযুদ্ধে কেউ জয়লাভ করবে না। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে রক্ষা করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘একতরফা নিপীড়ন’ রুখে দিতে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) হাত মেলাতে হবে। শুধু নিজ স্বার্থ নয়, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এটা করতে হবে।

আজ সোনার দাম আরও বেড়ে প্রতি আউন্স দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২২০ ডলারে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র (আইটিসি) জানিয়েছে, চলমান শুল্কযুদ্ধে বৈশ্বিক বাণিজ্য ৩ থেকে ৭ শতাংশ কমে যেতে পারে। বৈশ্বিক জিডিপি কমতে পারে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের বাণিজ্য সংস্থার পরিচালক রেবেকা গ্রিনস্প্যান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর ‘বিপর্যয়কর প্রভাব’ ফেলতে পারে, যার কারণে দেশগুলো বিদেশি সহায়তা বন্ধের চেয়ে বড় ধাক্কা খেতে পারে।

আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দাম রেকর্ড বৃদ্ধি, কেন এত দাম বাড়ল৩ ঘণ্টা আগে

বিশ্ববাজারে অস্থিতিশীলতা

ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বুধবার ৯০ দিনের জন্য পাল্টা শুল্ক স্থগিত করায় পরদিন বৃহস্পতিবার বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার বেশ চাঙা হয়েছিল। তবে চীনের ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর আজ আবার বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা যায়। ইউরোর বিপরীতে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কমেছে ডলারের দাম। আর আজ সোনার দাম আরও বেড়ে প্রতি আউন্স দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২২০ ডলারে।

আজ বিকেল পর্যন্ত রয়টার্সের হিসাবে জাপানের নিক্কি এশিয়া সূচকে ৩ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার কোসপি সূচকের প্রায় ১ শতাংশ, ইউরোপের এসটিওএক্সএক্স ৬০০ সূচকে প্রায় ১ শতাংশ এবং জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের ডিএএক্স সূচকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পতন হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকে পতন হয় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

আরও পড়ুনঅন্যায্য দমন-পীড়নকে ভয় পায় না চীন: মার্কিন শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় সি চিন পিং৫ ঘণ্টা আগে

তবে আজ বিভিন্ন বাজারে সূচকে কিছুটা উত্থানও দেখা গেছে। বিকেল পর্যন্ত লন্ডনের এফটিএসই ১০০ সূচকে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ, প্যারিসের সিএসি ৪০ সূচকে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ, হংকংয়ের হ্যাংসেং সূচকে ১ দশমিক ১ শতাংশ এবং সাংহাইয়ের কম্পোজিট সূচকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ উত্থান হয়।

ইইউয়ের অর্থনীতিবিষয়ক কমিশনার ভালদিস দমব্রোভস্কিস কড়া ভাষায় বলেছেন, শুল্ক নিয়ে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো চুক্তি না হলে নিজ অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় প্রস্তুত রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

শেয়ারবাজারে এই উত্থান-পতনের বিষয়ে ব্রিটিশ আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান এজে বেলের বিনিয়োগবিষয়ক পরিচালক রাস মোল্ড বলেন, অর্থনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়ের ওপর শুল্কের প্রভাব নিয়ে এখনো যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে গেছে। এ কারণে বাজারগুলো কিছু সময়ের জন্য অস্থিত থাকতে পারে।

সমঝোতার জন্য দৌড়ঝাঁপ

বৃহস্পতিবার ট্রাম্প একপ্রকার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, বিভিন্ন দেশ যদি ৯০ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া অনুযায়ী চুক্তি না করে, তাহলে পাল্টা শুল্ক আবার ফিরিয়ে আনবেন তিনি। সে অনুযায়ী এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, ৭৫টির বেশি দেশ সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছে।

হোয়াইট হাউসের তথ্য অনুযায়ী, স্কট বেসেন্টের আলাপের পর ভিয়েতনামের উপপ্রধানমন্ত্রী হো ডাক ফোকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য আলোচনা শুরু করতে রাজি হয়েছে দুই দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার জন্য আলোচনা শুরুর কথা জানিয়েছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে। আর আগামী সপ্তাহে জাপানের একটি দলের যুক্তরাষ্ট্র সফরের কথা বলেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা।

বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, আগামী সোমবার ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনায় বসবেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্যবিষয়ক কমিশনার মারোস সেফকোভিক। তবে জোটের অর্থনীতিবিষয়ক কমিশনার ভালদিস দমব্রোভস্কিস কড়া ভাষায় বলেছেন, শুল্ক নিয়ে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো চুক্তি না হলে নিজ অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় প্রস্তুত রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

৯০ দিনের জন্য মার্কিন শুল্ক স্থগিত আলোচনার জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছে বলে মনে করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, শুল্ক স্থগিত সমঝোতার জন্য পথ খুলে দিয়েছে। তবে সাময়িক স্থগিত করাটা ‘ভঙ্গুর’। কারণ, এই ৯০ দিনে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে।

আরও পড়ুননতুন শুল্ক আরোপ হিতে বিপরীত হবে বলেই কি পিছু হটলেন ট্রাম্প১০ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প র র ওপর শ ল ক শ ন য দশম ক ৯০ দ ন র ন র জন য ব ষয়ক

এছাড়াও পড়ুন:

মায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির মতো সরু গাজার শিশুদের হাত

গাজার নাসের হাসপাতালের শিশু অপুষ্টি ওয়ার্ডের শিশুরা একরকম নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তীব্র ক্ষুধার কারণে ক্লান্ত হয়ে এই শিশুরা কাঁদতে পারেন না।

চিকিৎসকরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সবচেয়ে তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের চিকিৎসা করানো জায়গাগুলোতে নীরবতা এখন সাধারণ ঘটনা। শিশুদের এই নীরবতা তাদের শরীর কাজ না করার লক্ষণ।

১০ মাস বয়সী মারিয়া সুহাইব রাদওয়ানের মা জেইনা রাদওয়ান বলেন, “সে সবসময় নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে, এভাবে শুয়ে থাকে... ডাক দিলেও তার সাড়া পাওয়া যায় না।”

জেইনা তার শিশু সন্তানের জন্য দুধ বা পর্যাপ্ত খাবার খুঁজে পাচ্ছেন না এবং বুকের দুধ খাওয়াতে পারছেন না। কারণ তিনি নিজেও কম খাচ্ছেন, দিনে একবার খাবার খেয়ে বেঁচে আছেন।

গত সপ্তাহে, রয়টার্সের সাংবাদিকরা নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে পাঁচ দিন কাটিয়েছেন। এটি গাজার সবচেয়ে বিপজ্জনক ক্ষুধার্ত শিশুদের চিকিৎসা করতে সক্ষম মাত্র চারটি কেন্দ্রের মধ্যে একটি। রয়টার্সের সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিত থাকাকালেই তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা ৫৩ জন শিশুকে ভর্তি করা হয়েছিল।

ইসরায়েল মার্চ মাসে ত্রাণের প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে গাজার খাদ্য মজুদ ফুরিয়ে আসছে। খাদ্য মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে জুন এবং জুলাই মাসে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ব্যাপক দুর্ভিক্ষের সতর্কবার্তা দেয় এবং ক্ষীণকায় শিশুদের ছবি বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ৮৯ জন শিশুসহ ১৫৪ জন অপুষ্টিতে মারা গেছে। 

নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের শিশু ও প্রসূতি বিভাগের প্রধান ডা. আহমেদ আল-ফাররা বলেন, “আমাদের শিশুদের জন্য দুধ দরকার। আমাদের চিকিৎসা সরঞ্জাম দরকার। আমাদের কিছু খাবার দরকার, পুষ্টি বিভাগের জন্য বিশেষ খাবার। হাসপাতালের জন্য আমাদের সবকিছু দরকার।”

তিনি জানান,তার হাসপাতাল এখন অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের চিকিৎসা করছে যাদের আগে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল না, যেমন শিশু ওয়াতিন আবু আমুনাহ। প্রায় তিন মাস আগে সুস্থভাবে জন্মগ্রহণ করেছিল। জন্মের সময় তার ওজনের চেয়ে ১০০ গ্রাম কম এখন তার ওজন।

ফাররা বলেন, “গত তিন মাসে তার ওজন এক গ্রামও বাড়েনি। বরং শিশুটির ওজন কমেছে। পেশী সম্পূর্ণরূপে হ্রাস পেয়েছে। হাড়ের উপরে কেবল ত্বক রয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে শিশুটি তীব্র অপুষ্টির পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এমনকি শিশুটির মুখ: তার গাল থেকে চর্বি টিস্যুও হারিয়ে গেছে।"

শিশুটির মা ইয়াসমিন আবু সুলতান শিশুটির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দিকে ইঙ্গিত করে জানান, তার বাহু তার মায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির মতো মোটা

তিনি বলেন, “দেখতে পারছেন? এগুলো তার পা... তার বাহুগুলোর দিকে তাকান।”
 

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ