ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘটনায় বাংলাদেশের ভয়ের কিছু নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এ কে এনামুল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভয়ের কিছু নেই। কারণ, লড়াই হচ্ছে বড় বড় দেশের মধ্যে। এতে ব্যবসা ও বিনিয়োগ এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হবে। বিশেষ করে চীনের বিনিয়োগ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যাবে। তাতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ লাভবান হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের আওতায় পরিচালিত অধ্যয়ন কেন্দ্র ইকোনমিকস স্টাডি সেন্টার (আইজিসি) আয়োজিত ষষ্ঠ বাংলাদেশ অর্থনীতি সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে এ কথা বলেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মোজ্জাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আজ মঙ্গলবার তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলন শুরু হয়েছে।

‘অস্থির বিশ্বে বাংলাদেশ: বাণিজ্য, কূটনীতি এবং প্রবৃদ্ধির সন্ধান’ শীর্ষক অধিবেশনে সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক অতনু রব্বানী। আলোচক ছিলেন ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পারভেজ করিম আব্বাসী।

বিআইডিএসের মহাপরিচালক এ কে এনামুল হক বলেন, ট্রাম্প বাণিজ্যঘাটতি কমানোর কথা বললেও পাল্টা শুল্ক আরোপের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দর-কষাকষি। সেদিক থেকে ট্রাম্প সফল। ১৭৫টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এর বাইরে পাল্টা শুল্ক আরোপের আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনের উত্থান বাধাগ্রস্ত করা। তিনি বলেন, চীনের আজকের অবস্থানের পেছনে মূল রহস্য শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ।

বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধে বাংলাদেশকে কৌশল নির্ধারণে জোর দিতে হবে বলে মনে করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, ডলার ছাড়াও অন্য মুদ্রায় ব্যাংক হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এতে ডলারের ওপর চাপ কমবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাপ আসতে পারে।

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পারভেজ করিম আব্বাসী বলেন, চীন সিল্ক রুট করেছে। প্রযুক্তি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে চীন। বর্তমানে বিশ্বের বৈদ্যুতিক গাড়ির ৬৪ শতাংশ তাদের উৎপাদিত। ২০২০ সালে যুক্তরাজ্য সরকার চীনের হুয়াওয়েকে ৫জির কাজ দেয়। তখন পর্দার অন্তরালে চীনকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, পরিবেশ রক্ষার কথা বলে কাজগুলো করা হয়। ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক আরোপের মাধ্যমে নিজের দেশে বিনিয়োগ আনার কথা বলছেন। মূল বিষয় হচ্ছে চীনের সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকাণ্ডের দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন পদক্ষেপকে বড় ভুল উল্লেখ করে ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, এটির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে মূল্য দিতে হবে। অন্য দেশগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্র একধরনের ভীতি ছড়াচ্ছে। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ পড়াশোনা ও ঘুরতে যুক্তরাষ্ট্রে যায়। তবে মেধাবৃত্তি বন্ধ করেছে তারা। আগামী দিনে শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের বদলে চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যাবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প র

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ