কম্বাইন হারভেস্টার কিনে উল্টো বিপদে কৃষক
Published: 24th, April 2025 GMT
অনেক প্রত্যাশা নিয়ে সরকারি ভর্তুকিতে জমির ধান কাটতে কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র কিনেছিলেন হবিগঞ্জের কৃষকরা। তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। উল্টো কয়েকদিন পর পর মেরামত সংস্কারে খরচ বাড়িয়ে গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে সেগুলো। কেনার পর থেকে অধিকাংশ মেশিন বিকল হয়ে পড়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন হারভেস্টার মালিকরা। অন্যদিকে, হারভেস্টার মেশিন বিকল থাকায় সময়মতো ধান গোলায় তুলতে পারছেন না কৃষকরা।
এসব হারভেস্টার মালিকদের অভিযোগ, প্রতিকার পেতে কৃষি বিভাগের কাছে সাহায্য চাইলেও ফল মেলেনি। মেশিন মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কথা বলে দায়সারা জবাব দিচ্ছেন তারা। এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন, অগ্রগতি সাধিত হওয়ার কথা ছিল। সেটি হয়নি, বরং কৃষকরা উল্টো দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন।
জানা যায়, বিগত সরকার ধান কাটা ও মাড়াই সহজ করার লক্ষ্যে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প হাতে নেয়। সরকারের ভর্তুকির সহযোগিতা নিয়ে কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন বিক্রেতা কোম্পানির সঙ্গে কিস্তির মাধ্যমে টাকা পরিশোধের চুক্তিতে জেলায় ৬৩২টি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে হবিগঞ্জ সদরে ৭০, শায়েস্তাগঞ্জে ৫, মাধবপুরে ৩০, চুনারুঘাটে ৩৬, বাহুবলে ৭৯, নবীগঞ্জে ১১৬, লাখাইয়ে ৮৬, বানিয়াচংয়ে ১০৬ এবং আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় ১০৪টি হারভেস্টার যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে।
একাধিক উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, ওই প্রকল্পের আওতায় কেনা হারভেস্টার মেশিন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মালিকদের অনেকে। জেলায় ৬৩২টি হারভেস্টার মেশিনের মধ্যে অর্ধেক বিকল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। যন্ত্রপাতি মেরামত না করায় ধান কাটার কাজে আসছে না সেগুলো। সময়মতো ধান গোলায় তুলতে না পেরে ভোগান্তিতে পড়েছেন কৃষক। এছাড়া হারভেস্টার মেশিন বিকল থাকায় লাখ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মালিকরা। হারভেস্টার মেরামতে বার বার তাগিদ দিলে দায়সারা জবাব দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন। এমনটাই দাবি স্থানীয় হারভেস্টার মালিকদের।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের হারভেস্টার মালিক হাবিবুর রহমান মুক্তার জানান, ২০২২ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকার দামের হারভেস্টার সাড়ে ৪ লাখ টাকা জমা দিয়ে সরবরাহ করেন। ২০ লাখ টাকা সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার কথা রয়েছে। বাকি টাকা তাঁর কিস্তিতে পরিশোধ করার কথা। অথচ, বোরোর প্রথম মৌসুমে তাঁর হারভেস্টার মেশিন বিকল হয়ে পড়ে। এতে করে তিনি ধান কাটতে পারেননি।
একই অবস্থা লাখাই উপজেলার কদম আলী গ্রামের হারভেস্টার মালিক ইউপি সদস্য ছায়েদ আলীর। তিনি জানান, ২০২১ সালে আলীম ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড হারভেস্টার মেশিন সরবরাহ করে। মৌসুমের শুরুতে বোরো জমিতে নামালে মেশিনটি বিকল হয়ে পড়ে। বিষয়টি তিনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে জানালেও কেউ মেরামত করেনি।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার তেঘরিয়া গ্রামের আবজল মিয়া জানান, ২০২১ সালে ইয়ানমার হারভেস্টার মেশিন সরবরাহ করেন তিনি। প্রথম মৌসুম থেকে মেশিনের যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে মেরামত করে ধান কাটলেও ব্যাপক ভোগান্তি দেখা দেয়। একই এলাকার সিজিল মিয়া বলেন, ‘২০২১ সালে হারভেস্টার মেশিন সরবরাহ করি। মৌসুমের শুরুতে ধান কাটতে পারিনি। জমিতে নামার পর প্রায় সময়ই বিকল হয়ে পড়ে। এতে কৃষকরা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। যন্ত্রপাতির দাম থাকায় সময়মতো মেরামত করতে পারিনি।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ৬৩২টি হারভেস্টার মেশিনের মধ্যে ৫২৮টি চালু রয়েছে। যেগুলো চলতি মৌসুমে ধান কাটার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া হবিগঞ্জ সদরে ১৭, মাধবপুরে ২, চুনারুঘাটে ১২, বাহুবলে ২৬, নবীগঞ্জে ২২, লাখাইয়ে ৭, বানিয়াচংয়ে ৬ ও আজমিরীগঞ্জে ১২টি হারভেস্টার বিকল রয়েছে। সরবরাহের সময় মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সেগুলো মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম শ ন ব কল উপজ ল ক ষকর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন
দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় যখন শিল্প উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে, তখন গ্যাসকূপ খননে অগ্রগতি কম হওয়ার বিষয়টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশের অর্থনৈতিক সংকট এবং বিনিয়োগের গতি থমকে যাওয়ার পেছনে নিশ্চিতভাবেই জ্বালানিসংকটের বড় ভূমিকা আছে।
দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন না বাড়িয়ে বিগত সরকার উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানির যে নীতি নিয়েছিল, তারই প্রতিফল এটা। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা থাকলেও বাস্তব প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ফলে গ্যাস–সংকটের বৃত্ত থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, বিদ্যুৎ, শিল্প, ব্যবসা ও বাসাবাড়ির জ্বালানিতে বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৮০ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে ২৭০-২৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হচ্ছে ১৭৭ কোটি ঘনফুট। এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে ১১০ কোটি ঘনফুটের মতো। সব মিলিয়ে দৈনিক গ্যাসের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ কোটি ঘনফুট।
দেশের অর্থনীতির প্রাণ ফেরাতে এবং শিল্প ও বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটাতে হলে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই। ২০১৭ সালে দেশীয় উৎস থেকে সর্বোচ্চ ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়েছিল। এর পর থেকে এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা শুরু হয়। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, বিশ্ববাজারে এলএনজির দামের অনিশ্চয়তা ও অবকাঠামোগত সক্ষমতার ঘাটতিতে চাহিদামতো এলএনজি আমদানি সম্ভব হচ্ছে না।
এ বাস্তবতায় জ্বালানিবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান হতে পারে। স্থল ও সমুদ্রে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান এবং পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে নতুন কূপ খনন সমানতালে করা প্রয়োজন। সংকটে পড়ে বিগত সরকার ২০২২ সালে চার বছরে ৫০টি কূপ উন্নয়ন, সংস্কার ও অনুসন্ধানের কাজ হাতে নিলেও সেটি ধীরগতিতে এগোয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন বাতিল করা হয়। দরপত্র ডেকে চুক্তি করায় সময় বেশি লেগেছে, কিন্তু খরচ কমেছে। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কূপ খননের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ২০টি কূপ খননের কাজ শেষ হয়েছে। ফলে দৈনিক যেখানে ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস নতুন উত্তোলন হওয়ার কথা ছিল, সেখানে ২১ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে ১০০টি কূপ খনন প্রকল্পও হাতে নিয়েছে।
গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে কূপ খননের প্রকল্প নেওয়া হলেও দেশে রিগ বা খননযন্ত্রের ঘাটতি রয়েছে। বাপেক্স, বিজিএফসিএলসহ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত দেশীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বহুদিন ধরে বলা হলেও বিগত কোনো সরকারই তাতে কর্ণপাত করেনি। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে বলে আমরা মনে করি। এ ছাড়া দ্বীপজেলা ভোলায় প্রায় ১ হাজার ৪৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সম্ভাব্য মজুত থাকলেও সক্ষমতা অনুসারে গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে না। সেখানকার উৎপাদিত গ্যাস বাইরে আনার জন্য এখনো পাইপলাইন স্থাপন করা হয়নি, আবার সেখানেও শিল্পায়নের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়াও থমকে আছে।
জ্বালানি নীতিতে অবশ্যই জাতীয় সক্ষমতা ও দেশীয় উৎস থেকে জ্বালানি সরবরাহের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সমস্যায় পড়লে তাৎক্ষণিক সমাধানের যে টোটকা, সেখান থেকে জ্বালানি খাতকে বের করে আনতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। স্থল ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান, কূপ খনন, উন্নয়ন ও সরবরাহের অবকাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।