চেরনোবিলে কিসের ভুলে পারমাণবিক চুল্লিতে ইতিহাসের ভয়াবহতম বিস্ফোরণ হয়েছিল
Published: 26th, April 2025 GMT
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল (২৫ এপ্রিল দিবাগত রাত)। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিলে অবস্থিত ভি আই লেনিন নামের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্থ চুল্লিতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছিল। সেই সময় একদল প্রকৌশলী চুল্লিটিতে একটি পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করেন। তবে তা করতে গিয়ে নানা ভুল পদক্ষেপ নেন তাঁরা। এ ঘটনায় পারমাণবিক কেন্দ্রটির ভেতরে হঠাৎ বিদ্যুৎপ্রবাহ বেড়ে চুল্লিটি উত্তপ্ত হয়ে যায়। এরপর একের পর এক বিস্ফোরণ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক চুল্লির মূল অংশ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে লাগা একাধিক আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন। পরে হেলিকপ্টার থেকে বালু ও অন্যান্য পদার্থ ছড়িয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও তেজস্ক্রিয়তার বিস্তার ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। পারমাণবিক দুর্ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আনাটাকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি বলে বিবেচনা করা হচ্ছিল। তারা শুরুতে এ দুর্ঘটনার কথা গোপন রাখে। বাতাসের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তা ইতিমধ্যে সুইডেন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেখানকার একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মীরা তেজস্ক্রিয়তার উপস্থিতি টের পেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে এর ব্যাখ্যা চায়। প্রথমে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করলেও অবশেষে ২৮ এপ্রিল তারা দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থানদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পারমাণবিক শক্তি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৭৭ সালের শুরুর দিকে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা ইউক্রেন ও বর্তমান বেলারুশ সীমান্তের ঠিক দক্ষিণে চারটি আরবিএমকে ধরনের পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন করেন। প্রিপিয়াত নদীর তীরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান। প্রতিটি চুল্লি ১ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনে সক্ষম ছিল।
প্রকৌশলীদের অদক্ষতা১৯৮৬ সালের ২৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় একদল প্রকৌশলী চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪ নম্বর চুল্লিতে একটি বৈদ্যুতিক প্রকৌশলভিত্তিক পরীক্ষা শুরু করেন। চুল্লির টারবাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তার জড়তাজনিত শক্তি ব্যবহার করে জরুরি পানির পাম্পগুলো চালানো সম্ভব কি না, তা দেখতে চেয়েছিলেন তাঁরা। তবে এই প্রকৌশলীরা পারমাণবিক চুল্লির পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে খুব বেশি জানতেন না। তাঁদের পরীক্ষণ পরিকল্পনাটি ছিল ভুলে ভরা। পরীক্ষা চালাতে গিয়ে প্রথমেই তাঁরা চুল্লির জরুরি নিরাপত্তাব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বন্ধ করে দেন। এরপর তারা খুব কম বিদ্যুৎপ্রবাহ দিয়ে চুল্লিটি চালাতে থাকেন। এতে চুল্লিটি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় বিদ্যুৎপ্রবাহ আবার স্বাভাবিক করার চেষ্টায় তাঁরা অনেকগুলো কন্ট্রোল রড সরিয়ে ফেলেন।
এতে চুল্লির উৎপাদন ২০০ মেগাওয়াটের বেশি হয়ে ধীরে ধীরে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। তবে রাত ১টা ২৩ মিনিটের দিকেও প্রকৌশলীরা পরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁরা টারবাইন জেনারেটর বন্ধ করে দেন। তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন, টারবাইনের ঘূর্ণনশীল জড়তা দিয়ে চুল্লির পানির পাম্প চালানো যায় কি না, তবে সেই শক্তি যথেষ্ট ছিল না। চুল্লি যথাযথভাবে ঠান্ডা না হওয়ায় ভেতরের তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় গলন ঠেকাতে অপারেটররা একসঙ্গে প্রায় ২০০টি কন্ট্রোল রড চুল্লির ভেতরে ঢুকিয়ে দেন।
তবে সমস্যা হলো, রডগুলোর নকশায় ত্রুটি ছিল। প্রতিটি রডের ডগায় ছিল গ্রাফাইট টিপ। এতে রডের পাঁচ মিটার দীর্ঘ শোষণকারী অংশ ঢোকার আগেই একসঙ্গে ২০০টি গ্রাফাইট টিপ চুল্লিতে প্রবেশ করে। এ কারণে তাপমাত্রা আরও বেড়ে গিয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে চুল্লির ভারী ইস্পাত ও কংক্রিটের ঢাকনা উড়ে যায়।
স্বাস্থ্যগত প্রভাবঘটনার পর দ্রুতই বিশ্ববাসী বুঝতে পারে, তারা একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছেন। চেরনোবিলের চুল্লির মোট ১৯০ মেট্রিক টন ইউরেনিয়ামের প্রায় ৩০ শতাংশ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখান থেকে ৩ লাখ ৩৫ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেয় এবং চুল্লির চারপাশে প্রায় ১৯ মাইল ব্যাসার্ধ এলাকাকে ‘এক্সক্লুশন জোন’ বা ‘প্রবেশ নিষিদ্ধ অঞ্চল’ ঘোষণা করে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের তথ্য বলছে, দুর্ঘটনার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে অন্তত ২৮ জন প্রাণ হারান এবং ১০০ জনের বেশি মানুষ আহত হন।
জাতিসংঘের পারমাণবিক বিকিরণের প্রভাববিষয়ক বৈজ্ঞানিক কমিটি (ইউএনএসসিইএআর) বলেছে, বিকিরণের সংস্পর্শে আসার কারণে ছয় হাজারের বেশি শিশু-কিশোর থাইরয়েড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ এই সংখ্যার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
আন্তর্জাতিক গবেষকেরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, উচ্চমাত্রার বিকিরণের সংস্পর্শে আসা প্রায় চার হাজার মানুষ এবং অপেক্ষাকৃত কম মাত্রায় আক্রান্ত আরও প্রায় ৫ হাজার মানুষ ভবিষ্যতে বিকিরণ-সংশ্লিষ্ট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারেন।
চুল্লির অবশিষ্টাংশের চারপাশ এখন বিশাল ইস্পাতের কাঠামো দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। তেজস্ক্রিয়তার বিস্তার ঠেকাতে ২০১৬ সালের শেষ দিকে এ ইস্পাতের কাঠামোটি স্থাপন করা হয়।
পরিবেশগত প্রভাবচেরনোবিল বিপর্যয়ের পরপরই প্রায় ৪ বর্গমাইল এলাকা ‘রেড ফরেস্ট’ বা ‘লাল বন’ হিসেবে পরিচিতি পায়। কারণ, ওই অঞ্চলের অসংখ্য গাছ উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা শোষণ করে লালচে-বাদামি রং ধারণ করে এবং মরে যায়।
বর্তমানে চেরনোবিলের প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকাটিতে একদিকে যেমন ভুতুড়ে নীরবতা, আবার অন্যদিকে জীবনের এক আশ্চর্য উপস্থিতি দেখা যায়। সেখানে অনেক গাছপালা আবার গজিয়ে উঠেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা কিছু বন্য প্রাণীর মধ্যে চোখে ছানি পড়া, উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ঘাটতি থাকার মতো কিছু প্রমাণ পেয়েছেন।
চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষতিগ্রস্ত একটি অংশ.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র ঘটন র ক ত ইউন য ন চ রন ব ল পর ক ষ অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
গণ-অভ্যুত্থানের সময় অগ্নিসংযোগ, পুলিশের জন্য কেনা হচ্ছে ২০০ জিপ
বাংলাদেশ পুলিশের জন্য ২০০টি ডাবল কেবিন পিকআপ অর্থাৎ জিপ গাড়ি কেনা হবে। এ জন্য উন্মুক্ত দরপত্র ডাকা হবে না। সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের কাছ থেকে এসব গাড়ি কেনা হবে। প্রতিটি পিকআপের দাম ধরা হয়েছে ৮৬ লাখ টাকা। সে হিসাবে ২০০ পিকআপ কেনায় ব্যয় হবে ১৭২ কোটি টাকা। গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের ব্যবহৃত প্রচুর গাড়ি অগ্নিসংযোগে নষ্ট হয়। তাই নতুন গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
আজ মঙ্গলবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে গাড়িগুলো কিনতে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ পুলিশের অপারেশনাল কাজে ব্যবহারের জন্য সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে ২০০টি ডাবল কেবিন পিকআপ ক্রয়ের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি তাতে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।
নীতিগত অনুমোদনের প্রস্তাবে জননিরাপত্তা বিভাগ বলেছে, দেশে মোট ৬৩৯টি থানা রয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ১ জুন থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান ও এর জেরে উদ্ভূত ঘটনায় ৪৬০টি থানার পাশাপাশি পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায়ও অগ্নিসংযোগ হয়। এ কারণে পুলিশের বিপুলসংখ্যক যানবাহন পুড়ে যায়। সে জন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে গাড়ি কেনা দরকার।
অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে এ ছাড়াও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) নিয়ন্ত্রণাধীন টাঙ্গাইল কটন মিলসের ১ দশমিক ৩৬ একর জমি বিক্রির প্রস্তাবও অনুমোদিত হয়। ১৯৬১ সালে ২৭ দশমিক ২৯ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় কারখানাটি।
২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর তৎকালীন অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় জমি বিক্রির প্রস্তাব তোলা হয়েছিল। তখন কারখানাটির অব্যবহৃত জমি বিক্রির পরিবর্তে সরকারের উন্নয়নমূলক বা জনহিতকর কাজে ওই জমি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এ দুটির পাশাপাশি কমিটি ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ, ২য় পর্যায়)’ প্রকল্পের লট-২ এর আওতায় ২৫ লাখ ৫০ হাজার স্মার্ট কার্ড পারসোনালাইজেশন মুদ্রণের কাজ বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে (বিএমটিএফ) দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে কাজটি সম্পন্ন করা হবে। এটি নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব।
এর আগে প্রকল্পটির লট-১–এর আওতায় মোট ১ কোটি ৫৩ লাখ ৪১ হাজার স্মার্ট কার্ড পারসোনালাইজেশন করে মাঠপর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে বলে বৈঠকে জানায় নির্বাচন কমিশন। আরেক প্রস্তাবে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ খচিত লেখা মুদ্রণকাজেরও নীতিগত অনুমোদন দেয় কমিটি।
বৈঠকে হরিপুরে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বার্জ মাউন্টেড পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য প্রকল্পের উদ্যোক্তা কোম্পানি স্মিথ কো-জেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রা. লি. এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বাবিউবো) সঙ্গে বিরোধ আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। এ জন্য দুই কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হবে।
আসছে তিন কার্গো এলএনজি
এদিকে আজ মঙ্গলবার ক্রয় কমিটিতে আগামী মে, জুন ও জুলাই মাসের জন্য তিন কার্গো এলএনজি আমদানির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। এতে মোট ব্যয় হবে ১ হাজার ৬২০ কোটি ৫ লাখ টাকা।
এক কার্গো সমান ৩৩ লাখ ৬০ হাজার মিলিয়ন মেট্রিক ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ)। এক কার্গোর কাজ পেয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক আরামকো ট্রেডিং সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড। তাদের কাছ থেকে প্রতি এমএমবিটিইউ কিনতে ব্যয় হবে ১১ দশমিক ১৫ মার্কিন ডলার। এ জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৩৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
আরেক প্রস্তাবে গানভোর সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড থেকে এক কার্গো এলএনজি আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতি এমএমবিটিইউর দাম পড়বে ১১ দশমিক ২৭ ডলার। ভিটল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেড আরেক কার্গো সরবরাহের কাজ পেয়েছে। এখানে প্রতি এমএমবিটিইউর দাম ধরা হয় ১১ দশমিক ৩৫ ডলার।