পাকিস্তান আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়ায় এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগোর মতো ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলো এখন তাদের আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট ঘুরপথে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এতে তাদের জ্বালানি বাবদ বেশি খরচ হবে এবং ভ্রমণের সময়ও বেড়ে যাবে।

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীর হামলার ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় বিমানসংস্থার জন্য নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান। নিষেধাজ্ঞাটি আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

গত মঙ্গলবার কাশ্মীরের পেহেলগামের একটি খোলামাঠে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। ভারত বলছে, এ ঘটনায় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা আছে। তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

এ ঘটনার জেরে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে একাধিক পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তদেশীয় নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে। ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোর জন্য নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পাকিস্তান।

ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার২৪–এর তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে ভারতীয় বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগো তাদের নিউইয়র্ক, আজারবাইজান ও দুবাইগামী ফ্লাইটগুলো ঘুরিয়ে দিচ্ছে। এসব ফ্লাইট সাধারণত পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করে থাকে।

এই নিষেধাজ্ঞার কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে নয়াদিল্লির বিমানবন্দরের ওপর। এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর। এখান থেকে পশ্চিমা দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া ফ্লাইটগুলো সাধারণত পাকিস্তানের আকাশপথ ব্যবহার করে থাকে।

ডেটা বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান সিরিয়াম অ্যাসেন্ডের তথ্য বলছে, শুধু এপ্রিল মাসেই ইন্ডিগো, এয়ার ইন্ডিয়া এবং তাদের সুলভ মূল্যের শাখা এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০টি ফ্লাইট নির্ধারিত আছে। এগুলো নয়াদিল্লি থেকে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আমেরিকার দিকে যাবে।

ভারতের বেসরকারি বিমান চলাচলসংক্রান্ত এক নির্বাহী বলেছেন, নয়াদিল্লি থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে করে গন্তব্যে পৌঁছাতে গড়ে এক ঘণ্টা বেশি সময় লাগবে। এতে জ্বালানি খরচ যেমন বেশি হবে, তেমনি মাল পরিবহন কমাতে হবে। ওই কর্মকর্তা তাঁর নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

একটি বিমান সংস্থার মোট পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৩০ শতাংশই জ্বালানি ও তেল বাবদ হয়ে থাকে। এককভাবে এ খাতটি সবচেয়ে বেশি খরচের।

ইন্ডিগো বলছে, প্রায় ৫০টি আন্তর্জাতিক রুটের ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনা হতে পারে। এ ছাড়া তারা ঘোষণা দিয়েছে, ২৭ এপ্রিল থেকে অন্তত ৭ মে পর্যন্ত কাজাখস্তানে আলমাতিগামী এবং ২৮ এপ্রিল থেকে ৭ মে পর্যন্ত উজবেকিস্তানের তাসখন্দগামী ফ্লাইটগুলো বাতিল করা হয়েছে।

ভারতীয় বিমান সংস্থার এক পাইলট রয়টার্সকে বলেন, পাকিস্তানের আকাশসীমায় নিষেধাজ্ঞার কারণে বিমান সংস্থাগুলোকে নতুন করে উড়ান সময় নিয়ে হিসাব-নিকাশ করতে হবে। পাইলট ও ক্রুদের রোস্টারও পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। অন্য এক নির্বাহী বলেন, তাঁর সংস্থার কর্মীরা এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য গত বৃহস্পতিবার অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন।

দুই কর্মকর্তার কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

ফ্লাইট অ্যাওয়ারের তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার ইন্ডিগোর ৬ই১৮০৩ ফ্লাইটটির (নয়াদিল্লি থেকে আজারবাইজানের বাকু) গন্তব্যে পৌঁছাতে ৫ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট লেগেছে। পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ থাকায় তাদের বিকল্প একটি দীর্ঘ রুট ব্যবহার করতে হয়েছে। ফ্লাইটটি প্রথমে দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতের গুজরাট রাজ্যের দিকে এগিয়ে যায়, তারপর আরব সাগর পেরিয়ে উত্তর দিকে ঘুরে ইরানের ওপর দিয়ে আজারবাইজানে পৌঁছায়। অথচ গত বুধবার যখন ফ্লাইটটি পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করেছিল, তখন একই যাত্রা সম্পূর্ণ করতে সময় লেগেছিল মাত্র ৫ ঘণ্টা ৫ মিনিট।

পাকিস্তান ঘোষণা করেছে, তাদের আকাশসীমা ২৩ মে পর্যন্ত ভারতের জন্য বন্ধ থাকবে।

২০১৯ সালে পাকিস্তান প্রায় পাঁচ মাস আকাশসীমা বন্ধ রেখেছিল। ভারতের সরকারের তথ্য বলছে, ওই সময় এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিগো এবং অন্য বিমান সংস্থার সম্মিলিত ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর র ইন ড য র জন য ফ ল ইট ইন ড গ র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ